শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

এখনো পর্যটকদের বিমোহিত করে ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : মোঘল স্থাপত্যের সুনাম দুনিয়াব্যাপী। তাজমহল থেকে শুরু করে মোঘলদের এমন কোনো স্থাপত্য নেই যেখানে পর্যটকরা ভিড় করে না। ভ্রমণ পিপাসুরা তাদের কারুকার্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। চোখ আটকে যায় মোঘলদের স্থাপত্য শিল্পের নকশায়। অবাক অপোলক দৃষ্টির চাহনি যেন সরানোই সবচেয়ে কঠিন। স্থাপত্য শিল্পের জন্য যা কিছু দরকার সবই তার মধ্যে উপস্থিত। তেমনি একটি স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’। ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত এ মসজিদটি এখনো পর্যটকদের বিমোহিত করে। মুসলিম স্থাপত্যের অনিন্দ সুন্দর এ মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে যেন তৃষ্ণা মেটে না। বারবার দেখার ইচ্ছা জাগে মন ছুঁয়ে যাওয়া এ স্থাপত্যশিল্পটি।
ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত মোগল শাসনের প্রচলিত স্থাপত্যরীতি নিদর্শন ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’। মসজিদটি লালবাগ দূর্গ মসজিদ এবং খাজা আম্বর মসজিদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ মসজিদটি নির্মাণ করেন। অন্য এক তথ্যে জানা যায়, নবাব শায়েস্তা খাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বুজুর্গ উদ্দিন (উমিদ) খাঁ এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। মসজিদটি শায়েস্তা খানীয় স্টাইলে তৈরি একটি মসজিদ। বর্তমানে, মসজিদটি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্বাবধানে আছে।
মসজিদের বিবরণ: মসজিদের সাতটি গম্বুজ থাকার কারণে একে ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’ বলা হয়। সাত গম্বুজের মধ্যে রয়েছে তিনটি বড় গম্বুজ ও চারটি ছোট গম্বুজ। এর মিনারের সংখ্যা চারটি। মসজিদের ছাদে রয়েছে তিনটি বড় গম্বুজ এবং চার কোণের প্রতি কোনায় একটি করে অনু গম্বুজ মিলে হয়েছে সাত গম্বুজ। এর আয়তাকার নামাজকোঠার বাইরের দিকের পরিমাণ দৈর্ঘ্যে ১৭.৬৮ এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার। এর পূর্বদিকের গায়ে ভাঁজবিশিষ্ট তিনটি খিলান এটিকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। দূর থেকে শুভ্র মসজিদটি অত্যন্ত সুন্দর দেখায়। মসজিদের ভিতরে ৪টি কাতারে প্রায় ৯০ জনের নামাজ পড়ার মত স্থান রয়েছে। মসজিদের পূর্বপাশে এরই অবিচ্ছেদ্য অংশে হয়ে রয়েছে একটি সমাধি। কথিত আছে, এটি শায়েস্তা খাঁর মেয়ের সমাধি। সমাধিটি ‘বিবির মাজার’ বলেও খ্যাত। এ কবর কোঠাটি ভেতর থেকে অষ্টকোনাকৃতি এবং বাইরের দিকে চতুষ্কোনাকৃতির। বেশ কিছুদিন আগে সমাধিক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিল। বর্তমানে এটি সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের সামনে একটি বড় উদ্যানও রয়েছে। বাগানে আছে হরেক রকমের ফুলের গাছ। দুর থেকে তা খুব সুন্দর দেখায়। বর্তমানে নামাজির সংখ্যা বেশি হওয়ায় মসজিদের ভেতরে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাইরে খোলা জায়গার ওপরে তাঁবু টাঙিয়ে জায়গা বাড়ানো হয়েছে।  
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল জাফরাবাদ গ্রামে, নদীর তীরে। নদীটি বুড়িগঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাহলে কি মোহাম্মদপুর এলাকার নাম একসময় জাফরাবাদ ছিল? হয়তো তাই। তবে প্রকৃতির সেই জৌলুস আর নেই, নেই সেই খোলা প্রকৃতি। নদী কোথায় হারিয়ে গেছে তার খোঁজ রাখেনি কেউ। একসময় মসজিদের পাশ দিয়ে বয়ে যেত বুড়িগঙ্গা। মসজিদের ঘাটেই ভেড়ানো হতো লঞ্চ ও নৌকা। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা কল্পনা করাও কষ্টকর। বড় দালানকোঠায় ভরে উঠেছে মসজিদের চারপাশ। অথচ একসময় দূর থেকে এই মসজিদকে দেখে মনে হতো যেন- ‘তাজমহল’। অনেকেই একে তখন ‘তাজমহল মসজিদ’ বলে ডাকতেন। আশেপাশে কোনো বাড়িঘর ছিল না। তখন এটিই ছিল ঢাকায় চোখে পড়ার মতো উঁচু স্থাপনা, যা কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যেত। তখন মিরপুর ব্রিজে দাঁড়ালে এটি দিব্যি দেখা যেত। মসজিদের পাশেই নদীঘাটে বড় বড় নৌকা এসে ভিড়তো। বর্ষায় পুরান ঢাকা থেকে মানুষজন নৌকা ও বজরায় আর শুকনো মৌসুমে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মসজিদটিতে নামাজ পড়তে আসতেন।
১৮১৪ সালে স্যার চার্লস ডি ওয়াইলির (ঢাকায় অবস্থানকাল ১৮০৮-১৮১১) আঁকা একটি চিত্রকর্ম আছে এই সাত মসজিদকে ঘিরে; যার শিরোনাম গঙ্গার শাখা নদী বুড়িগঙ্গার তীরের মসজিদটি। এতে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীর পাশেই মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে। নদীর বুকে বয়ে চলেছে নৌকা। ১৯৭৪ সালেও মসজিদটির চারপাশটা পানিতে তলানো ছিল। অনেকে তখন মসজিদের রেলিংয়ে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতেন। রেলিংটা ছিল মাটি থেকে অনেক ওপরে। এখন অবশ্য মাটি থেকে হাঁটুর উপরে রেলিং। তখন মসজিদটি মাটি থেকে তিনতলা সমান উঁচু ছিল। এখন মাটি থেকে বরাবর হেঁটে মসিজদে প্রবেশ করা যায়। সে-সময় মসজিদের আশেপাশে একটিমাত্র মাটির পথ ছিল।
তিন শতাব্দীর বেশি পেরিয়ে গেলেও মসজিদটির অবকাঠামো এখনও প্রায় অবিকৃতই আছে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় মসজিদে পানি উঠে গিয়েছিল। সমাধিক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পড়েছিল। এরপরে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর এর দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তারা প্রথমে মসজিদের সামনের অংশটি পাকা করে এবং তারপর মসজিদের ভেতরের অংশে এবং বাইরে মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের স্থানটি মোজাইক করে দেয়। সমাধিটিও এটি সংস্কার করা হয়েছে। তবে পুরাতন যে রঙ ছিল সেটা আর নেই। সেটা ছিল অনেকটা ইট রঙের মতো কিছুটা খয়েরিও বলা যায় । পরে চুনা সুরকি ছিল। এখন যে রঙ, সেটা আসল রঙ নয়।
ইংরেজ আমলের বেঙ্গল সার্ভিসের সার্জন ড. জেমস অ্যাটকিনসনকে এই মসজিদ ভেনিসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। ফার্সি জানা অ্যাটকিনসন ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গের বাখরগঞ্জের (বরিশাল-পটুয়াখালি) শাসনভার পেয়েছিলেন। তিনি ‘অ্যান্টিকুইটিজ অব ঢাকা’তে মোহাম্মদপুরের সাত গম্বুজ মসজিদের বলছেন ঢাকার এই মসজিদটি দেখলে ইতালির ভেনিস শহরের কথা মনে পড়ে যায়। কেননা, এটি হঠাৎ করে যেন নদীর তীর থেকে উঠে এসেছে; যা এটিকে দিয়েছে অপূর্ব চিত্রের বিষয়োপযোগিতা। মসজিদটির নির্মাণ কৌশলে সাধারণ পরিমিতিবোধ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য স্থপতির সৌন্দর্যবোধ ও প্রতিভা প্রশংসা করবার মতো। সময়ের করাল গ্রাস, আগাছা, ঝড়-বাদল ও রৌদ্রতাপ শুধু যে এর বর্ণবৈচিত্র্য বাড়িয়েছে তা কিন্তু নয় সেই সঙ্গে বর্ণের উজ্জ্বলতায় কমনীয়তা এনেছে। তারাপরও মসজিদটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখেছে।
কিভাবে যাওয়া যায়: নতুনের প্রতি আকর্ষণ কার না থাকে? এজন্যই তো ভ্রমণ পিপাসুরা বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াই নতুনের সন্ধানে। তারপরও কতোকিছু অদেখা রয়ে য়ায়। আবার অনেক কাছে থেকেও না জানার কারণে সুন্দর একটি জিনিষ দেখা হয় না। তেমনই নির্মাণশৈলীর আরেকটি কারুকার্য খচিত সুদৃশ্য স্থাপত্য শিল্প সাত গম্বুজ মসজিদ। পাঠক, যারা আপনারা এখনো দেখেননি তাদের বলছি- মন চাইলে অবশ্যই যেতে পারেন ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি দেখতে। সে জন্য আপনি যেখানেই থাকেন না কেন, প্রথমে আপনাকে আসতে হবে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে। বাসে করে মোহম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে আসা খুব সহজ। খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হবে না। বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখবেন একটি রাস্তা বাঁশবাড়ী হয়ে চলে গেছে শিয়া মসজিদের দিকে। বাঁশবাড়ীর রাস্তায় পা ফেলতেই দেখবেন রাস্তার বাম পাশে দাঁড়িয়ে আছে লাল রঙের শত বছরের পুরোনো মসজিদটি। পবিত্র রোজার মাসে সময় করে আপনিও দেখে আসতে পারেন চক্ষু শীতল করা এ মসজিদটি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ