শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

অসময়

শাহিমা খানম হেপী : আরো দ্রুত পা চালায় আমেনা। বৃদ্ধা শাশুড়ির কথা মনে পড়ার সাথে সাথে সন্ধ্যার তীব্রতা আরো প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। এদিকে ছেলেটা শান্তি দিচ্ছে না মোটেও। কোল থেকে নেমে যাওয়ার জন্য রীতিমত যুদ্ধ জুড়ে দিয়েছে ম’ার সাথে। আল্লাহর কৃপায় আর মুরব্বীগণের দোআয় আমেনার ছেলের মাশাআল্লাহ শরীর স্বাস্থ্য বেশ ভাল। রাজপুত্রের মত না হলেও এ ছেলে যে শ্যামবর্ণের একহারা গড়নের আমেনার, তা ছেলেকে দেখে কেউ বলবে না। একবার তো বাসায় কাজ করতে গিয়ে নাদুস-নুদুস ছেলে নিয়ে রীতিমত বিপদে পড়তে হয়েছিল তাকে। সে কথা মনে হলে আজও সারা শরীর ঘেমে নেয়ে ওঠে। বাড়িওয়ালী আমেনার কোলের ছেলের দিকে প্রথম থেকেই আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন বারবার। আমেনার সেটা চোখে পড়ে। কিন্তু ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয় তখন, যখন ভদ্র মহিলা কাজের কথায় না গিয়ে কেবল ছেলের প্রসঙ্গে টানা-জেরা শুরু করেন। আমেনা অনেক কষ্টে সেবার রেহাই পায়। আজকাল কিছুই বলা যায় না। কখন কোন কারণে বিপদে জড়িয়ে পড়ে মানুষ। সেকথা মনে করে হেসে ওঠে আমেনা। ইস্্ ছেলে কুস্তি থামায়নি এখনও। তাছাড়া এতক্ষণ একটানা কোলে নিয়ে সে নিজেও রীতিমত হাঁপিয়ে ওঠেছে। শেষ পর্যন্ত কোল থেকে নামিয়ে দেয়। হায়রে কপাল। নেমেই সোজা সামনের দিকে দৌড় ছুটায় আড়াই বছরের রাসু। সামনে গলিটা মোড় নেয়ায় ছেলেটা চোখের পলকে আমেনার দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়। আমেনা ত্রস্ত পায়ে সামনে এগোয়। রাত তখন পুরোপুরি দিনের চেহারা গ্রাস করে ফেলেছে। আমেনা কিছুই ঠাহর করতে পারে না। বিদ্যুৎ না থাকায় পুরো রাস্তা জুড়ে কোথাও একফোঁটা আলো নেই। ওদিকে ছোট্ট গলিটা দিয়ে মাঝে মধ্যে দু’একটা রিকশা ভুস করে চলে যাচ্ছে। ঠিক তখন আমেনা ছেলের তীক্ষ্ণ স্বরের কান্না শুনতে পায়। আমেনার ভীরু হৃদয়ে আতঙ্কের ডঙ্কা তখন পুরোমাত্রায় বেজে ওঠে। পা দু’খানি প্রচণ্ড ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়। কোনমতে সামনে ছুটে যায়। ওইতো কিসের ক্ষীণ আলোতে রাসুকে দেখাযাচ্ছে। উবু হয়ে ডান পা ধরে কাঁদছে। ‘কি হল বাপ’ বলে ছেলেকে ঝাপটে ধরে। যেখানে হাত দিয়ে ধরেছিল সে জায়গাটা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আমেনা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
‘আজ এমন ক্যান অইতাছে? ওরে বাপ ক্যান কোল থো নামলি? অহন কি করি আমি?’ আল্লাহর কি মেহেরবানি। হঠাৎ দেয়াল ঘেঁষে কিছু পরিচিত বনজ পাতার সাক্ষাৎ পায় আমেনা। হাতড়ে হাতড়ে কয়েকটা ছিঁড়ে হাত দিয়ে কচলে শাড়ির আঁচল ছিড়ে কাটা জায়গাটা ভাল করে বেঁধে দেয়। রক্ত পড়া বন্ধ হবে এবার। এ চিকিৎসা সে তার শাশুড়ির কাছে শিখেছে। যখন বিয়ে হয়ে আমেনা স্বামীর ঘরে আসে কতইবা বয়েস হবে তখন। অই শাশুড়িই তাকে নিজ হাতে সব কাজ কাম শিখিয়েছেন। আর আজ বেচারী চোখে দেখতে পায় না ভালমত, হাঁটতে ফিরতেও পারে না। একমাত্র ছেলের অল্প বয়সে মৃত্যু তার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। শাশুড়ির কথা মনে আসতেই আমেনা দ্রুত পা চালায়। ইস্্ কি যে করছে বেচারী। ঘরে তো একফোঁটা আলো জ্বালাবার কেউ নেই। এতক্ষণে মনে আসে কেরোসিন ফুরিয়ে গেছে। আমেনা একটু থেমে সামনের মোড়ের দোকানটাতে যায়। এক পোয়া কেরোসিন কিনে নেয়। রাসু মনে করিয়ে দেয়, ‘দাদুর লাগি কিনতাছো মা?’
আমেনা মাথা নাড়িয়ে জোরে হাঁটা শুরু করে। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে গাছের কাটা একটা গুঁড়ির সাথে সজোরে ধাক্কা খায়। ব্যথায় নিজের অজান্তেই কঁকিয়ে ওঠে। না, আর এবড়ো থেবড়ো হাঁটা  চলবে না। সাবধানে পা ফেলতে হবে। মায়ের ব্যথার জায়গাটা রাসু কচি হাতে বুলিয়ে দেয়। বড়দের মতোন প্রবোধ দেয়, ‘কেঁদো না মা, কইম্যা যাইব’। এত কষ্টেও আমেনার ছোট্ট বুকটা তৃপ্তিতে ভরে যায়। আর কেউতো নেই এ দুনিয়ায় তার; তার আল্লাহ তারে এই ছেলে দান করেছেন। যদি বড় হয়, মানুষ হয়। ছেলে যাতে টের না পায় এমন সাবধানে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। এমন সময় রাসু ওর ব্যথার জায়গাটা ধরেই জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে সামনে দেখায়- ‘এ্যামা, সামনে দ্যাখ, কি সোন্দর!’ আমেনা সদ্য আঘাত পাওয়া জায়গায় আবার ব্যথা পেয়ে ছেলেকে বকতে গিয়েও থমকে যায়। আরে সামনে এতো আলো কিসের? ঠিক বুঝা যায় না। তবে পুরো রাস্তা আর আশপাশের দালান বাড়িগুলো ফকফকা আলোয় আলোকিত। রাস্তাঘাট দিনের আলোর মতই পরিষ্কার। অবাক চোখে পর্যবেক্ষণ করছে রাসুর অনুসন্ধিৎসু মন। সেই সাথে পা দুটো দিয়ে অল্প অল্প শক্তি খাটাচ্ছে নেমে যাবার জন্য। আমেনা হালকা ধমক দিয়ে নিরস্ত করে ছেলেকে। সামনেই আরেকটা মোড়ে বিভক্ত হয়েছে গলিটা। আর কিছুদূর হাঁটলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। রাসু আবারও আধো গলায় বলে ওঠে, ‘এ্যাই মা, তাড়াতাড়ি চল্্, কি সোন্দর। শেষ পর্যন্ত আলোর ধারার সন্ধান পায় মা-ছেলে। একটা জমকালো বিয়েবাড়ি। লাল-নীল আলোর তিড়িংবিড়িং নাচন পুরো বিল্ডিং জুড়ে চলছে। অবুঝ রাসুর আর বুঝি তর সয় না, লাফ দিয়ে মায়ের কোল থেকে নেমে পড়ে সে। আমেনা পেছন থেকে ঝাপটে ধরতে গিয়েও পারে না। বড় গাড়ি বারান্দার একপাশে গিয়ে বসে পড়ে ক্লান্ত ছেলেটা। আমেনাও ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বড় বড় গাড়ি আসছে আর জমকালো সাজগোজ করা মেয়েছেলের দল গাড়ি হতে নেমেই উঁচু দালানটাতে হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের হৈ-হুল্লোড় আর হাসি আনন্দে চারপাশটা আরো বেশি জমকালো লাগছে আমেনার কাছে। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে যায়। হঠাৎ বিকট আকারের একটা মাইক্রো ভুস করে ঢুকে গেটের ভেতর। দাঁড়াবে তো দাঁড়াবি একদম মা ছেলের একহাত পাশে এমনভাবে দাঁড়ালো, আর একটু হলেই দুজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতো ধাক্কা লেগে। আমেনার ঠিক মুখের উপর হেডলাইট জ্বলে ওঠায় সে দ্রুত মাথার কাপড় ঠিক করে নেয়। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে এবার ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে জোর কদমে হাঁটা শুরু করে। না, আর কিছুই তাকে থামাতে পারবে না। এবার। ইস্, কেন যেন এত দেরী হয়ে যাচ্ছে আজ। ব্যাপারটা কেমন যেন অশুভ মনে হয় আমেনার কাছে। আর ভাল লাগে না আমেনার। এতদূরে বাসায় গিয়ে কাজ করে কেন পোষাবে তার। কিন্তু কি করা। আজকালকার মানুষগুলো তো সব মানুষ নেই আর। কেউ কেউ হিংস্র জানোয়ারের চাইতে বদ। আমেনা এই ক’বছরে ঢাকা শহরে থেকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তা। মানুষের নির্মম ব্যবহার, লোভাতুর দৃষ্টি আর চরম অবহেলা কোনকিছুই আজ আর চিনতে ভুল করে না সে। এখন যে বাসায় কাজ করে তার খোঁজ দিয়েছে করিমন বুয়া। করিমন বুয়াইতো এত্ত বড় শহরে আমেনার একমাত্র সুখ-দুঃখের সঙ্গী। রাসুর বাপের দূর সম্পর্কের ফুপাতো বোন লাগে সে। রাসুর বাপ মরার পর থেকে ওর শাশুড়ি আর সে তাকে কতভাবে যে সাহায্য করে আসছে, তার হিসেব নেই। আমেনার অল্প বয়স আর মন-মানসিকতা ভেবেই এই বাড়ির কাজটা ধরিয়ে দিয়েছে। বস্তি থেকে দূরে হলেও খালাম্মা বেশ ভাল মানুষ। নামায-কালাম পড়েন। কাজের মানুষকে মানুষ মনে করেন। আমেনাকে তো রাত-দিনের বান্ধা কাজ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অন্ধ শাশুড়ির কথা চিন্তা করেই তো বস্তিটা ছাড়েনি। রাসুকে তো খালাম্মা আপন নাতির মতই মনে করেন। ওর পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
এতসব দিক চিন্তা করেই আমেনা খালাম্মার বাসায় এসে কাজ করে। বৃদ্ধা শাশুড়িকে একা ফেলে এতক্ষণ থাকতে মন চায় না তার। তা সত্ত্বেও কাজটা হাতছাড়া করতে চায় না সে। তাছাড়া দীর্ঘদিন কাজ করে কেমন একটা মায়ার জালে আটকে পড়েছে সে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত আমেনা বস্তির জীর্ণ উঠোনে পা রাখে। ঘরের দুয়ারের দিকে তাকাতেই বুকটা ধরাস করে ওঠে আমেনার। কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। একরত্তি আলোর রেখা নেই কোথাও। ছেলেকে দুয়ারে দাঁড় করিয়ে পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকে সে। কোন সাড়া শব্দ নেই। ব্যাপার কি। রাসুর দাদী কোথায় গেল? করিমন বুয়া তো ৯টার আগে ঘরে ফেরে না। আজ কিভাবে কিভাবে যেন আমেনার ঘন্টা দেড়েক সময় দেরী হয়ে গেল। হঠাৎ চিকন স্বরে কাতরানোর শব্দ আমেনার ভাবনাকে থামিয়ে দিল। ভীরু হৃদয় আতঙ্কে চিরদিনের জন্য থেমে যেতে চায়। কাঁপা গলায় ডাক দেয়, ‘মাইজিগো আপনে কনে? আপনে কনে মাইজি?’ এদিকে অন্ধকারে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠে রাসু।
আমেনার কানে ছেলের কান্না প্রবেশ করে না। আরেকটু এগুতেই বৃদ্ধার মাটিতে পড়ে থাকা শরীরের সাথে ধাক্কা খায়। ‘মাইজিগো কি অইছে আপনের?’ বলতে বলতে আমেনার নগ্ন পা দুটো পিছল কোন কিছুর স্পর্শ পায়। আমেনা বোবার মতন হাতড়ে হাতড়ে কুপিটা ধরায়। সম্মোহিতের মতই শাশুড়ির মুখের কাছে ধরে। আধবোঝা চোখের চাহনিতে কিছুই বোঝা যায় না। ঠোঁট দুটো ফাঁক করে কিছু বলার চেষ্টা করে বৃদ্ধা। বলতে না পেরে দুর্বল হাত দিয়ে পায়ের দিকে ইশারা করে। কুপি পায়ের কাছে ধরতেই সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায়। চৌকির একপাশে রাখা বটিটা বৃদ্ধা শাশুড়ির ডান পা টা কেটে ফালা ফালা করে ফেলেছে। সেখান থেকে রক্ত ঝরে পুরো ঘরের বিরাট অংশ ছেয়ে ফেলেছে।
রক্ত পড়তে পড়তে বৃদ্ধার দুর্বল শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। আমেনা বুঝতে পারে, হয়তো অন্ধকারে প্রস্রাব করতে নামতে চেয়েছিল, বটির সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে এই অবস্থা। অসহায় আমেনা দরজায় দাঁড়ানো ছেলের দিকে তাকায়। এই অন্ধকারেও সে রাসুর হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখা লাল-নীল বাত্তির ভাঙ্গা টুকরোটা দেখতে পায়।
লেখক : (গল্পকার ও প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কমার্স কলেজ) 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ