বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে

 # রাষ্ট্রীয় শোক পালন আজ দোয়া ও প্রার্থনা

# মায়ের জন্য কাঁদে ছোট্ট শিশু ইনায়া 

# ট্রমায় ভুগছে শাহরিন আহমেদ,  ঢামেক’এ ভর্তি 

# চিকিৎসক ও  সিআইডির ১১ সদস্যের দল নেপালে

# ১৯ জনের ময়না তদন্ত সম্পন্ন  #

 

কামাল উদ্দিন সুমন : নেপালে বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত কাজ দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী ৩৬৫ দিনের মধ্যে এ ধরনের তদন্ত শেষ করতে হয়। প্রয়োজনে আরও বেশি সময় নেওয়া যেতে পেরে। ফলে এমন নিয়ম নীতির জন্য বিমান বিধ্বস্তের কারণ জানতে লেগে যেতে পারে দীর্ঘ সময়। 

 বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান বলেছেন, নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তদন্তে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে।

গতকাল বৃহস্পতিবার নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী ৩৬৫ দিনের মধ্যে এ ধরনের তদন্ত শেষ করতে হয়। প্রয়োজনে আরও বেশি সময় নেওয়া যেতে পেরে। গত সোমবার কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ৭১ আরোহীর মধ্যে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে চার ক্রুসহ ২৬ জন ছিলেন বাংলাদেশি।

 ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের ওই উড়োজাহাজটি কেন দুর্ঘটনায় পড়ল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে পাইলটের শেষ মুহূর্তের কথোপকথনের একটি রেকর্ড প্রকাশ পেয়েছে, যাতে মনে হয়  রানওয়েতে নামা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়ে থাকতে পারে।

ত্রিভুবন কর্তৃপক্ষ বলেছে, যে দিক দিয়ে বিমানটির রানওয়েতে নামার কথা ছিল, পাইলট নেমেছেন তার উল্টো দিক দিয়ে। অন্যদিকে ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ এ দুর্ঘটনার জন্য ত্রিভুবনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ এনেছে। সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান বলেন, এই তদন্ত  করছে নেপাল। আমাদের টিম তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।

বুধবার পর্যন্ত নিহতদের মধ্যে ১৯ জনের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। বাকিদের ময়নাতদন্তে আরও কয়েক দিন লাগবে। মরদেহ শনাক্ত হলে পর্যায়ক্রমে দেশে আনা হবে। মরদেহ যেন দ্রুত আনা যায়, সেজন্য তারা কাজ করছেন।

এদিকে নেপালে বিমান বিধ্বস্তে নিহতের স্মরণে গতকাল রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয় আজ শুক্রবার সারা দেশে পালন করা হবে দোয়া । 

এদিকে নেপালে ইউএস-বাংলা উড়োজাহাজ (বিএস-২১১) বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ইনায়ার মা কেবিন ক্রু শারমিন আক্তার নিহত হয়েছেন। মায়ের কথা মনে করে  আড়াই বছরের ইনায়া এক ঘর থেকে আরেক ঘরে খুঁজে ফেরে মাকে। ক্ষণে ক্ষণে মায়ের জন্য কাঁদে ছোট্ট শিশুটি। আবার ভুলে গিয়ে বাসার এরওর কোলে চড়ে, কখনো খেলায় মেতে ভুলে থাকে মাকে।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার খবরের পরপরই ইনায়ার দাদি উত্তরায় শারমিনের বাসায় গিয়ে তালাবদ্ধ দেখতে পান। কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না। তখন রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় জিডি করা হয়। পরে পুলিশ ইনায়াকে এক আত্মীয়ের বাসা থেকে উদ্ধার করে দাদির কাছে দেয়।

কেবিন ক্রুর দায়িত্ব পালনের সময় বাসায় গৃহকর্মীর কাছে থাকত ইনায়া। আবার ইনায়াকে নানি বা দাদির বাসায়ও রেখে যেত শারমিন। দুর্ঘটনার দিন বাসায় গৃহকর্মীর কাছেই ছিল সে। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর এক আত্মীয় বাসা থেকে ইনায়াকে নিজের বাসায় নিয়ে যান। ওই দিন শারমিনের স্বামী ভারতে ছিলেন বলে পরিবার থেকে জানানো হচ্ছে।

ইনায়ার চাচি ফাতেমা হোসেন বলেন, ‘আড়াই বছরের বাচ্চা, তেমন কিছু তো বোঝে না। হঠাৎ হঠাৎ মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাঁদতে থাকে। আবার ভুলে যায়।’ ফাতেমা জানান, বাসায় ইনায়াই সবার ছোট। একেকজনের কোলে চড়ে, খেলে সময় কাটায়।

এদিকে নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত  শাহরিন আহমেদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে।

হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টা ৪ মিনিটে ঢাকা মেডিকেলে এসে পৌঁছায়। এসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন এবং ঢামেক বার্ন অ্যান্ড প্লস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন তাকে রিসিভ করেন। এরপর শাহরিনকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।

এর আগে বৃহস্পতিবার নেপালের স্থানীয় সময় দেড়টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়ে বাংলাদেশ সময় বেলা সোয়া তিনটার দিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায় শাহরিন আহমেদকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটি।  দুর্ঘটনায় তার পা ভেঙে যাওয়াসহ শরীরের ৮ থেকে ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে।

বিমান দুর্ঘটনায় আহত রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমরানা কবির হাসির সিটিস্ক্যান করার প্রয়োজন। নেপালের কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (কেএমসি) পাঁচতলার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা চলছে তার। আর ওই হাসপাতালের সিটিস্ক্যান বিভাগটি রয়েছে নিচতলায়।

বৃহস্পতিবার চিকিৎসকেরা বলেন, নিচতলায় সিটিস্ক্যান করতে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই হাসির। তাকে নিয়ে আশঙ্কা কাটছে না। তার শরীরের শতকরা ৭০ ভাগ পুড়ে গেছে, ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে। হাসির স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রকিবুল হাসান ওই দিন ঘটনাস্থলেই মারা যান। হাসির পরিবারের সদস্যেরা জানান, চিকিৎসকেরা অবস্থা একটু স্থিতিশীল বললেই তাকে ভারতে নিয়ে যাবেন তারা।

আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ডা. রেজওয়ানুল হককে বুধবার রাতেই উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে গেছেন তার বাবা মোজাম্মেল হক। একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। তিনি কাঠমান্ডুর ওম হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শেখ রশীদ রুবায়েত কেএমসিতে আছেন। তার অবস্থা কিছুটা ভালো। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া চিকিৎসক দলের সঙ্গে তার চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন পরিবারের সদস্যরা। আহত মো. কবীর হোসেইনের ছেলে হেলাল ইবনে কবির বলেন, তার বাবা পা নাড়াতে পারছেন না। তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

বাকি তিনজন আলমুন নাহার অ্যানি, সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা, মেহেদী হাসান ও মো. শাহীন ব্যাপারী বাংলাদেশে আসতে পারবেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা চাইলে বাড়ি ফিরতে পারেন। তাদের পরিবারের সদস্যরাও অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মেডিকেল টিমের সঙ্গে কথা বলার জন্য।

এদিকে নেপালে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের স্মরণে সারাদেশ গতকাল শোক পালন করেছে। এ উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও শোক দিবস উপলক্ষে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়

জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, ‘আমরা শোকাহত। আমরা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।’ শ্রীলঙ্কাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে শোকদিবস পালন করেছি।’

মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর মোহাম্মাদ রেয়াদ হোসেন বলেন, ‘আমরা সকাল থেকে পতাকা অর্ধনমিত রেখেছি। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় শোক পালন ছাড়াও নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য লাভে আগামীকাল শুক্রবার দোয়া, মোনাজাত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্য দিয়ে গোটা জাতি নিহত ব্যক্তিদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে।

এদিকে নেপালে ইউএস বাংলা উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহতদের ডিএনএ টেস্ট করে লাশ শনাক্ত করতে ১০ দিন লাগবে বলে জানিয়েছেন ডিএনএ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সোহেল আহামেদ। বৃহস্পতিবার কাঠমান্ডুতে পৌঁছানোর পর তিনি এ কথা জানান।

বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল বুধবার টিচিং মেডিকেলের মর্গ দেখে এসে জানান, (নিহত বাংলাদেশিদের মধ্যে) ৮ জন ছাড়া কাউকেই শনাক্ত করার উপায় নেই।

দুর্ঘটনায় যেসব মরদেহ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শনাক্ত করা যাবে না, তাদের প্রত্যেকের ডিএনএ পরীক্ষার পর স্বজনদের কাছে তা হস্তান্তর করা হবে। মরদেহ শনাক্ত করা নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় দুই দেশ এই সিদ্ধান্ত  নিয়েছে।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্ত করতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবে ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। নমুনা সংগ্রহ করতে এরই মধ্যে সিআইডি’র দুই বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা নেপাল গেছেন। এছাড়া নিহতদের স্বজনদেরও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ