শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত ৪

৩১ মার্চ, আল জাজিরা : হিন্দু দেবতা রামের জন্ম বার্ষিকী উদযাপনের রাম নবমীর র‌্যালি থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছে। গত রবিবার শুরু হওয়া এই দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত চারজন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজ্যটির কর্মকর্তারা। সহিংসতাপ্রবণ রানীগঞ্জ ও পুরুলিয়া এলাকায় বেশ কিছু বাড়িঘর ও একটি মসজিদের পাশে দোকানপাটে হামলা চালানো হয়েছে। ওই এলাকায় গনজমায়েত নিষিদ্ধ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট সেবা। আটক হয়েছেন একশো জন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে রাজ্য কর্তৃপক্ষ। রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস এই সহিংসতার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় থাকা দল বিজেপির কর্মীদের দায়ী করেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এসব খবর জানিয়েছে।

রাজ্যের কর্মকর্তাদের বরাতে খবরে বলা হয়েছে, রাম নবমীর র‌্যালিতে তলোয়ার ও লাঠি ব্যবহারের পর রবিবার পুরুলিয়ায় একজন নিহত হয়। পর সোমবার রাজধানী কলকাতার নিকটবর্তী শহর কানকিনারায় একজন নিহত হয়। মঙ্গলবার রানীগঞ্জে নিহত হয় অপর একজন। ওইদিনই আসানসোল থেকে ১৬ বছরের এক শিশু নিখোঁজের পরদিন তার মরদেহ পাওয়া যায়। সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু এলাকায় এক সাথে চারজনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সহিংসতাপ্রবণ রানীগঞ্জ ও পুরুলিয়া এলাকায় বেশ কিছু বাড়িঘর ও একটি মসজিদের পাশে দোকানপাটে হামলা চালানো হয়েছে। ওই এলাকায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ তাপস ব্যানার্জি শুক্রবার বলেছেন, হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশ। সহিংসতায় জড়িতদের কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমরা বলতে পারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অপরাধীদের সময়মত শাস্তি দেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত সহিংসতা জড়িত অভিযোগে একশো জনকে আটক করা হয়েছে বলেও তথ্য দেন তিনি। তাপস জানান, আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত আসানসোল ও রানীগঞ্জে গণজমায়েত ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকবে।

এতদিন যেভাবে মিলেমিশে ছিলাম তেমনই থাকতে চাই যা হবার হয়েছে। এবার সামনে তাকানো। হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শহরে শান্তি ফেরানোর প্রয়াস। ঠিক সেই চেষ্টাই শুরু হয়েছে গোষ্ঠী সংঘর্ষে তেতে থাকা আসানসোল, রানিগঞ্জে।

২৬ মার্চ রানিগঞ্জের বড়বাজারে সংঘর্ষের সময় শ’খানেক দোকানে ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছিল। হয়েছিল অগ্নিসংযোগও। সেই অশান্তি দূরে ঠেলে স্বাভাবিক হচ্ছে রানিগঞ্জ। স্বাভাবিক করছেন এলাকার মানুষই।

শুক্রবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ক্ষতিগ্রস্ত দোকান সারানোর কাজ চলছে। কাকা-ভাইপো পবন খেতান, সঞ্জিত খেতানের পুড়ে যাওয়া কাপড়ের দোকান মেরামত করছেন মহম্মদ দানিশ আনসারির নেতৃত্বে পাঁচ যুবক। সঞ্জিতের কথায়, ‘ঘটনার দিন গুড্ডু খানের জুতোর দোকানও পুড়েছিল। কিন্তু, দমকল আসতেই গুড্ডু আমার দোকানে এসে বলেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা পাশে আছি’।

 সেই পাশে থাকার ছবিটাই এ দিন স্পষ্ট। দানিশের সঙ্গে কাজ করছিলেন চৈতন কেওড়া, মহম্মদ আরবাজ। তারা বলে দিলেন, ‘যারা ঝামেলাবাজ, তারা গোলমাল পাকিয়ে চলে গিয়েছে। আমাদের ভিটেমাটি এই শহর। এত দিন যে ভাবে মিলেমিশে ছিলাম, তেমনই থাকতে চাই।’ আর এক জুতোর দোকানের মালিক মহম্মদ আখতার আনসারি বললেন, ‘সবাই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যত দিন দোকান মেরামতি না হচ্ছে, তত দিন তাঁদের দোকানে বসতে বলছেন।’

শান্তি চায় আসানসোলও। আসানসোল বাজারে ১৫ বছর ধরে এক ছাদের তলায় দুই দোকান চালান মহম্মদ উসমান ও ধনপতি রায়। সকালে ফল, বিকেলে তেলেভাজা। সাম্প্রতিক অশান্তি সেই বন্ধুত্বে চিড় ধরাতে পারেনি। দু’জনেই বলছেন, ‘এই দোকান চলছে আমাদের বন্ধুত্বের জন্য।

এখানে পয়সার লেনদেনের জায়গা নেই। ধর্মের বেড়াও নেই।’ যেমন আসানসোলের তালপুকুরিয়া। এখানে পাঁচশো পরিবারের বেশির ভাগই সংখ্যালঘু। স্থানীয় বাসিন্দা রাজেশ প্রসাদ, ইমরান খানরা জানান, একশো বছর ধরে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশি বাস করছে। দুর্গাপুজো বা মহরম সব উৎসবে সবাই সামিল হন।

উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ইমাম নিজে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘প্রতিশোধ নয়, বরং আসানসোলে আমাদের শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।’

গত তিন দিনে আসানসোল অবরুদ্ধ থাকার পর গতকাল শনিবার সকাল থেকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে। সকাল থেকে কিছু কিছু যানবাহন চলাচল শুরু করে। বাজারও খুলছে। তবে শহরজুড়ে চলছে পুলিশি টহল। আসানসোলের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী পাঠাতে চাইলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ আসানসোলের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।

অন্যদিকে, আসানসোলে এখনো জারি রয়েছে ১৪৪ ধারা। এ ছাড়া বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবাও। প্রশাসন সূত্রে বলা হয়েছে, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকবে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত।

আসানসোলের পরিস্থিতি দেখতে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে গতকাল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠি আসানসোল ও রানীগঞ্জ যান। তিনি এলাকা ঘুরে কথা বলেন মানুষের সঙ্গে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে। তারপর তিনি প্রশাসনিক বৈঠক করবেন আসানসোলে। যদিও রাজ্যপাল গত বুধবার আসানসোলে আসতে চাইলেও রাজ্য সরকার নিরাপত্তার কারণে সেদিন আসানসোলে আসতে দেয়নি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ