মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ইসলামের শোষণমুক্ত শ্রমনীতি ও মেহনতী মানুষের মুক্তি

জিয়া হাবীব আহসান : [দুই]
ভিক্ষাবৃত্তি ঘৃণিত : মহানবী (সাঃ) ভিক্ষাবৃত্তিকে মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন। তার অসংখ্য প্রমাণ ইসলামের ইতিহাসে রয়েছে। মহানবী (সাঃ) বলতেন, “যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হবে যে, সে কোন দিন ভিক্ষা করবে না তার জান্নাত লাভের দায়িত্ব আমি নিলাম” (আবু দাউদ)।
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক : আমাদের শ্রম আইনে মালিক-শ্রমিক স¤পর্ক হচ্ছে “মাস্টার এন্ড সার্ভেন্ট” পর্যায়ের। কিন্তু মহানবী (সাঃ) এর আদর্শে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তারা সকলেই আল্লাহর বান্দা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “ তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ যে ভাইকে যে ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন, তাকে তাই খাওয়াতে হবে যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরতে দিতে হবে যা সে নিজে পরিধান করে” (বুখারী-মুসলিম)। শ্রমিকদের প্রতি আল কুরআনের নির্দেশ হল, “সর্বোত্তম শ্রমিক সে, যে শক্তিশালী ও আমানতদার” (কাসাস : ২৬)। আর মনে রাখবে কোন জিনিস সম্পর্কে কখনো একথা বলবে না যে, “আমি কাল এ কাজ করব” (কাহাফ : ২৩)। “মালিক-শ্রমিক উভয়ের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ, ওয়াদা পূর্ণ কর। ওয়াদা সম্পর্কে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে” (ইসরার : ৩৪)।
কাজের সময় ও প্রকৃতি : রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “শক্তি-সামর্থ্যের অতিরিক্ত কাজ শ্রমিকদের উপর চাপাবে না। যদি তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত কোন কাজ তাকে দাও তাহলে সে কাজে তাকে সাহায্য কর”(বুখারী-মুসলিম)। কাজের প্রকৃতির পরিমাণ না জানিয়ে কাউকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না (আল হাদীস)। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, সাধ্যানুযায়ী কাজ করার ক্ষমতা ও রুচিকে ইসলাম মানুষের জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
শ্রমিককে তার কাজের প্রকৃতি জানাতে হবে : শ্রমিককে এক কাজের জন্য নিয়োগ দিয়ে অন্য কাজ করানো যাবে না যা তার জন্য অধিক কষ্টকর। এ প্রসঙ্গে শ্রমিকের স্বাধীন সম্মতি নিতে হবে। এটাই ইসলামী শ্রমনীতির মূলনীতি।
শ্রমিকের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা : মহানবী (সাঃ) নিজেই ভৃত্য, কর্মচারীদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখতেন এবং রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতেন। মহানবীর আদর্শ হলো শ্রমিককে দিয়ে এমন কিছু করানো যাবে না, যার ফলে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে এবং তার লোকসান হয়। ইসলামের শ্রম আইনের দৃষ্টিতে বৃদ্ধ, পঙ্গু, অসুস্থ, অসহায়, এতিম, বিধবা এবং দুর্বলদের ভরণ-পোষণ ও তাদের যাবতীয় দায়িত্বভার রাষ্ট্রের। সরকার রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় কোষাগার থেকে তাদের সমস্ত প্রয়োজন পূরণে ভাতা নির্ধারণ করবে। মহানবী (সাঃ) এর শাসনামলে এর চরম নিদর্শন দেখা যায়। আধুনিক রাষ্ট্রে শ্রমিকের নিজের ও তার পরিবারের শিক্ষার দিকে নজর দেয়া হয় না। অথচ মহানবী (সাঃ) এর নীতি হলো শিক্ষা হবে অবৈতনিক। যার ফলে সকল ব্যয়ভার রাষ্ট্রই বহন করবে। ইসলামে জ্ঞান অর্জন করা নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে ফরজ। হযরত ওজলী ইবনে আতার (রাঃ) বর্ণনা মতে, “মদিনায় তিনজন শিক্ষিত মুসলমান ছিলেন, তাঁরা মদিনার শিশুদেরকে শিক্ষা দিতেন। আর হযরত উমর (রাঃ) তাঁদেরকে রাষ্ট্রীয় তহবিল (বায়তুল মাল) থেকে মাসোহারা (বেতন) দিতেন।” শ্রমিকদের অধিকার মালিকরা ঠিকমত আদায় করছে কিনা তার দিকে নজর রাখাও সরকারের দায়িত্ব।
ইসলামে শিশুশ্রম : ইসলাম শিশুশ্রম সমর্থন করে না। ছোটদের প্রতি দয়া, তাদের শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা জাতীয় ও ঈমানী দায়িত্ব। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “যারা ছোটদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে না এবং বড়দেরকে সম্মান করে না তারা আমাদের উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়” (আবু দাউদ)।
মজুরী নির্ধারণ : শ্রমিক নিয়োগের সময় মালিক-শ্রমিক খোলামেলা আলোচনা সাপেক্ষে বেতন এবং চাকরির শর্ত নির্ধারণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কোরআনের নির্দেশ, “তারা তাদের যাবতীয় বিষয় পার¯পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে স¤পন্ন করে থাকে” (সূরা : ৩৮)। নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, “মজুরী নির্ধারণ ব্যতীত কোন শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করা নিষেধ”(বায়হাকী)। ইসলাম যে কোন লেনদেন চুক্তি লিখিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
ওভারটাইম সুবিধা : কোন শ্রমিকের দ্বারা অতিরিক্ত কাজ করানো হলে অবশ্যই তাকে অতিরিক্ত মজুরী দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সাঃ) এর নির্দেশ, “ তোমরা তাদের উপর বাড়তি দায়িত্ব চাপালে সে হিসেবে তাদেরকে বাড়তি মজুরি দিয়ে দাও” (আল হাদিস)।
ইসলামে শ্রমিকের বেতন : রাসুলে পাক (সাঃ) পারিশ্রমিক নির্ধারণ ছাড়া শ্রমিকদের থেকে কাজ করিয়ে নেয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক কাজ করা মাত্রই পারিশ্রমিক দাবি করতে পারে। চুক্তি অনুসারে প্রত্যেক শ্রমিককে যথাসময়ে পূর্ণ বেতন পরিশোধ করে দিতে হবে। ত্বরিৎ মজুরী পরিশোধের তাগিদ দিয়ে মহানবী (সাঃ) বলেন, “শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকাবার পূর্বেই তার মজুরী আদায় করে দাও”(ইবনে মাজাহ)। নবী করিম (সাঃ) আরো বলেছেন, “তিন ধরনের ব্যক্তি আছে কিয়ামতের দিন আমি যাদের দুশমন হবো। আর আমি যাদের দুশমন হবো তাদের আমি লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত করে ছাড়ব। উক্ত তিন জনের মধ্যে একজন সে, যে কোন শ্রমিককে দিয়ে নিজের পুরোপুরি কাজ আদায় করে নেয় কিন্তু তার উচিত মজুরী দেয় না” (বুখারী)।
উৎপাদিত পণ্যে শ্রমিকের অংশীদারিত্ব : উৎপাদিত পণ্যে তথা মুনাফায় শ্রমিকের অংশীদারিত্ব ইসলামী শ্রমনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কেননা, পুঁজি ও শ্রমের মিলিত শক্তি উৎপাদন ঘটায়। মহানবী (সাঃ) বহুদিন পর্যন্ত নিজের  শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভের অংশীদার হিসেবে মুদারাবাতের ভিত্তিতে হযরত খাদিজা (রাঃ) এর ব্যবসায় শ্রম দিয়েছেন। ইসলামী আইন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিককে লভ্যাংশের অধিকারী বানায়। নবী করিম (সাঃ) এর ফরমান, “মজুর ও শ্রমিককে তার শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য হতেও অংশ দিও। কারণ আল্লাহর মজুরকে কিছুতেই বঞ্চিত করা যায় না” (১৭৩, মসনদে আহমদ)। বিত্তবানের স¤পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে (জারিয়াত, ১৯১)। যেন তারা ফল পেতে পারে যা তাদের হাত দ্বারা করা হয়েছে (ইয়াসিন)।
সংগঠন তথা ট্রেড ইউনিয়ন : শোষণমুক্ত শ্রমনীতির দাবিতে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন করাকে ইসলাম পূর্ণ সমর্থন করে। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, “সংগঠন ছাড়া ইসলাম হয় না।” ইসলামে অধিকার প্রতিষ্ঠার সার্বিক প্রয়াসকে জিহাদ বলে। আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিতরা আন্দোলন-সংগ্রাম করবে এটাই ইসলামের বিধান। সকল প্রকার জুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রাম করা ইসলামে ফরজ। আল-কোরআন সু¯পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, মানুষ যা উপার্জন করে তা পাবার অধিকার রয়েছে এবং তার এই অধিকারে বাধা সৃষ্টি করা জুলুম বা অত্যাচার।
অমুসলিম শ্রমিকদের অধিকার : ইসলামী শ্রমনীতিতে একজন অমুসলিম শ্রমিক একজন মুসলিম শ্রমিকের মতই সুযোগ সুবিধা লাভ করবে। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সাঃ) এরশাদ করেছেন,- “সতর্ক থাক সে ব্যক্তি স¤পর্কে, যে ব্যক্তি অমুসলিমদের উপর জুলুম করে অথবা তাদের হক নষ্ট করে অথবা তাদের শক্তির চাইতে বেশি কাজ চাপাতে চেষ্টা করে অথবা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের থেকে কিছু জোরপূর্বক নেয়। আমি কেয়ামতের দিন সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ব”(আবু দাউদ)।
ইসলামী শ্রমনীতির মূলনীতি : স্বয়ং আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, “তোমাদের মধ্যে যদি কোন বিষয়ের মতবিরোধ দেখা দেয় তা আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মোতাবেক মীমাংসা করে নাও”(নিসা : ৫৯)। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহই হলো ইসলামী শ্রমনীতির মূল উৎস। যেখানে মালিক-শ্রমিক উভয়ের প্রতি যার যার অধিকার ও কর্তব্য নিহিত রয়েছে। পরকালীন জবাবদিহিতার ভয়ে এখানে জুলুম ও শোষণের অবকাশ থাকে না। সমাজের সার্বিক কল্যাণে সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে অধিক উৎপাদন, মুনাফার সুষ্ঠু বণ্টন, মালিক- শ্রমিকের অধিকার, কর্তব্য, মর্যাদা ও নিরাপত্তা, কর্ম বণ্টন, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, অভিযোগ, গঠনমূলক সমালোচনা, শ্রমিক সংঘ ইত্যাদি সব কিছুর বিধি বিধান রয়েছে কুরআন-সুন্নাহর জীবন্ত ও সকল যুগের উপযোগী আদর্শে।
পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত শোষণমুক্ত শ্রমনীতি আজ মুসলিম বিশ্বের কোথাও চালু নেই। যার কারণে মেহনতী মানুষ শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়ে নিঃশেষিত হচ্ছে, যা জাতীয় উন্নতিরও অন্তরায়। আধুনিক বিশ্ব শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে মুখরোচক স্লোগান শুনিয়ে যাচ্ছে মাত্র। কিন্তু ইসলামের মহানবী তাঁর নীতি বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। সাথে সাথে বিশ্বনবী (সাঃ) ই সর্বপ্রথম শ্রমিককে উৎপাদনের লভ্যাংশ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি শ্রমিককে মজুরী দান করার পরও তাকে লাভের অংশ দেয়ার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। ইসলামের নির্দেশ, শ্রমিকদের দেশে প্রচলিত রীতি অনুসারে উপযুক্ত আহার্য ও সামর্থ্য অনুসারে কাজের দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)।
দুনিয়াবাসীকে মহানবী হযরত (সাঃ) যে শোষণমুক্ত অর্থনীতি বাস্তবায়িত করে দেখিয়ে গেছেন তা বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলনের জন্য এক সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা। এ নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই পৃথিবীর শোষিত, নির্যাতিত, মেহনতী, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। গোলামী যুগের শ্রমনীতি নয়, একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী মহানবী (সাঃ) প্রদর্শিত শ্রমনীতি বাস্তবায়নে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের এগিয়ে আসা উচিত। একমাত্র মহানবীই (সাঃ) শ্রমজীবী মানুষের অধিকার -এর গ্যারান্টি দিয়ে তা বাস্তবে পরিণত করে দেখিয়েছেন, পৃথিবীর আর কেউ যা পারেনি।
আসুন, মানবরচিত পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কিংবা উভয় নীতির মিশ্রনীতির শোষণ-বঞ্চনা ও গোলামীর জিঞ্জির থেকে দুঃখী শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির পথ রচনা করি বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম -এর শোষণমুক্ত ইসলামী অর্থনীতির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে। [সমাপ্ত]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ