বৃষ্টি আইনের নাটকীয় জয়ে বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিৎ করলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অনেকটা নাটকীয়ভাবেই আগামী বছরে অনুষ্ঠিতব্য এই বিশ্ব আসরে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিৎ করেছে গেইলারা। একইভাবে সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচে আইরিশদের কাঁদিয়ে ২০১৯ বিশ্বকাপের মূলপর্বে মোহাম্মদ নবী-রশীদ খানের দল আফগানিস্তান খেলবে অগামী বিশ্বকাপ। আমিরাত-ধাক্কায় ১৯৮৩ সালের পর এই প্রথম শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে নেই জিম্বাবুইয়ে, বৃষ্টি আইন ও নাটকীয় জয়ে মান বাঁচিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জিম্বাবুইয়ের রাজধানী হারারেতে অনুষ্ঠিত হলো ২০১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাছাইপর্বের জমজমাট সুপার সিক্স রাউন্ড। আয়োজকদের সঙ্গে যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আরব আমিরাতের মধ্যকার বেশিরভাগ ম্যাচই ছিল রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তায় ভরপুর। সুপার সিক্সে নিজেদের শেষ ম্যাচে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে বৃষ্টি-আইনে স্কটল্যান্ডকে ৫ রানে হারিয়ে নবম দল হিসেবে সবার আগে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের টিকেট নিশ্চিত করে ক্যারিবীয়রা। আর ভাল অবস্থানে থেকেও আসরে সবচেয়ে দুর্বল আরব আমিরাতের কাছে শেষ বলে ফয়সালা হওয়া ম্যাচে ৩ রানের হারে কপাল পোড়ে জিম্বাবুইয়ের। ১৯৮৩ সালের পর বিশ্বকাপে নেই এ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, হিথ স্ট্রিকের উত্তরসূরিরা। অন্যদিকে যে আফগানিস্তান খাদের কিনারায় চলে গিয়েছিল সেই তারাই আয়ারল্যান্ডকে বিদায় করে দশম দল হিসেবে বিশ্বশ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে জায়গা করে নিল।
ক্রিকেট বিশ্বকাপের বাছাইয়ের শিরোপা শেষ পর্যন্ত হাতে তুললো শুরুর সময়ের ফেভারিটরাই। জিম্বাবুইয়েতে পুরো বাছাই পর্বটাই ছিল রোমাঞ্চকর। যেখানে শুরুতে ফেভারিটের তকমা পেলেও আফগানদের পথ চলাটা সুখকর ছিল না। বলতে গেলে ভাগ্যের সহায়তাই তাদের বিশ্বকাপের মূল পর্বের টিকেট এনে দিয়েছে। তবে ফাইনালের লড়াইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আসগর স্টানিকজাইয়ের আফগানিস্তান। হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে টস জিতে আগে ব্যাটিং বেছে নিয়েছিল উইন্ডিজ। ৪৬.৫ ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে মাত্র ২০৪ রান সংগ্রহ করে প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করা দলটি। জবাব দিতে নেমে ৪০.৪ ওভারেই মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায় আফগানরা। বাছাইপর্ব শুরুর আগে প্রস্তুতি ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল আফগানিস্তান। ১৯৭৫ আর ১৯৭৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রথম দুই আসরে শিরোপা জিতে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিজেদের অবিসংবাদিত সেরা দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৮৩ সালে টানা তৃতীয় শিরোপা জেতার খুব কাছে দাঁড়িয়ে তাদের হেরেছিল কপিল দেবের ভারতের কাছে। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই কি না ২০১৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের টিকেটের জন্য এবার বাছাই পর্বে খেলতে হলো।
২০১৭ সালের নির্ধারিত সময়ে আইসিসি ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের সেরা আটে থাকতে ব্যর্থ হওয়ায় এমন লজ্জায় পড়েছে ক্যারিবীয়রা। জিম্বাবুইয়েতে শুরু হওয়া ১০ দল থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপে খেলবে দুটি মাত্র দল। আয়োজক জিম্বাবুইয়ের পাশাপাশি ছিল আফগানিস্তান-আয়ারল্যান্ডের মতো ধুরন্ধর দল। তাই জেসন হোল্ডার-ক্রিস গেইলদের জন্য কাজটা মোটেই সহজ ছিলনা। গেইল-মারলন স্যামুয়েলসের মতো বড় পারফর্মার আছেন বলেই আশাবাদী ছিলেন অধিনায়ক হোল্ডার। কিন্তু তাতেও বেশ বেশ ঘাম ঝরাতে হয়ছে। বৃষ্টি আইনই তাদের বাঁচিয়ে দিল। ক্যারিবীয়দের হয়ে বাছাই খেলেছেন গেইল ও স্যামুয়েলসের মতো তারকা। অধিনায়ক জেসন হোল্ডারের জন্যও এ বড় পাওয়া। ড্যারেন ব্র্যাভো, সুনিল নারিন, আন্দ্রে রাসেল, কাইরেন পোলার্ডের মতো তারকারা তো ঠিকই এ আসর এড়িয়ে গেছেন, তারা পাকিস্তান টি২০ সুপার লীগ পিএসএল নিয়েই ব্যস্ত। হোল্ডার তাই আলাদা প্রশংসাই বরাদ্দ রেখেছেন গেইল, স্যামুয়েলসের জন্য। বাছাই পর্ব পেরোনোর আগেই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন বিশ্বকাপ জয়েরও, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভালোর জন্য, নিজেদের আরেকটা বিশ্বকাপে দেখতে ক্রিস, মারলন আমাদের সঙ্গে এখানে, ওদের প্রশংসা না করে পারছি না। আমরা টি২০তে ভাল করছি। জিতেছি নারীদের বিশ্বকাপ। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড়রাও জিতেছে বিশ্বকাপ। আমার মনে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের আরেকটি বিশ্বকাপ জয়ের সময় এসেছে (ওয়ানডে)! এই ফরম্যাটে দুর্বল হয়ে পড়েছি আমরা, যার দায়টা নিজেদেরই। কিন্তু ইতিহাস বলছে আমরা পর পর দুইবার জিতেছি ওয়ানডে বিশ্বকাপ।’
জানা ছিল আগে থেকেই যে, ইংল্যান্ডের টিকিট পেতে হলে খেলতে হবে এই বাছাই টুর্নামেন্টের ফাইনালে। গ্রুপ ‘এ’তে থাকা আরব আমিরাত, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও পাপুয়া নিউগিনির মুখোমুখি হতে হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ক্রিকেটের দ্বিতীয় সারির এই দলগুলোর বিপক্ষে নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করাটা কঠিন হবে না বলেই বিশ্বাস ছিল ক্যারিবীয় অধিনায়কের, তখন বলেছিলেন, ‘দলটি এখন যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ। মান এবং অভিজ্ঞতা কোন দিকেই কমতি নেই আমাদের। আশা করি আমরা একসঙ্গে হয়েই এ বাধাটা পেরিয়ে ঠিকই নাম লেখাব বিশ্বকাপে।’ যদিও প্রস্তুতি ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে বৃষ্টি আইনে ২৯ রানে হেরে যাওয়াতে বড় ধাক্কাই লেগেছে সেই স্বপ্নে। তবে শেষ পর্যন্ত এই আফগানদেও কাছেই বড় ব্যভধানে হারতে হয়েছে গেইলদের। যদিও এর আগে ফাইনালে উঠে দলটি বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয়। ১৯৮৭ সালে ভারত-পাকিস্তানে যৌথভাবে আয়োজিত বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়ে নেয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের শেষ চারে পৌঁছাতে পারেনি ১৯৯৬ সালে আরও একটি উপমহাদেশ-আয়োজন পর্যন্ত। এরপর ইংল্যান্ডে ১৯৯৯, দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৩ তো বটেই, ২০০৭ সালে নিজেদের মাঠেও বিশ্বকাপের শেষ চারে পৌঁছাতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০১১ ও ২০১৫ সালে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের। সবার কাছে প্রশ্ন ছির একটাই, ‘বস’ গেইল কি পারবেন উইন্ডিজকে টেনে তুলতে? গেইল এবার সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। দুর্বল পারফর্মেন্সের কারণে ওডিআই র্যাংকিংয়ের শীর্ষ আটে জায়াগা করতে না পাওয়ায় এমন করুণ দশায় পড়তে হয়েছে ক্যারিবীয়দের।
টি২০ ফ্র্যাঞ্চাইজির লোভনীয় অর্থ আয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ায় দেশটি হারিয়েছে বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ তারকা ক্রিকেটারকে। তবে ‘ইউনিভার্স বস’ খেতাবধারী ক্রিস গেইল তার ক্যারিয়ারে ২২তম ওডিআই সেঞ্চুরি যুক্ত করার মানষে দলকে এগিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছেন।
জিম্বাবুয়ের এই বাছাইপর্বে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তিনি পাকিস্তান সুপার লীগে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন। যে কারণে সবার দৃষ্টি ছিলগেইলের দিকে। সবাই দেখতে চেয়েছিল ৩৮ বছর বয়সী এই ক্যারিবীয় তারকা পঞ্চমবারের মতো বিশ্ব মঞ্চে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে কি ক্যারিশমা দেখান।
বাছাই পর্বের হট-ফেবারিট আফগানিস্তানে ছিলেন লক্ষ ডলারের লেগ স্পিনার। টিন এইজ লেগ স্পিনার রশিদ খানের নেতৃত্বে বিগত ১২ মাসে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করেছে আফগানিস্তান। যদিও বাছাই পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে অপ্রত্যাশিতভাবে স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে গেছে দলটি। নিয়মিত অধিনায়ক আসগর স্টানিকজাই ইনজুরিতে পড়ায় ১৯ বছর বয়সী এই উদীয়মান তারকা কাঁধে তুলে নিয়েছেন জিম্বাবুয়ে মিশনের শুরুতে আফগান দলের নেতৃত্ব। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্রুততম একশ’ উইকেট সংগ্রহের রেকর্ড বইয়ে নাম লিখিয়েছেন তিনি। মাত্র ৫৫ ম্যাচ খেলেই একশ উইকেটের দেখা পান তিনি। সদস্য সমাপ্ত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগের (আইপিএল) নিলামে এই স্পিনার বিক্রি হয়েছেন ১০ লাখ ৪১ হাজার মার্কিন ডলারে।
এই বোলারকে কিনে নিয়েছে সানরাইজার্স হাদরাবাদ। তার উত্থানের সামনে হুমকির মুখে পড়ে গেছে দ্রুততম উইকেটের সেঞ্চুরি পূরণ করা মিচেল স্টার্কের রেকর্ড। ৫২ ম্যাচ খেলে ১০০ উইকেট সংগ্রহ করে ওই রেকর্ডটি দখলে নিয়েছেন তিনি। এই রেকর্ড় ভেঙে এখন এটি রশিদ খানের দখলে।