বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নির্বাচনে সেনাবাহিনী

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সারাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। গত সোমবার সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তারা বলেছেন, বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে পরিবেশ বিরাজ করছে তার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। কারণ, একদিকে প্রশাসনে সর্বাত্মক দলীয়করণের কারণে রাতের অন্ধকারে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার আশংকা রয়েছে, অন্যদিকে সব জেনে-বুঝেও নির্বাচন কমিশনকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কমিশন এমনকি ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী আইন ও নির্বাচন কমিশন বিরোধী বক্তব্যের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানাচ্ছে না।
প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়ার জন্য সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। কিছুদিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) জাতীয় নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন করা হতে পারে এবং এ ব্যাপারে কমিশন চিন্তা-ভাবনা করছে বলে মন্তব্য করার সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন ওবায়দুল কাদের। বলেছিলেন, নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন করা হবে কি হবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার একমাত্র ক্ষমতা সরকারের। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ও সিইসি’র কোনো অধিকার বা এখতিয়ার নেই।
মন্ত্রীর এমন মন্তব্য ও আক্রমণাত্মক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেছেন, এর জবাব দেয়ার দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অসম্মানিত করা হলেও এবং পুরো নির্বাচন কমিশনকে ধরে টান দেয়া হলেও কমিশন কোনো জবাবই দেয়নি। এ থেকে মনে হতে পারে যেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথা ও ব্যাখ্যাই সঠিক। অন্যদিকে সত্য হলো, সংবিধানে এবং নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত আইনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সেনা মোতায়েনসহ সকল বিষয়েই নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা ও এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের সময় যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাকে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে কমিশনের ইচ্ছানুসারে চলতে হবে। কমিশনের সকল ইচ্ছা এবং চাহিদা তথা প্রয়োজন পূরণ করতে হবে। কমিশন চাইলে সরকার সেনাবাহিনীকেও মোতায়েন করতে বাধ্য।
গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে আয়োজিত সুজন-এর গোলটেবিল বৈঠকে আরো কয়েক বিশিষ্টজনও বক্তব্য রেখেছেন। তাদের সকলেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে গণতন্ত্রের প্রধান পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, এই প্রধান পূর্বশর্ত বাস্তবায়নের স্বার্থেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে, যাতে ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে এবং নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেন। অতীতের কোনো কোনো নির্বাচনে শতাধিক মানুষের হত্যাকান্ডের তথ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, হত্যা-সন্ত্রাসের পাশাপাশি বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন এবং একদলীয় নির্বাচনের কারণে ভোটার জনগণের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে প্রচন্ড রকমের উদাসিনতার সৃষ্টি হয়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য মোটেই শুভ নয়। এজন্যই উদাসিনতার পরিবর্তে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করা দরকার। আর সেটা সম্ভব কেবল সেনাবাহিনীকে মোতায়েনের মাধ্যমে। অন্যদিকে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দিয়ে যা বলানো হয়েছে তা থেকে মনে হতে পারে, সরকার সম্ভবত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও এখতিয়ার কমানোসহ নির্বাচনী আইনে পরিবর্তন করতে চাচ্ছে। এটা সত্য হলে তার ফলাফল অত্যন্ত অশুভ না হয়ে পারে না। বিশিষ্টজনদের মধ্যে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সজাগ ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী আইনে পরিবর্তন করার কোনো উদ্যোগ না নিতে।
আমরা সুজন আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের বক্তব্য, অভিমত ও পরামর্শগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের প্রশ্নে বেশ কিছুদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। বিএনপিসহ প্রায় সকল দল সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানালেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং তার জোটের সঙ্গীরা মোতায়েনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে দলগুলো এমনকি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও এখতিয়ারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একই কারণে বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকরা উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারেননি।
আমরাও মনে করি, সরকারের উচিত নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান এবং নির্বাচনী আইন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন যদি মনে করে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে তাহলে কমিশনকে সেটাই করতে দেয়া উচিত। বলা দরকার, সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী আইনের সংস্কার করার বা কমিশনের ক্ষমতা ও এখতিয়ার কমানোর কোনো পদক্ষেপকেই জনগণ সমর্থন করবে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ