শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

নয়া পুলিশ প্রধান কে? আলোচনায় ড. জাবেদ পাটোয়ারি

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে খুব গুরুত্বের সাথেই দেখছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনী বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগকে সরকারে থেকেই সাজাতে হবে আগামীর পরিকল্পনা। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ জাতীয় নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে প্রয়োজন দক্ষ পুলিশ প্রশাসন। এই প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই একজন দক্ষ পুলিশ প্রধান।
এদিকে বর্তমান পুলিশ প্রধান (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হকের নিয়মিত চাকরির মেয়াদ ৩১ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে। পুলিশ প্রধানের পদে নতুন কেউ দায়িত্বে আসছেন, নাকি বর্তমান আইজিপির মেয়াদ বাড়ানো হবে, এ নিয়ে এখন জোর আলোচনা। বর্তমান আইজিপি কমিউনিটি পুলিশের স্বপ্নদ্রষ্টা । ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ( ডিএমপি ) সহ মাঠ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সফলতার সাথে পালনের পুরস্কার হিসেবে আইজিপি পদে নিয়োগ পান জেষ্ঠতা লংঘন করেই । ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন শহীদুল হক। ১৯৮৪ সালে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৬ সালে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। এরপর তিনি চাঁদপুর, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম ও সিরাজগঞ্জ জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার ছাড়াও শহীদুল হক বাহিনীর নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
এ ছাড়া পুলিশ বাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক হিসেবে আইজিপি নিয়োগের নজিরও আছে । স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে অস্বাভাবিক কিছুও ঘটতে পারে । সব কিছু মিলিয়েই কে হবেন সেই পুলিশ প্রধান ? এর সাথে মাস কয়েক ধরেই নয়া পুলিশ প্রধানের নাম আলোচনার খোরাক ।
অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, স্বাভাবিক নিয়মেই আইজিপি নিয়োগ দেয়া হবে। তবে এখনো কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।
পুলিশ বাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক হিসেবে আইজিপি নিয়োগের নজির থাকলেও এবার তা যে হচ্ছে না, সেটা মোটামুটি স্পস্ট। বর্তমান আইজিপি নিজেই তার আভাস দিয়েছেন। ৬ জানুয়ারি পুলিশ সদর দফতরে ‘পুলিশ সপ্তাহ-২০১৮’ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নিজ দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘যাবার আগে আরেকবার আসব আপনাদের সামনে।’
পুলিশ সদর দফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন আইজিপি কে হচ্ছেন তা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সদর দফতরের কাজকর্মেও গতি কমে গেছে। সবাই তাকিয়ে আছেন পরবর্তী আইজিপির দিকে। বড় ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কেউ ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে দেখা গেছে, আইজি হিসেবে আলোচনায় যেসব কর্মকর্তার নাম শোনা যাচ্ছে, সবার নজরও তাদের দিকে।
আইজি হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ড. জাবেদ পাটোয়ারির নাম। তিনি পুলিশ গ্রেড-১ পদের কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেলজীবনের ওপর লেখা গ্রন্থ কারাগারের রোজনামচার বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ সংগ্রহে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। এই পুলিশ কর্মকর্তা বর্তমান আইজিপি শহিদুল হকের মতোই বিসিএস ৮৪ ব্যাচের। ওই ব্যাচে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চাকরির মেয়াদ আছে জাবেদ পাটওয়ারীর। ওই ব্যাচের প্রথম হওয়ার পরও অস্বাভাবিক নিয়মের কাছে হেরেছিলেন ড. পাটোয়ারি । তাকে ডিঙ্গিয়েই আইজিপি করা হয়েছিল শহীদুল হককে । যার কারণে এবারও সে অস্বাভাবিকতার বিষয়টি ঘুরপাক খাচ্ছে নানা পর্যায়ে ।
আলোচনায় আরও আছে অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমানের নাম। পুলিশ সপ্তাহের আগের দিন তাকে পদোন্নতি দিয়ে গ্রেড-১ করা হয়েছে। এ কারণে আইজি হিসেবে বেশ জোরালোভাবে তার নাম শোনা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়েরের পরপরই ১৯৯৬ সালের ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর খুনিদের গ্রেফতার করেছিলেন মোখলেসুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। তিনি পুলিশে যোগ দেন ১৯৮৮ সালে।
এ ছাড়া আলোচনায় আছে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের নাম। ১৯৮৮ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয়া বেনজীর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর সদস্য হিসেবে বসনিয়া ও কসোভোতে কাজ করেছেন। তিনি ডিএমপি কমিশনার ছিলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের বর্তমান কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার নামও আলোচনায় আছে। তিনিও ১৯৮৮ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। কর্মজীবনে তিনি সুনামগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ছাড়াও পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এর মধ্যে জাবেদ পাটোয়ারির চাকরির মেয়াদ রয়েছে ২০২০ সাল পর্যন্ত , মোখলেসুর রহমানের ২০১৯ সাল, বেনজীর আহমেদের ২০২২ সাল এবং মো. আছাদুজ্জামান মিয়ার চাকরির মেয়াদ রয়েছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত।
এদিকে, এমন নানা গুঞ্জনের মধ্যেই পুলিশ সপ্তাহ শুরুর ঠিক আগের দিন গত ৭ জানুয়ারি অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমানকে আরেক ধাপ পদোন্নতি (গ্রেড-১) দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-১ অধিশাখার উপসচিব মো. ইলিয়াস হোসেন স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, 'বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমানকে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত) গ্রেড-১ (জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ এর টাকা ৭৮ হাজার টাকা (নির্ধারিত) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পুলিশের ৮৫ ব্যাচের এই কর্মকর্তা এক সময় সিআইডির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘জাবেদ পাটোয়ারির বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা আছে, তবে এটি এখনো চূড়ান্ত করে আমাদের জানানো হয়নি। এটি সরকারের শীর্ষপর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।’
সরকারি চাকরি করে রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মতামত প্রকাশের সুযোগ নেই। তারপরও পুলিশের প্রধান পদগুলোতে ছাত্রজীবনে বা পারিবারিকভাবে সরকারের রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিরোধী মতাদর্শের কাউকে নিয়োগ দেয়া হয় না। আর সরকারের শেষ বছরে বিরোধী দলের সম্ভাব্য আন্দোলন বা বিশৃঙ্খলা মোকাবেলার বিষয়টি যখন সামনে এসেছে, তখন আরও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে। আর সবকিছু ভেবেচিন্তেই নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কে আইজিপি হবেন, তা প্রধানমন্ত্রীর ওপরই নিভর্র করছে।
আলোচনায় জাবেদ পাটোয়ারি
গত দু‘তিন ধরেই একাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টালের খবরে বলা হচ্ছে, পুলিশের পরবর্তী মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারি। তাকে আইজিপি হিসেবে নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ফাইল যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। চলতি মাসের ৩১ তারিখ বর্তমান আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর পরদিন থেকেই আইজিপির দায়িত্ব পাচ্ছেন জাভেদ পাটোয়ারি। তবে এ সব খবরের সত্যতা কোন সূত্রেই নিশ্চিত হওয়া যায়নি ।
চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নে জাবেদ পাটোয়ারিরর জন্ম। বাবুরহাট হাই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে পাস করেন এসএসসি। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে গিয়ে ভর্তি হন চাঁদপুর কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়ার পর জাবেদ পাটোয়ারি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন ১৯৮৬ সালে। ২০১৩ সালে সচিব পদমর্যাদায় গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পান পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান জাবেদ পাটোয়ারি। পুলিশ প্রশাসনে স্বচ্ছ ইমেজের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার। জাবেদ পাটোয়ারির সহধর্মিণী মিসেস হাবিবা হোসেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারা জীবনের ওপর লেখা গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’-এর বিভিন্ন ‘নথিপত্র’ সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন জাবেদ পাটোয়ারি। এই কর্মকর্তা চাকরির বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে বর্তমানে পুলিশের সর্বোচ্চ পদের এক ধাপ নিচে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-১) পদে কর্মরত ।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের পরবর্তী আইজি হিসেবে নতুন মুখকেই বেছে নিতে চায় সরকার। ফলে শহীদুল হকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা ক্ষীণ। দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারকেও একটি পক্ষ চুক্তিভিত্তিক আইজিপি হিসেবে নিয়োগের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর নতুন আইজিপি হিসেবে অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) একেএম শহীদুল হককে বেছে নেয়। পরের দিন তিনি আইজিপি হিসেবে যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আইজিপি হিসেবে নিয়োগপ্রত্যাশী চার পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারি আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন। তাকে আইজিপি হিসেবে নিয়োগ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গত বছরের জুলাই মাসে আইজিপি একেএম শহীদুল হককে বদলের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নতুন আইজিপির ব্যাপারে প্রস্তাব তৈরি করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারির নাম আইজিপি হিসেবে প্রস্তাব পাঠাতেও বলা হয়। এ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানোর আগেই ফাঁস হয়ে যায়। এর পর একটি পক্ষ প্রস্তাবের বিরোধিতায় নামে। তখন এ নিয়ে জোর আলোচনার মধ্যেই শেষ পর্যন্ত শহীদুল হককে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। এ নিয়ে তখন নানা গল্পও চাউর হয় পুলিশে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদ জাবেদ পাটওয়ারির আইজিপি হওয়া নিয়ে এরই মধ্যে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দফতরে কাজ শুরু হয়ে গেছে। তিনিই আইজিপি হচ্ছেন নাকি তালিকার অপর কেউ আসছেন এই পদে, তা জানার জন্য হয়তো আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ