শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

স্মার্টফোন আসক্তিতে নেতিবাচক প্রভাবই বেশী

জাফর ইকবাল : বন্ধুবান্ধব মিলে বা নিজের সঙ্গীকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া বা খেতে যাওয়ার স্মৃতিটা স্মরণীয় করে রাখতে চায় সবাই। হাতে থাকা স্মার্টফোনেই তখন ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আড্ডার সময়টাতে দেখা যাচ্ছে সবাই পাশের মানুষের চেয়ে হাতে থাকা স্মার্টফোনের পর্দায়ই নজর বেশি রাখছেন। এমন ঘটনা এখন হরহামেশাই দেখা যায়। মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট-এ শিষ্টাচার বা ভদ্রতা না মানার বিষয়ে ‘মিস ম্যানারস’ নামের কলামের লেখিকা জুডিথ মার্টিন-কে এমন ঘটনার বিষয়ে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। সামনে বন্ধুদের সঙ্গে কোনো আড্ডায় বা প্রিয়জনের সঙ্গে ডেটিংয়ে গেলে কেউ তার নিজের স্মার্টফোনটিতে না তাকিয়ে কতক্ষণ পার করেন তা লক্ষ্য করতে বলা হয় তাকে। জবাবে তিনি বলেন, “যদি এটা হয়ই, তবে তা হতে হবে খাওয়া শেষে।”
“আমি মনে করি না আমার সামনে কেউ এটি করার সাহস পাবে”- যোগ করেন এই সাংবাদিক। তিনি এমনটা বললেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাশের মানুষকে তার মোবাইল ডিভাইসে মনযোগ দেওয়া থেকে দূরে রাখা কষ্টসাধ্য, এক্ষেত্রে কারও ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপের বিষয়টিই চলে আসে।
বর্তমানে প্রচলিত হয়ে ওঠা এই বিষয় নিয়ে কেন এত কথা? মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ডিভাইসগুলোর দিকে আমাদের একটানা এভাবে তাকিয়ে থাকা সামাজিক আর শারীরিক উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানুষের মাথার গড় ভর হচ্ছে ১০ থেকে ১২ পাউন্ড। কেউ যখন ফেইসবুক বা কোনো কিছু দেখার জন্য মাথা ঝুকিয়ে হাতে থাকা মোবাইল ফোনের দিকে তাকাচ্ছেন, তখন ভূমির দিকে আমাদের মাথায় প্রয়োগ হওয়া অভিকর্ষজ বল আর ঘাড়ের উপর পড়া চাপ ৬০ পাউন্ড পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। টেক্সট বা কিছু দেখার জন্য ঘাড় বাঁকিয়ে মাথা ঝুকিয়ে তাকানোর অবস্থাটাকে বলা হয় ‘টেক্সট নেক’। এটি এখন স্বাস্থ্যগত সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আর এই সমস্যায় ভুগছেন এমন মানুষের সংখ্যাও অসংখ্য। এক্ষেত্রে যেভাবে মাথাটা ঝোকানো হয় তার অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিও রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিকিৎসাখাতে মেরুদ-বিষয়ক গবেষণা প্রকাশক দ্য স্পাইন জার্নাল-এ ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন-এর তথ্যমতে, চালচলন আর অঙ্গভঙ্গি মানুষের মনের অবস্থা, আচরণ আর স্মৃতিতে প্রভাব ফেলে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। অধিকাংশ সময় মাথা ঝুকিয়ে থাকা মানুষের মন বিষন্ন করে তুলতে পারে। আমরা যেভাবে দাঁড়াই তা আমাদের হাঁড় ও মাংসের গঠনে দরকার হওয়া শক্তির পরিমাণ থেকে শুরু করে আমাদের ফুসফুস যে পরিমাণ অক্সিজেন নিতে পারে তা পর্যন্ত সবকিছুতে প্রভাব রাখে।
এই সমস্যার প্রতিকার কী? একদমই সহজ, আর তা হচ্ছে বসে থাকা।  অ্যামি কাডি’র মতো সামাজিক মনোবিদরা দাবি করছেন, আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও তা মস্তিষ্কে কোরটিসোল আর টেস্টোসটেরোন হরমোন প্রভাব বাড়িয়ে দেয় যা উপরের সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে পারে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে মনোযোগের অভাবে সৃষ্ট অন্ধত্ব। ৭৫ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করেন কয়েকজন মিলে একসঙ্গে আড্ডার মুহূর্তে তাদের স্মার্টফোন ব্যবহার আড্ডায় মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতায় কোনো প্রভাব ফেলে না, এ তথ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার-এর। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, এক তৃতীয়াংশ মার্কিনি বিশ্বাস করেন সামাজিক আড্ডায় ফোনের ব্যবহার আসলে আলাপচারিতায় নতুন বিষয়ের আলাপ তৈরি করে। কিন্তু আসলেই কি তাই? এ প্রশ্নের জবাবে শিষ্টাচার বিশেষজ্ঞ আর সামাজিক বিজ্ঞানীরা একজোট, সবারই উত্তর ‘না’।
সবসময় স্মার্টফোন চালু রেখে তা ব্যবহার করতে থাকার এই আচরণ আমাদেরকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর স্বাস্থ্যগত প্রভাব ছাড়াও, যদি আমরা মাথা ঝুকিয়ে রাখি আমাদের যোগাযোগ দক্ষতা আর ভদ্রতাও কমে যায়।  নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি’র মনোবিদ্যা অধ্যাপক নিওবে ওয়ে বলেন, “কোনোভাবে আমরা ভাবি এই অসামাজিক আচরণ আমাদের উপর কোনো প্রভাব ফেলছে না।” কম বয়সীদের মানসিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা ওয়ে বলেন, এই মাথা ঝোকানো অবস্থা আমাদেরকে বর্তমান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, আমরা যাদের সঙ্গে থাকি না কেন। আর এটি শুধু তরুণদের সমস্যাই নয়। এটি মজ্জাগত, অনুকরণ করা, আর অধিকাংশ সময়ই তা বড়দের কাছ থেকে। যখন শিশুরা দেখে তাদের মা-বাবা মাথা ঝুকিয়ে আছে, তারা বিষয়টি অনুকরণ করে।   
এই অধ্যাপক বলেন, “অনেক বেশি যা হচ্ছে তা হলো আমরা আমাদের শিশুদের সঙ্গে কথা বলছি না। তারা যখন কমবয়সী তখন তাদের সামনে প্রযুক্তি রাখছি আর আমরা বড়রা আমাদের প্রযুক্তিপণ্যগুলো নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকছি।” “আপনি এটি দেখে থাকবেন: ভাবুন কিছু মা-বাবা তাদের চিৎকার করতে থাকা শিশুদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করছেন।- ‘এই যে, তোমার আইফোন নাও আর যাও।’ তা না করে চলুন এভাবে কথা বলি- ‘তোমার কী নিয়ে সমস্যা হচ্ছে’। আমরা মনে করি, ‘কোনোভাবে আমাদের শিশুরা জানবে কোনটা ভালো আর খারাপ যোগাযোগ। তাদের মধ্যে সহমর্মিতা থাকবে’। কিন্তু আমি যখন আমার ছেলের ঘরে যাই, সেখানে দেখি সাতজন কিশোর তাদের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে, তাদের মধ্যে কেউই কোনো কথা বলছে না, এমন সব ধরনের অসংশ্লিষ্টতা ঘটছে। ফেইসবুকটাই সব সমস্যা নয়, আমরা কীভাবে ফেইসবুক ব্যবহার করছি সেটাই সমস্যা। 
এই সমস্যায় সব বয়সীরাই আক্রান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে। ২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, আট থেকে ১৮ বছর বয়সীরা দিনের সাড়ে সাত ঘণ্টারও বেশি সময় এ ধরনের মাধ্যমে ব্যয় করছে। ২০১৫ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টার এক প্রতিবেদনে জানায়, ২৪ শতাংশ কিশোর ‘প্রায় সবসময়’ অনলাইন থাকে। বয়স্করা যে ভালো অবস্থায় আছেন তাও নয়। অধিকাংশ বয়স্ক ব্যক্তি দিনের ১০ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় এ ধরনের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ব্যয় করেন, ২০১৭ সালে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিলসন-এর টোটাল অডিয়েন্স রিপোর্ট নামের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেইফটি কাউন্সিল-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, চালকের মোবাইলফোন ব্যবহার মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানোর চেয়ে বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকি রাখে। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর ১৬ লাখ দুর্ঘটনা হয়, যেখানে অধিকাংশ সময়ই চালক ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী। যুক্তরাষ্ট্রের মোট দুর্ঘটনার এক চতুর্থাংশের জন্যই দায়ী টেক্সটিং।
সমাজ বিজ্ঞানী শেরি টারকল তার বই ‘অ্যালোন টুগেদার: হোয়াই উই এক্সপেক্ট মোর ফ্রম টেকনোলজি অ্যান্ড লেস ফ্রম ইচ আদার’-এ ৩০ বছরের পারিবারিক যোগাযোগ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশ্লেষণ থেকে তিনি বুঝতে পারেন, শিশুরা এখন মা-বাবার মনোযোগ পেতে তাদের ডিভাইসগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে। এর ফলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাউকে ফোন করতে বা সামনাসামনি যোগাযোগে ভয় পায় এমন এক প্রজন্ম তৈরি হতে যাচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট শন পার্কার সম্প্রতি বলেছেন, এই প্লাটফর্ম আসক্তিপূর্ণ করে বানানো হয়েছে। নিজের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার সময় তার কোনো ধারণা ছিল না যে তিনি কী করছেন। পার্কার বলেন, “শুধু সৃষ্টিকর্তা জানেন যে, এটি আমাদের শিশুদের মস্তিষ্কের সঙ্গে কী করছে?”“ফেইসবুক এমন প্রথম অ্যাপ্লিকেশন, যে অ্যাপ্লিকেশনগুলো বানানোর পেছনে পুরো চিন্তাধারা ছিল যে, ‘আমরা কীভাবে আপনার যতটা বেশি সম্ভব সময় ব্যয় করবো এবং সচেতন মনোযোগ আকর্ষণ করবো। এর মানে হলো, প্রতিটা সময় আপনাকে এমন কিছু দিতে হবে যাতে আপনি নজর দেবেন, কারণ আপনি ছবি বা পোস্টে লাইক, কমেন্ট করেন। এবং এতে আপনি নিজেও আরও বেশি কনটেন্ট শেয়ার করবেন। আর সেগুলো আরও বেশি লাইক কমেন্ট পাবে,” যোগ করেন পার্কার।
পার্কার আরও বলেন, “যখন ফেইসবুক চলছিল তখন আমাদের এমন মানুষ ছিল যারা আমার কাছে এসে হয়তো বলবে যে ‘আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেই।’ এবং আমি হয়তো বলবো, ঠিক আছে। আপনি জানেন আপনি আসবেন। আমি জানি না আমি কী সত্যি বুঝেছিলাম কিনা যে- আমি যা বলছিলাম তার প্রভাব কী হতে পারে। কারণ একশ’ বা দুইশ’ কোটির একটি নেটওয়ার্ক একটি অনিচ্ছাকৃত প্রভাব ফেলে। এটি সত্যি সমাজ এবং অন্যান্যদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক বদলে দেয়।”
খুব বেশি সময় ব্যয় হওয়ায় তিনি নিজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন না বলে জানিয়েছেন পার্কার। আর কিছুটা মজা করে তিনি বলেন, “এখনও আমার ফেইসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট আছে। যদি মার্ক এটি শোনে সম্ভবত সে আমার অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেবে। আমি এই প্লাটফর্মগুলো ব্যবহার করি, প্লাটফর্মগুলোকে আমাকে ব্যবহার করতে দেই না।”
এক্ষেত্রে অনেক আসক্তির মতো সমস্যাটা স্বীকার করাই চিকিৎসার প্রথম ধাপ আর এর সমাধান প্রযুক্তিবিরোধী নয়, সমাধান হচ্ছে আলাপচারিতার পক্ষে- এমনটাই বলেন টারকল। বাস্তবিক অর্থে এই সমস্যার কোনো সাদাকালো সহজ সমাধান নেই। এক্ষেত্রে অন্যদের দিকে লক্ষ্য করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। চলার সময় কোথাও লালবাতি দেখে থামার পর আশপাশে একটু তাকিয়ে দেখা যেতে পারে কারা আছেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ শিষ্টাচার বিষয়ে মাসিক কলাম লেখক আলফোর্ড-এর মতে, ফোনের চেয়ে কারও সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে কম প্রাধান্য দেওয়া প্রচলিত নিয়মে কিছুটা আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় দেয়। তিনি বলেন, “কোনো আড্ডায় বা কারও সঙ্গে অবস্থানকালে আপনি সবার আগে ফোন ব্যবহার শুরু করবেন না। ধৈর্য্য শূন্যে নিয়ে আসবেন না।”

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ