বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সর্বস্তরে বাংলাভাষা

সর্বস্তরে বাংলাভাষা ইংরেজি Bengali Language in all layers or Bangla language in all tiers. ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা বংশের পূর্বদিকে সবচেয়ে প্রান্তিক ভাষা বাংলা। বর্তমান বাংলাদেশে বাংলা প্রায় একমাত্র এবং ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা ও পশ্চিম বঙ্গে ব্যবহৃত প্রধান ভাষা। বিহার, উড়িষ্যা এবং আসামের কাছাড় জেলায় বহু সংখ্যক বঙ্গভাষী মানুষ বাস করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা যা সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে এবং ১৫৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, বাংলাভাষায় এই সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ ও ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ থাকবে এবং উভয় পাঠ নির্ভরযোগ্য বলে গণপরিষদের স্পিকার সার্টিফিকেট প্রদান করবেন। উহাতে আরো বলা হয়েছে যে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা এবং কয়েকটি বিচ্ছিন্ন উপজাতীয় বসতি ছাড়া দেশের মধ্যে ব্যাপকভাবে বাংলাই ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের সরকারি কাজে প্রধানত বাংলা ব্যবহৃত হলেও বিদেশের কুটনৈতিক যোগাযোগ, বিদেশী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এবং উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে সাধারণত ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দেশের সর্বত্র সাধারণভাবে বাংলা ভাষাই ব্যবহৃত হয়। ১৯৯০ এর দশকে বাংলাদেশ সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার বাধ্যমূলক করা হয়। এটা বিশ্বজনীন স্বীকৃত সত্য যে, জন্মসূত্রে পাওয়া ভাষাই হচ্ছে মনোভাব ব্যক্ত করার কোনো বিষয় রহস্য পূর্ণাঙ্গরূপে অনুধাবনের প্রধান বাহন। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলগণের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ভাষায় আসমানী কিতাব প্রেরণের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন, ১২নং সূরা ইউসুফের ২নং আয়াত, ১৪নং সূরা ইব্রাহীমের ৪নং আয়াত, ৩০নং সূরা রূমের ২২নং আয়াত, ৩৩নং সূরা আহযাবের ২২ থেকে ২৫ আয়াত, ৩৯নং সূরা যুমারের ২৮নং আয়াত, ৪১নং সূরা হামীম সেজদাহ্- এর ৩নং আয়াত, ৪২নং সূরা শুরার ৭নং আয়াত, ৪৩নং সূরা যুখরুফের ৩নং আয়াত এবং ৪৬নং সূরা আহকাফের ১২নং আয়াত। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রথম ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’ ধারণাটির জন্ম হয় এবং এ ধারণাই পরবর্তীতে বিভিন্ন বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং এরও পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং ১৯৪৭ সালে সেপ্টেম্বরে পূর্ব বাংলায় ‘তমুদ্দুন মজলিস’ নামে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তমুদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেম। আর সেই ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বাংলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটা পরতে পরতে প্রত্যক্ষ করা যায়। যার সার্থক ফসল আজকের এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ভাষা সৈনিক অধ্যাপক গোলাম আজমের লিখা ‘আমার দেশ বাংলাদেশ’ বইয়ের ৮নং পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ ক্লাসের ছাত্র থাকা কালে যখন প্রথম এ (ভাষা) আন্দোলনের সূচনা হয়, তখন এর মধ্যে কোনো রাজনৈতিক গন্ধ আমি অনুভব করিনি। তখনকার শাসকগণের পক্ষ থেকে এটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক বলে প্রচার করলেও আমি এটাকে অপপ্রচার মনে করেছি। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কারো থাকুক বা নাই থাকুক এ আন্দোলনের আবেদন ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ও মানবিক।’ উক্ত বইয়ের ৯ ও ১০নং পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জনের ধর্ম ,কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষার দিক দিয়ে আমরা আদর্শগতভাবে মুসলিম জাতি এবং ভৌগোলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশী জাতি। এ দেশের সব ধরনের নাগরিক মিলে আমরা রাজনৈতিক পরিভাষায় বাংলাদেশী নেশান বা জাতি। কিন্তু আদর্শিক মানে আমরা মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত। আমি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য তৃপ্তির সাথে অধ্যয়ন করি। সেখানকার সাহিত্যের প্রতি তাদের সাহিত্য কর্মের মান অনুযায়ী যথারীতি শ্রদ্ধা পোষন করি। ইংরেজি সাহিত্য থেকেও আমি সাহিত্যের সুস্বাদু খোরাক পাই। কিন্তু তাদের সাহিত্য ও ভাষা আমার জাতীয় সাহিত্য বা জাতীয় ভাষা নয়। বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সহজবোধ্য যে ভাষা, তা আমার বাংলা ভাষা। এর নাম যদিও বাংলা ভাষাই, তবুও পশ্চিম বঙ্গের ভাষা থেকে এর পরিচয় ভিন্ন। এ ভাষা বাংলাদেশের বাংলা ভাষা। যেমন, আমেরিকান ইংরেজি ভাষা দেখতে ইংরেজি হলেও ইংল্যান্ডের ইংরেজি ভাষা থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। উক্ত বইয়ের ৩নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ‘জন্মভূমির ভালবাসা মানুষের সহজাত।.........যারা বাধ্য হয়ে বিদেশে অবস্থান করে এবং কোনো কারণে দেশে আসতে অক্ষম হয়, তাদের এ অনুভূতি আরও গভীর হয়। তারা দৈহিকভাবে বিদেশে থাকলেও তাদের মনটা দেশেই পড়ে থাকে। দেশের মানুষ, দেশের গাছপালা, দেশের আবহাওয়া, দেশের ফল-মূল, দেশের পশুপাখি, দেশের মাটি যেমন আপন মনে হয় বিদেশে এসব জিনিস তেমন মনে হতে পারে  না। সাময়িকভাবে বা আংশিকভাবে কোনো দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যতই মনোমুগ্ধকর মনে হোক সামগ্রিকভাবে জন্মভূমিই যে প্রিয়তম এ কথার সাক্ষী আমি নিজে।’ মোঘল আমল, সুলতানি আমলে আটশ বছর ফার্সি ভাষা ছিল আমাদের রাষ্ট্র ভাষা। এরপর ঔপনিবেশিক শাসনে পাই ইংরেজি ভাষা। দেশভাগের পর উর্দুভাষা এবং তা থেকে মুক্ত হবার প্রত্যয়ে ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য রক্ত ঢেলে দিতে হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতার আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। যে ভাষা কে রাষ্ট্র ভাষার মর্যদা দিতে এত আন্দোলন, এত সংগ্রাম সেই বাংলা ভাষার প্রচলন ও প্রবর্তন প্রতিষ্ঠা করতে এখনো সম্পূর্ণ ভাবে পারিনি আমরা। তবে আমরা প্রতি ক্ষেত্রেই অগ্রগামী এটা বলা যায়। বিশেষ করে প্রযুক্তির উন্নয়নের যুগে ইন্টারনেটে বাংলা কী-বোর্ড সংযোজন বাংলা ভাষাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের উচ্চ শিক্ষা যেমন, ডাক্তারী শিক্ষা, কৃষি শিক্ষা, প্রকৌশল শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক কিছুতেই বাংলা ভাষার প্রচলন স্পষ্ঠ দেখা যায়নি কিন্তু আগের তুলনায় বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে বলে অনেকেরই ধারনা। ভাষার মাসে বাংলা বিহীন সাইন বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট। তিনি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এমন অভিযান চালান। সে দিন সংসদ ভবন সংলগ্ন আসাদ গেট এলাকায় সাইন বোর্ড বাংলায় না লেখায় ডিএসসিসির অভিযান পরিচালিত হয়। এলাকার যেসব প্রতিষ্ঠানের (দূতাবাস, বিদেশী সংস্থা ও তৎসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতিত) নামফলক, সাইন বোর্ড, বিল বোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি এখনো বাংলায় লিখা হয়নি সেগুলোর বিরোদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে ডিএনসিসি’র ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই অভিযান সম্পর্কে  মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। কেউ বলছেন- ফেব্রুয়ারি মাস বলেই ডিসিসি কিছুটা এ্যাকশন করছে। কেউ বলছেন,সাতদিনের নোটিশ দেয়ার পরই এই ভাংচুর অভিযানের পেছনে সুযুক্তি নেই। এটা রীতিমত বাড়াবাড়ি। এবার পালিত হলো ৬৬তম শহীদ দিবস ও ১৯তম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় ভাবে গৃহীত হচ্ছে না বরং জাতিকে ধংসের জন্য প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত বি- জাতীয় ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চালু করা হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৬ বার জাপান ভ্রমন করেছেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ নোবেল বিজয়ী হওয়ার ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আর কেহ নোবেল পুরস্কার পায়নি। অথচ জাপান ১৯৬৮ সালে ও ১৯৯৪ সালে তাদের ভাষা সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হয়েছে। জাপানিরা নিজ দেশ ও ভাষাকে প্রাণের চেয়ে প্রিয় মনে করে বলেই হিরোশিমা ও নাগাসাখী ধংস হওয়ার পরেও গভীর দেশপ্রেম ও ভাষা সমৃদ্ধির জন্যই এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
সাহাবায়ে কেরামের যুগে উল্লেখযোগ্য যে অনারব জনগোষ্ঠীর সাথে মুসলমানের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল তারা ছিলেন পারস্যের জনগন। আরবি ভাষা বোঝা তো দূরের কথা আরবি উচ্চারণও তাদের জন্য ছিল কঠিন। শামসুল আইয়েম্মাহ সারখসি (রহঃ) বিখ্যাত ফেকাহ্ গ্রন্থ আল-মাবসূতে এই মর্মে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, পারস্য দেশীয় নও-মুসলিমগন হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) এর নিকট এই মর্মে আরজি পেশ করেন যে, তাদের পক্ষে নামাযে অবশ্য পঠনীয় সূরা ফাতেহা সহীহ উচ্চারণে পাঠ করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং তাদের জন্য যেন কোনো একটা উপায় বের করা হয়। তখন হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) হযরত নবী করীম (সাঃ) এর মৌখিক অনুমতি নিয়ে সূরা ফাতেহা ফারসী ভাষায় অনুবাদ করে সেইসব লোকদের নিকট পাঠিয়ে দিলেন এবং বলে পাঠালেন, যে পর্যন্ত সূরা ফাতেহার বিশুদ্ধ উচ্চারণ পরির্পূণরূপে রপ্ত করা সম্ভব না হবে, সে পর্যন্ত যেন তারা ফারসী তরজমাটুকু পাঠ করে হলেও নামায আদায় করতে থাকেন। বলা বাহুল্য, পবিত্র কুরআন অনারব ভাষায় অনুবাদের সূচনা এভাবেই হয়েছিল এবং খোদ নবী করীম (সাঃ) এর অনুমোদন নিয়েই বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) এই শুভ কর্মটির সূচনা করেছিলেন। (আল মবসূত, ১ম খন্ড: মুকাদ্দমা সহীফায়ে ইমাম ইবনে মুনাব্বেহ পৃষ্ঠা-২৯)।
-আবু মুনীর

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ