দাতা সংস্থার বর্ধিত সুদে বাজেটে বাড়বে করের বোঝা
এইচ এম আকতার : প্রতি বছরই বাড়ছে জাতীয় বাজেটের আকার। বাজেটের লক্ষ্য পূরণে বাড়ছে করের বোঝাও। আগামী অর্থবছরে বাজেট হবে প্রায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ বাজেটে দাতা সংস্থার ঋণের বর্ধিত সুদের নেতি প্রভাব পড়বে বাজেটে, বাড়বে করের বোঝাও। বিগত বাজেটের তুলনায় চলতি বছর বাজেটের আকার বেড়েছে ৩২ শতাংশ। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অভ্যন্তরীণ আয় করতে হবে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ১ লাখ ৮১ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা ধরা হতে পারে। ৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে করদাতা ও করের হার বাড়ানোসহ বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। করের জাল যত বিস্তার হচ্ছে মানুষের ওপর হয়রানি তত বাড়ছে।
জানা গেছে, এবারের বাজেটে বেশ কিছুটা ভিন্নতা থাকবে। কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ এখন স্বল্প উন্নত দেশ(এলসিডি) থেকে বেরিয়ে মধ্যম আয়ের পথে যাত্রা শুরু করেছে। এতে করে রাজস্ব আয়ের ভিন্নতা আসবে। কারণ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার দেয়া ঋণের সুদ হার বেড়ে যাবে ১৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ আগে এ ঋণের সুদ হার ছিল দশমিক ৭৫ আর এখন এ সুদের হার দাঁড়াবে ২ শতাংশে।
গত বাজেটে ঋণ পরিশোধে সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এবার ব্যয় করতে হবে দ্বিগুণের বেশি। আর এ বর্ধিত ব্যয় দেশের অভ্যন্তরীণ খাত থেকেই আয় করতে হবে। এতে করে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে আগামী বাজেটে করের বোঝা বাড়ছে।
সরকার নানাভাবে প্রচার করছে উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ। কিন্তু এই উন্নয়নের পথে যে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা কিন্তু প্রচার হচ্ছে না। এতে করে দেশের ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাংলাদেশ এ পথে যত এগুবে তত আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা হারাবে। হারাবে বিদেশি বিনিয়োগও।
তাছাড়া যে হিসাব দিচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, তাতেও অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। এতে করে পাল্টে যেতে পারে অনেক হিসাব-নিকাস। জিডিপির প্রবৃদ্ধি, মাথা পিছু আয়, দারিদ্র্যের সংখ্যা প্রভৃতি হিসাবে অনেক পরিবর্তন আসবে। এতে করে রাজস্ব খাতে অনেক পরিবর্তন আসবে।
মানবসম্পদ উন্নয়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এটি হবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবারের বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) রেকর্ডসংখ্যক নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই চলতি মেয়াদে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কেননা বর্তমান সরকারের মেয়াদ আছে আর মাত্র আট মাস। গত মাসে অনুষ্ঠিত আর্থিক কো-অর্ডিনেশন ও মুদ্রার বিনিময় হার-সংক্রান্ত কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। সূত্র জানায়, আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের মূল আকার হতে পারে ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার, যা চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৬৮ হাজার কোটি টাকা বেশি। এবারের বাজেটে মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। এ জন্য পৃথক স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট ও মন্ত্রণালয় গঠনেরও প্রস্তাব থাকতে পারে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়।
এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতি পাওয়ায় যে কোনো মূল্যে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখতে চায় সরকার। আগামী বাজেটে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাম্পার অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে ব্যাহত না করলে ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৮ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা হবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এদিকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে ভাসানচরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী বসতি গড়ে দেওয়া হবে। এ জন্য আসছে বাজেটে এ খাতে পৃথক বরাদ্দ রাখা হবে। ইতিমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে এ সংক্রান্ত চাহিদাপত্র দাখিল করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী নতুন-পুরনো মিলিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। বিপুলসংখ্যক এই রিফিউজির বসবাসের জন্য ভাসানচর যথেষ্ট নয়। ফলে কক্সবাজারের উখিয়া, কুতুপালংসহ অন্য যেসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে সেগুলোতেও নতুন করে বরাদ্দ দেয়া হবে আগামী বাজেটে। জানা গেছে।
গত মাসে অনুষ্ঠিত রাজস্ব সমন্বয় কাউন্সিলের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৮-১৯ সালে দেশের মোট জিডিপি হবে ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যা বর্তমানে রয়েছে ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ১ লাখ ৮১ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা ধরা হতে পারে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২৪ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। আর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ধরা হতে পারে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এর বাইরে এনবিআর ও করবহির্ভূত রাজস্ব আয় ধরা হতে পারে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছর সার্বিকভাবে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা, যা বর্তমানে রয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। বিশাল পরিমাণ এই ঘাটতি পূরণ করা হবে বৈদেশিক ঋণ, অনুদান, স্থানীয় ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে।
সেবা খাতে কিছু সুবিধা দিয়ে কোনো কোনো খাতে আবার ভ্যাটের আওতা বাড়িয়েছে সরকার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এই বাজেটটি মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের চতুর্থ বাজেট। দেশীয় কোনো কোনো শিল্পে প্রণোদনার কথা বলা হলেও তৈরি পোশাক শিল্পে উৎসকর হার বাড়ানো হয়েছে। বিশাল ব্যয়ের বাজেট বাস্তবায়নের ঝুঁকি রয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ধীর গতি আর রাজস্ব আদায় লক্ষ্যের চেয়ে কম হওয়া প্রতিবছরের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী মনে করেন, অর্থনীতির আকার বেড়েছে, ফলে বাজেটের আকারও বাড়াতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেট হবে প্রায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
যদিও সহজ আদায়ের উপায় হিসেবে ভ্যাট খাত থেকেই আদায় করবে বেশি। অবশ্য বহুল আলোচিত নতুন ভ্যাট আইনের কার্যকর পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে। তবে বিদ্যমান ভ্যাটের হার ও আওতা বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে আয়কর ও শুল্ক কাঠামোতেও বেশকিছু পরিবর্তন আসছে। ফলে উদ্যোক্তাদের ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ভ্যাট ও আয়করে ভর করে সরকার এযাবৎকালের সর্বোচ্চ হারে রাজস্ব আদায় করতে চায়। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশীয় অর্থায়নে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। বিশ্লেষকরা বলছেন, আয় ও ব্যয়ের এ বিশাল বাজেট বাস্তবায়নই প্রতি বছরের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে।
ব্যবসায়ীরা আমাদের ব্যবসা নেই তারপরেও সরকার প্রতিবছর নানাভাবে ভ্যাট আদায়ের নামে হয়রানি করছে। দেশের প্রতিটি সেবা খাত আজ ভ্যাটের আওতায় আনা হচ্ছে। অথচ সাধারণ জনগণ কোন ধরনের সেবা পাচ্ছে না। উন্নয়ন বাজেটের নামে লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও দৃশ্যত তেমন কোন উন্নয়ন নেই। এতে করে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
প্রতিনিয়তই সরকার বাজেটের আকার বাড়াচ্ছে এতে করে অভ্যন্তরীণ আয়ও বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে এনবিআর। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর সব সেবা প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনছে। আর এতে করে জনগণের ওপর নানাভাবে করের বোঝাও চাপছে।
নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি বাজেট পূর্বের তুলনায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি হতে পাবে। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ হারে বাজেটের আকার বাড়ছে। এতে করে অতিমাত্রায় জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়ছে। আর এ বছর এ হার বাড়ছে ৩২ শতাংশের বেশি।
বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি, যা বর্তমান মন্দা অর্থনীতির মধ্যে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। যদিও অতীতে কখনও ১৯ শতাংশের বেশি রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়নি। চলতি বছরের বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এই সরকারের আমলে একজন কৃষকও করের আওতামুক্ত নয়। দেশে প্রতিটি কৃষকই এখনও মোবাইল ব্যবহার করে থাকেন। আর মোবাইলের কলচার্জ এবং ভ্যাট কর্তন করা হচ্ছে। অথচ সরকার বলছে তারা তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন করবে। এবারের বাজেটের পর এ খাতে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর বসতে পারে। চাল, গম, ভুট্টা বীজ, সানফ্লাওয়ার অয়েল, চিনি, ন্যাপথা, পেট্রোলিয়াম পণ্য, ঝুট, এমএস রড, কম্পিউটার অ্যাক্সেসরিস, মোবাইল সেট, মডেম, রাউটারসহ আরও বেশকিছু পণ্য আমদানিতে অগ্রিম আয়কর বসতে পারে। এর পাশাপাশি সব ধরনের ব্র্যান্ডের বিড়ি-সিগারেটের ওপরও শুল্ক করহার বাড়ানো হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বড় বাজেট হলেও মাথাপিছু বরাদ্দ খুবই কম। সে হিসাবে বাজেটের আকারকে খুব বেশি বড় বলা যাবে না। তবে চলতি অর্থবছরের চেয়ে বাজেটের আকারকে সরকার অতি উচ্চাভিলাষী মাত্রায় নিয়ে গেছে।
এ বছর বাজেটে করের বোঝা আরও বাড়তে পারে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ঋণের সুদের হার বাড়বে। এতে করে করের বোঝাও বাড়বে। এলসিডি থেকে দেশ বেরিয়ে যাওয়াতে কিছুটা প্রতিকূলতায়ও পড়বে দেশ। এসব প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে কর বিন্যাস করতে হবে।
আগামী বাজেটকে সামনে রেখে অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। চলতি বাজেটের চেয়ে আগামী বাজেটের আকার বড় করতে রাজস্ব প্রাপ্তি বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। তবে কম বেশি হতে পারে। এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এলডিসি তালিকা থেকে বের হওয়া মানে দরিদ্র বা গরিব দেশের তালিকা থেকে বের হওয়া। দরিদ্র দেশ হিসেবে আমাদের আর কেউ দুর্বল ভাববে না। এটা যেকোনও দেশের জন্য গৌরবের বিষয়, গর্বের বিষয়, মর্যাদার বিষয়। এটা হলে দেশের ভেতরেও স্বস্তি তৈরি হবে।
তবে এ প্রভাব পড়বে আগামী বাজেটে। এ বাজেটে অনেক ব্যয় বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে নানাভাবে করের বোঝা। এ জন্য সরকারকে নানাভাবে এর ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে হবে। তা না হলে বাজেট বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন হবে। কর আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাও কঠিন হবে।