শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান

স্টাফ রিপোর্টার : আজ মঙ্গলবার ২০শে ফেব্রুয়ারি। এদিনটি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। এ দিন আন্দোলনের সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ১৪৪ ধারা। আজকের দিনে বাংলা ভাষাভাষীসহ বিশ্বব্যাপী উন্মুখ অধীরতায় অপেক্ষমাণ অমর একুশে তথা মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করতে। শহীদ মিনারগুলো ধুয়েমুছে প্রস্তুত করে তোলা হচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক স্থানে অস্থায়ী স্মৃতির মিনার নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও অসংখ্য শহীদ মিনার বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের মর্যাদা-গৌরবকে অসংকোচে প্রচার করবে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন অমর একুশে উদযাপনে বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়েছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, “২০শে ফেব্রুয়ারি সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৪, নবাবপুর রোডস্থ আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের কিছু সদস্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পক্ষে থাকলেও, সবশেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে একই বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত সভায় নেতৃত্ব দেন আবদুল মোমিন। শাহাবুদ্দিন আহমদের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে এই সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেন আবদুল মোমিন এবং শামসুল আলম।”
পঁয়ষট্টি বছর আগেকার ঠিক আজকের দিনটি ছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানবাসীর জন্য কঠিন পরীক্ষার। স্বাধিকারের চেতনাবোধ থেকে জন্ম নেয়া অভূতপূর্ব আত্মবোধ সেদিন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের মসনদ নড়বড়ে করে দিয়েছিলো। পূর্বঘোষিত একুশের দাবি দিবসকে সামনে রেখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দল-মত নির্বিশেষে সংগঠিত হতে থাকে। চোখেমুখে সকলের প্রতিবাদের, দ্রোহের অগ্নিঝিলিক। তাদের একমাত্র দাবি ছিলো- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। বলাবাহুল্য, ভাষা-আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহে ব্যক্তি প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, অধ্যাপক আবদুল গফুর, অধ্যাপক ড. এএসএম নূরুল হক ভূঁইয়া প্রমুখের নামের সাথে সাথে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস গোলাম আযম (পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীর আমীর), ডা. গোলাম মাওলা প্রমুখের অবদানও অনস্বীকার্য। একইভাবে এই আন্দোলনকে গতিশীল ও ফলপ্রসূূ করতে তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পূর্ব-পাকিস্তান যুবলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, গণআজাদী লীগ, পূর্ব-পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগ ইত্যাদি সংগঠনের সাথে সাথে পূর্ব-পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার, রিকশা ইউনিয়ন, পূর্ববঙ্গ কর্মশিবির, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ, নিখিল পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, মজদুর ফেডারেশন, পূর্ব-পাকিস্তান মোহাজের সমিতি ইত্যাদির অবদানও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভাষা-আন্দোলন গবেষক এমএ বার্ণিক এসব তথ্য জানানোর পাশাপাশি এও বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ অবদান ছিলো না। কারণ পুরো ভাষা-আন্দোলন পর্বে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিলো।
তৎকালীন পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দীন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ এই ধরনের পুনর্বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তীব্র রোষ দেখা দেয়। ১৯৫২ সালের ৩০শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশেই নেতৃবৃন্দ ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি দাবি দিবস পালনের কর্মসূচি দেয়া হয়। ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান আইন সভায় অধিবেশন বসার কথা ছিলো বিধায় এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডাকা হয়। একুশের দাবি দিবসকে কেন্দ্র করে জনমনে যে ব্যাপক সাড়া পড়েছিলো সরকার তা আঁচ করতে পেরেই ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় ক্রমাগত এক মাসের জন্য ঢাকা শহরের সর্বত্র হরতাল, সভা-মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। মাইকযোগে ১৪৪ ধারা জারির সাথে সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে।
সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কী ভূমিকা নেয়া যায় এই ব্যাপারে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ জরুরি ভিত্তিতে সেদিন সভা ডাকে। সভায় ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে বেশির ভাগ প্রতিনিধি মত প্রকাশ করেন। কারণ হিসেবে তারা বলেন, আমরা যদি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করি তাহলে দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে সরকার জরুরি অবস্থার অজুহাতে সাধারণ নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। আমরা সরকারকে সেই সুযোগ দিতে চাই না। কিন্তু সংগ্রামী ছাত্রসমাজের অপর অংশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে রায় দেন। তারা বলেন, বাস্তব অবস্থা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অনুকূলে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষে জোরালো বক্তব্য থাকলেও ২০শে ফেব্রুয়ারি শীতার্ত রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের নেতাকর্মীদের তৎপরতায় ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় ছাত্রসভা এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। তার পরের ঘটনা তো সবারই কমবেশি জানা। সত্যি বলতে কী, বায়ান্নর ২০শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে এবং থাকবে। এদিনেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভবিষ্যৎ গতিধারা নির্ধারিত হয়।
সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ব্যাপারে মতভেদ সম্পর্কে ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আহমদ রফিক তার ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “২১শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা অমান্য করা নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও উত্তপ্ত বিতর্কের প্রেক্ষিতে সদস্যদের সবাই একমত হতে পারেননি বলেই সমস্যা দেখা দেয়। তখন সভায় ১১-৪ ভোটে সিদ্ধান্ত হয় যে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে না। ভাষা আন্দোলনের আরেক কিংবদন্তী আবদুল মতিন এ সম্পর্কে জানিয়েছেন, তিনি তখন উঠে দাঁড়িয়ে সভাপতিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, এখানে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা নিয়ে সুস্পষ্ট দুটো বিপরীত মত রয়েছে। পরদিনের ছাত্রসভায় দুটো মত উপস্থাপনের মধ্য দিয়েই সঠিক সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। তার বক্তব্য গ্রহণ করার পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন দুটো মত ছাত্রসভায় উপস্থাপনের পক্ষে সভাপতি সম্মতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু তিনি এ কথাও বলেন, যদি ছাত্ররা সর্বদলীয় পরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে তাহলে তার ভাষায় ‘the committee will ipso facto stand dissolved’ অর্থাৎ সংগ্রাম কমিটির বিলুপ্তি ঘটবে।” উক্ত গ্রন্থটিতে আহমদ রফিক আরো বর্ণনা করেন, “আব্দুল মতিনের ভাষ্য মতে, সর্বদলীয় বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবটি প্রকৃতপক্ষে সভাপতি আবুল হাশিমের বাক্য বন্ধে রচিত। এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, কাজী গোলাম মাহ্বুব, খয়রাত হোসেন প্রমুখ ১১ জন। অন্যদিকে বিরুদ্ধে ভোট দেন অলি আহাদ, আবদুল মতিন ও গোলাম মাওলা। মতিনের মতে, শামসুল আলমও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন। কিন্তু শেষোক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে ভিন্ন মত লক্ষ্য করা যায়। মোহাম্মদ তোয়াহা ভোটদানে বিরত থাকেন।”
এদিকে, আজ রাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা অতিক্রম করতেই গোটা জাতি অমর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পদার্পণ করবে। একুশের প্রথম প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতির পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া বিএনপিসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ ও কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিবৃন্দ শহীদ মিনারে ফুল দেবেন। এ উপলক্ষে যাবতীয় প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও এর সন্নিহিত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং জনসাধারণ ও যানবাহন চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ