শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

প্রশ্নপত্র ফাঁসের মহামারি ও নোট গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : বিশ্বসমাজ যতই অগ্রসর হচ্ছে, মানসম্মত শিক্ষার প্রয়োজন ততই বাড়ছে। মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে বিধায় বিষয়টি আমলে নিয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বিভিন্ন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সাফল্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। কেন সফল হচ্ছে না, সমস্যা কোথায়- সেসব চিহ্নিত করে কীভাবে সমাধান করে অগ্রসর হওয়া যায়, গণমাধ্যম তা বাতলে দিতে পারে। গণমাধ্যমের স্বাভাবিক দর্শন অনুসারে সমাজের অসংগতি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব গণমাধ্যমের। সুতরাং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে গণমাধ্যম অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।
গণমাধ্যম সময়ের দর্পণ, সমাজের দর্পণ। দেশের সামগ্রিক শিক্ষা কাঠামো সমাজের মূল কাঠামোরই অংশ। সার্বিক বিচারে একটি সমাজ গঠনে শিক্ষা-সংস্কৃতির ভূমিকা অন্যতম। শিক্ষা-সংস্কৃতি মানুষের ব্যক্তিগত আচরণে প্রভাব ফেলে, প্রভাব ফেলে সামাজিক কর্মকাণ্ডে, যা মানুষের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়। মানুষের কর্মব্যস্ততা যতই বাড়ছে, গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা ততই বাড়ছে। শিক্ষা মানুষের মনে জানার আগ্রহ বাড়ায়; গণমাধ্যম তথ্য সরবরাহ করে। আরও পরিষ্কার করে বললে, গণমাধ্যম তথ্য সরবরাহ বা খবর পরিবেশন করে মানুষের জানার আগ্রহকে কার্যকর করে।
পরীক্ষা পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ, বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস মহামারি আকার ধারণ, শিক্ষাক্রম সংকট, পাঠ্যবই দুর্বোধ্য, নোট-গাইডবইয়ের দৌরাত্ম্য ভয়াবহ। এসব অশুভ আবর্ত থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করা না গেলে দিন দিন শিক্ষার মানের অবনতি ঘটবে। গণমাধ্যম এ বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাপক জনমত তৈরি করলে এক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, এটা নিশ্চিত।
নিজের প্রয়োজনে মানুষ বিভিন্ন আদলের গণমাধ্যমে নজর দেয়। গণমাধ্যমের চোখে মানুষ সমাজকে দেখে, দেশকে দেখে, বিশ্বকে দেখে। এখন বিশ্বজুড়ে তা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কারণ গণমাধ্যমের কাজ মানুুষ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, সমাজকে ঘিরে আবর্তিত শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়ে। এককথায় জীবন এবং জগতের সবকিছুই গণমাধ্যম তথা সংবাদ মাধ্যমের আলেখ্য। সত্য প্রকাশের অদম্য সাহসই গণমাধ্যমের অপ্রতিরোধ্য শক্তি, অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই শক্তিই আমাদের আকৃষ্ট করে, প্রভাবিত করে। আদিকাল থেকেই মানুষ নিজের আগ্রহের বিষয়ে তথ্য জানতে চায়, বিভিন্ন খবর জানতে চায়। শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ আছে। কারণ শিক্ষা মানুষকে সমৃদ্ধ করে এবং এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।
গণমাধ্যম সমাজের অসংগতি, বৈষম্য, অনিয়ম, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যচার, অধিকার হরণ জনসমক্ষে তুলে ধরে ন্যায়ের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে। কখনও কখনও সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে গণমাধ্যমকে সমাজের শক্তিধর কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বদনজরে পড়তে হয়; সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য গণমাধ্যমকে লড়াই করতে হয়। গণমাধ্যম জনগণের মাধ্যম। গণমাধ্যমকে নিজ বৈশিষ্ট্য মেনে কাজ করতে দেওয়াই পরিচালনাকারীদের অন্যতম দায়িত্ব। গণমাধ্যম নিজ বৈশিষ্ট্য হারালে গণমানুষের গ্রহণযোগ্যতাও হারায়।
গণমাধ্যমের কাজ শুধু সংবাদ পরিবেশনই নয়, তার চেয়েও বেশি। মানুষ গণমাধ্যমের কাছেই পেতে চায় সংবাদের বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ এবং নির্দেশনা। যথাযথ বিশ্লেষণই বলে দেয় বিষয়ের গতিপ্রকৃতি এবং ভবিষ্যৎ। এখন নানাবিধ কারণে গণমাধ্যমের ওপর সমাজের নির্ভরতা অনেক বেশি। সুতরাং এখন গণমাধ্যমের প্রভাবও বেশি। এ প্রভাবটাই গণমাধ্যমের মূলশক্তি, সমাজ বদলের হাতিয়ার। সংবাদ মাধ্যম সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তাবাহক।
গণমাধ্যমের নিজস্ব একটা শক্তি আছে। শিক্ষারও একটা নিজস্ব শক্তি আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষা এবং গণমাধ্যমের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত গণমাধ্যম এবং শিক্ষার অন্তর্নিহিত শক্তি সুপ্ত থাকে। কার্যক্ষেত্রে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যম ও শিক্ষার শক্তির সঞ্চার হয়। তাই গণমাধ্যমকে কীভাবে ব্যবহার করব, শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে কীভাবে ব্যবহার করব, কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করব, শিক্ষাবিস্তারে কীভাবে ব্যবহার করবÑ তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এখন পর্যন্ত আমাদের সমাজের একটা বিরাট অংশ শুধু প্রাথমিক শিক্ষাকে পুঁজি করেই কর্মজীবনে প্রবেশ করে।
শিক্ষা মানে মানসম্মত শিক্ষা। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বা চলমান শিক্ষাধারায় এমনটা এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আবার আমরা সবার জন্য শিক্ষার কথা বলছি। এটা আমাদের অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকারের সঙ্গে উন্নত সমাজ নির্মাণ এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কযুক্ত। তাই শিক্ষার সঙ্গে মানসম্মত শিক্ষার কথাও জুড়ে দিতে হবে। কারণ মানসম্মত শিক্ষা উন্নয়নের অন্যতম সূচক।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মত হলে শিশুদের শিক্ষার ভিত্তি মজবুত ও টেকসই হয়। ফলে শিক্ষার পরবর্তী স্তরগুলো মানসম্মত করা অনেকাংশে সহজ হয়। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মত- এ কথা বাস্তবে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তাই প্রাথমিক শিক্ষাকে কীভাবে মানসম্মত করা সম্ভব, সে উপায়ই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান এবং কার্যকর গবেষণার মাধ্যমে। কারণ শিক্ষা, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের প্রাণশক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়নের চাবিকাঠি। সবমিলিয়ে এটি একটি জনগুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ জনগণের সাংবিধানিক অধিকার।
গণমাধ্যম গণযোগাযোগের মাধ্যম। মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির চাহিদা পূরণে গণমাধ্যম অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। সুতরাং গণমাধ্যমের সঙ্গে জনমানুষের দৈনন্দিন সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন খবরের সঙ্গে শিক্ষাবিষয়ক নানাবিধ খবরও গণমাধ্যমই জনগণকে অবহিত করে। আমরা মনে করি, মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে গণমাধ্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখন প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্তৃপক্ষ, সমাজের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক, সমাজবিশ্লেষক, লেখক, সাংবাদিক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, অভিভাবক শিক্ষার্থী, শিক্ষাকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে গণমাধ্যম কী ভূমিকা পালন করতে পারে তা নির্ধারণ করা এবং তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও নীতিমালা প্রস্তুত করা, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে বাস্তব ক্ষেত্রে তা প্রয়োগের ব্যবস্থা করা। কারণ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের একটি মৌলিক ও শক্তিশালী পদক্ষেপ।
সমৃদ্ধ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার মানসম্মত শিক্ষা এবং টেকসই মানবসম্পদ উন্নয়ন। এই লক্ষ্যে মানসম্পন্ন একটি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। শিক্ষার মানের বিষয়টি আপেক্ষিক এবং এর কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কেননা ক্রমপরিবর্তনশীল দুনিয়ায় জ্ঞানবিজ্ঞানের পরিসর, সামাজিক চাহিদা জোগান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, সম্প্রসারিত হচ্ছে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই অর্জিত শিক্ষার মানদ- নির্ধারণ এবং তা নির্ধারিত মেয়াদে অর্জন করার মাঝেই শিক্ষার মান ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। তবে এর কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা জ্ঞানার্জন, তথ্য আহরণ ও দক্ষতা লাভের মধ্য দিয়ে অর্জন করা সম্ভব। প্রাকৃতিক, বস্তুগত ও সামাজিক কারণে বিশ্বসামাজ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ সম্পর্কের বন্ধন জ্ঞান ও তথ্য। এর সফল ব্যবহারের হাতিয়ার হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা।
বাংলাদেশে প্রতিটি শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই একমাত্র শৈশবকালীন শিক্ষার স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। লক্ষণীয়, বাংলাদেশের একটা বিরাট জনগোষ্ঠী, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, তাদের পারিবারিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়ার অনুকূল নয়। তবে জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই শিশুশিক্ষার প্রতি আগ্রহী, এককথায় অনুরাগী। তারপরও শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য কি পূরণ হচ্ছে? বাস্তবে পরিলক্ষিত হচ্ছে স্কুল উপযোগী সব শিশু এখনও স্কুলে ভর্তি হয় না অথবা ভর্তি হলেও অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষাচক্র শেষ করে না। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে পিইসি পরীক্ষার জন্য তালিকাভুক্তদের মধ্য থেকে পরীক্ষার প্রথম দিনে অনুপস্থিত ছিল ১ লাখ ছাত্রছাত্রী; ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত পিইসি পরীক্ষায় এসে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮৩-তে। অর্থাৎ তারা প্রাথমিক শিক্ষাচক্র শেষ না করেই ঝরে পড়ল। যে-কোনো কাজে লক্ষ্য অর্জনের অন্তর্নিহিত শক্তি হচ্ছে প্রেরণা। প্রেরণাই জীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রেরণা জোগাতে গণমাধ্যম অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। যে- কোনো গণতান্ত্রিক দেশে গণমাধ্যমের উদ্দেশ্য প্রধানত চারটি- শিক্ষিত করা, বিনোদন দেওয়া, তথ্য প্রচার করা বা পৌঁছে দেয়া এবং প্রভাব বিস্তার করা। এই কাজগুলো সমাধা করার জন্য আমরা গণমাধ্যমকে দু’টি পর্যায়ে ব্যবহার করি। এর একটি ইলেকট্রনিক মাধ্যম এবং অন্যটি মুদ্রিত মাধ্যম। শিক্ষার প্রধান উপকরণ মুদ্রিত বই। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মুদ্রিত বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক মাধ্যমও ব্যবহৃত হয়।
সংবাদপত্র রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও ভৌগোলিক জ্ঞানের প্রসার ঘটায়। আর ইলেকট্রনিক মাধ্যম শব্দ ও চিত্রের চলমান দৃশ্যের অবতারণা করে বিষয়ের যথার্থতাকে উপভোগ্য করে তোলে। বিনোদনের মাধ্যমেও গণমাধ্যম মানসম্মত শিক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। মানুষের চাওয়া শুধু জ্ঞানার্জন কিংবা জ্ঞানার্জনের আনন্দেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। সুতরাং গণমাধ্যমগুলোকে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখতে হবে নিজ দায়িত্বে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ একটি জাতীয় কর্মসূচি। এই কর্মসূচির সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ জড়িত। সে অর্থে আমরা সবাই এ কর্মসূচির শরিক। দেশের কল্যাণে গুণগত মানবসম্পদ উন্নয়নে এ কর্মসূচিতে ব্যয় করা হচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। গণমাধ্যমকে নিজ দায়িত্বে এগিয়ে এসে দেশব্যাপী বাস্তবায়িত কার্যক্রমের সফলতা যেমন তুলে ধরতে হবে, তেমনি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে, এমনকি সমস্যা সমাধানের পথও বাতলে দিতে হবে। গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকাই পারে শিক্ষকদের এবং শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সচেতনতা এবং দায়বদ্ধতা বিষয়ে নিয়ত সজাগ রাখতে। মানসম্মত শিক্ষার কার্যকর দিকগুলো তুলে ধরে বারবার প্রচার চালাতে হবে।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার মানদণ্ড নির্ধারিত হয় সময়োপযোগিতার ওপর ভিত্তি করে। যে- কোনো দেশের প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, অর্জিত শিক্ষার মান এবং প্রান্তিক যোগ্যতা নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমেই অর্জনযোগ্য গুণগত মান নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। এর অর্থ হচ্ছে কী শেখানো হবে, কীভাবে শেখানো হবে এবং কীভাবে অর্জিত শিক্ষার যথাযথ মূল্যায়ান করা হবে, তা নির্ধারণ। এজন্য বাছাইকৃত কিছু প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, তা তত্ত্বাবধান করা। এ তত্ত্বাবধান দু’-ভাবে হতে পারে- অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত বা শিক্ষা প্রশাসনের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের তত্ত্বাবধান। গণমাধ্যম উভয় তত্ত্বাবধানের ফলাফল প্রচার-প্রকাশ করে জনগণকে অবহিত করতে পারে।
গণমাধ্যম যেন গণমাধ্যমের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে সেটা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব স্বয়ং গণমাধ্যমই পালন করে, এমনটাই প্রত্যাশিত। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে সমস্যাটা কোথায়, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতাটা কোথায়, সংশ্লিষ্ট এলাকার অভিভাবকদের অভিযোগ, দাবি, পরামর্শ, মতামত, প্রশ্ন জানার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, গণমাধ্যম যৌথভাবে উদ্যেগ গ্রহণ করতে পারে। এতে কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্তি বাড়বে, বাড়বে গণমাধ্যমের দায়িত্বও। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িতব্য শিক্ষা কর্মসূচির সঙ্গেই সম্পৃক্ত হয়ে যাবে। শ্রেণিকক্ষের মূল চাবিকাঠি শ্রেণিশিক্ষক, শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত পাঠদানে যতœশীল হবেন।
লক্ষ্য, দেশব্যাপী পরিচালিত দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষা কর্মসৃচি সর্বজনীন বাধ্যতামলক প্রাথমিক শিক্ষা সত্যিকার অর্থে গুণগত মানসম্পন্ন করা; গুণগত মানসম্পন্ন মানবসম্পদ উন্নয়নের ভিত মজবুত করা; প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের শ্রেণিভিত্তিক নির্ধারিত সাক্ষরতা দক্ষতা, জীবন দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম করে তোলা; প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ধারাবাহিকতায় শিক্ষার পরবর্তী স্তরের জন্য প্রস্তুত করে তোলা। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে করণীয় হলোÑ
ক. মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণে কোন কোন অনুষঙ্গ কাজ করে, তা চিহ্নিতকরণ এবং তা যথাযথ ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না, অনুসন্ধান করা;
খ. শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, শিক্ষার্থীর উপস্থিতি, পাঠে মনোযোগ ইত্যাদি অনুসন্ধান করা;
গ. শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, সেই সঙ্গে অভিভাবকদের ভূমিকা জনগণকে অবহিতকরণ ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিতকরণ;
ঘ. শ্রেণিকক্ষের পাঠদান শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে সক্ষম হচ্ছে না কেন? দিন দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও কোচিং-নির্ভর হচ্ছে কেন, তা অনুসন্ধান করা;
ঙ. মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে সার্বিকভাবে সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণে গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা আমাদের প্রত্যাশিত;
চ. মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর একটি। ফলে শিক্ষাকে হতে হবে মানসম্পন্ন। শিক্ষা জীবনের অপরিহার্য একটি অংশ। শিক্ষাকে প্রতিনিয়ত আধুনিকায়ন করা হচ্ছে জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে। তাই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখোমুখি করছে। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস; শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কোচিং নির্ভরতা; বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থীর পাস মার্ক অর্জন করতে না পারা; নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস অর্জিত শিক্ষার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এখন সময়ের দাবি, শিক্ষার মানের কোথায় ঘাটতি তা খতিয়ে দেখা।
ঘাটতি বা সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে যারা শিক্ষাগ্রহণ করছে, যারা পাঠ দান করছে, যারা শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিচালনা করছে এবং যারা বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনকারীদের নিয়ে শিক্ষা পরিচালনা করছে তাদের মতামতের ভিত্তিতে, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের ব্যাপারটা শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবহ অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল। তবে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মনঃসংযোগ এবং পেশাগত যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাই মুখ্য। শিক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্তদের কাছে প্রশ্ন- আমাদের বাস্তবায়িতব্য সর্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্পন্ন হতে সমস্যাটা কোথায়?
আমরা জানি, শিক্ষাবিজ্ঞান শিক্ষার নানাবিধ সমস্যা সমাধানে নতুন নতুন পথ দেখায়। কিন্তু মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা মাঝে মধ্যে হলেও গবেষণা খুব একটা হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচির নথিভুক্ত ফলাফলের সঙ্গে বাস্তব শিক্ষাচিত্রের মিল পরিলক্ষিত হয় না, সেটা আজ প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার। তাই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
বাধ্যতামূলক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা কর্মসূচি। যে-কোনো শিক্ষা কর্মসূচির চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেশি। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মেধাবৃত্তি, উপবৃত্তি ইত্যাদি কারণে প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঝরে পড়ার হারও কমছে, পাসের হারও বাড়ছে; কিন্তু অর্জিত শিক্ষার মান বাড়ছে না। এখন আমাদের দরকার অর্জিত শিক্ষার মান বাড়ানো অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা। গণমাধ্যম গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে শক্তিশালী মাধ্যম বিধায় প্রাথমিক শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণেও গণমাধ্যমের সম্পৃক্ততা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, এটাই প্রত্যাশিত। গণমাধ্যম যারা পরিচালনা করে, মানসম্মত শিক্ষা তাদের যেমন দরকার, তেমনি গণমাধ্যমের যারা ব্যবহারকারী, তাদের জন্যও মানসম্মত শিক্ষা দরকার। তাই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এখন সর্বাধিক গুরুত্বের দাবিদার।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষাস্তর পর্যন্ত বিস্তৃত শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে কর্মসূচি প্রণয়নের অন্ত নেই। কিন্তু শিক্ষা কর্মসূচি চাহিদা অনুসারে বাস্তবায়িত হচ্ছে না, স্তরে স্তরে হোঁচট খাচ্ছে। কেন? প্রথমত, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান অপ্রতুল; ফলে শিক্ষা হয়ে পড়ছে কোচিংনির্ভর। পরীক্ষা পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ, বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস মহামারি আকার ধারণ, শিক্ষাক্রম সংকট, পাঠ্যবই দুর্বোধ্য, নোট-গাইডবইয়ের দৌরাত্ম্য ভয়াবহ। এসব অশুভ আবর্ত থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করা না গেলে দিন দিন শিক্ষার মানের অবনতি ঘটবে। গণমাধ্যম এ বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাপক জনমত তৈরি করলে এক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, এটা নিশ্চিত। মূলত আমরা কেউই গণমাধ্যমের প্রভাবমুক্ত নই। গণমাধ্যম যদি নিজেই নিজের কণ্ঠ রোধ না করে, গণমাধ্যম সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। সুতরাং আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন আনয়নে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দরকার গণমাধ্যমের কার্যকর ব্যবহার।
লেখক: মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠানপাড়া (খান বাড়ি), কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ