শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পরিচালকরাই ব্যাংক হরিলুটের নেতৃত্বে

এইচ এম আকতার: ব্যাংকিং খাতে চলছে হরিলুট। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পরিচালকরাই  লোপাটের নেতৃত্বে রয়েছে। ভাগবাটোয়ারা করে ঋণ নিচ্ছেন ব্যাংক পরিচালকেরা। যোগসাজশের মাধ্যমে এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে পৌনে দুই লাখ কোটি টাকাই চলে গেছে ব্যাংক পরিচালকদের দখলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারলে গোটা অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পাবে।
জানা গেছে, ২৯টি ব্যাংকের পরিচালকরা নিয়েছেন নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা পরিশোধ করছেন না। এভাবেই ব্যাংকের পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এক জন পরিচালক ২০ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয় করে রাতা রাতি পরিচালক বনে যান। পরে তিনি তার কোম্পানির নামে প্রভাব খাটিয়ে শত শত কোটি টাকা ঋণ তুলে নিচ্ছেন। বছরের পর পর কাটিয়ে গেলেও ঋণ পরিশোধের উদ্যোগ নেই।
 বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এভাবে ভাগবাটোয়ারার ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাবে, যা ভব্যিষ্যতে দেশের আর্থিক খাতের জন্য মোটেও সুখকর হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানিয়েছেন, পরিচালকরা যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিচ্ছেন তার বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব নেই। এভাবে ঋণ নেয়া অনৈতিক ও সুশাসনের পরিপন্থী। এটা আমানতকারীদের আমানত ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এসব অনৈতিক ঋণ নেয়া প্রতিরোধ করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে এ ধরনের ‘কানেক্টিং লেনদেন’ বন্ধ করা উচিত। তা না হলে খেলাপি ঋণ আরো বাড়বে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেও সুখকর হবে না।
জানা গেছে, আগে পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকেই বেশি মাত্রায় ঋণ নিতেন। পরে ওই ঋণ পরিশোধ করতেন না। যখন খেলাপি হয়ে যেত, তখন বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই ঋণ পরিশোধ দেখাতেন। আবার পরিচালকরা পরিচালনা পর্ষদে বসে নিজেরা অনৈতিকভাবে সুদ মওকুফ করে নিতেন। পরিচালকদের নিজ ব্যাংকের এ অনৈতিক কার্যক্রম ঠেকাতে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো পরিচালক তার মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিজ ব্যাংক থেকে নিতে পারবেন না। এর পর থেকেই পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া কমিয়ে দেয়।
  বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে বেপরোয়া ঋণ নেয়া কমানো হলেও তাদের এ অনৈতিক কার্যক্রম থেমে নেই। তারা নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে ঋণ নেয়া অব্যাহত রেখেছেন। যেমন, ‘ক’ ব্যাংকের পরিচালক ‘খ’ ব্যাংক থেকে নিচ্ছেন। আবার ‘খ’ ব্যাংকের পরিচালক যোগসাজশের মাধ্যমে ‘ক’ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। আর এজন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপরে ওপর পরিচালকদের বেআইনি ও অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, তার ব্যাংকের ঋণের একটি বড় অংশই পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ। আর এসব ঋণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খেলাপি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কিছু বলা যাচ্ছে না। এভাবেই ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে,সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। আর এ সব পরিচালকরাই নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে মোটা অংকের ঋণ নিয়ে থাকেন। এসব ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম থাকলেও নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে তা পাশ করে নেন। এসব পরিচালকরা নিজেদের পরিচয় ব্যাংকের নাম ব্যবহার করলেও ব্যাংকের স্বার্থে কোন কাজ করেন না। উল্টো ব্যাংকের লোপাটের কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকেন। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই কাজ করে থাকেন। কারণ ব্যাংকের অংশিক শেয়ারের মালিক হলেও প্রতিষ্ঠানের পুরো মালিক নিজেই। আর এ কারণেই ব্যাংক সংকটে পড়ছে। কিন্তু পরিচালকদের প্রতিষ্ঠান ভালো ভাবেই চলছে। তারপরেও  ঋণ পরিশোধ করছে না এসব পরিচালকরা।
এভাবে টাকা হরিলুট করতে পরিচালক হওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ব্যাংক দখল পাল্টা দখল হচ্ছে। এতে করে গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। গ্রাহকরা ব্যাংক বিমুখ হয়ে বিকল্প বিনিয়োগের পথ খুজছেন।
এ ব্যাপারে ইব্রাহিম খালিদ বলেন ,রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ বন্ধ করা না গেছে ব্যাংকিং খাতে হরিলুট বন্ধ হবে না। ব্যাংকারদের দিয়েই ব্যাঙক পরিচালনা করতে হবে। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন,কামার দিয়ে তো আর কুমারের কাজ করা যায় না। ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদদের দিয়ে ব্যাংক চালালে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ৩০ সেপ্টেম্বরভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২৯টি ব্যাংক পরিচালকেরা তাদের নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৩৮৩ কোটি ২২ লাখ টাকা।
নিজ ব্যাংকসহ ৫৭টি ব্যাংক থেকেই পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্বনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আরও কঠোর ভুমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্য আরও বাড়ছে। আর রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ বন্ধ করা না গেছে ব্যাংকিং খাতে আরও সংকট প্রকট হবে। ব্যাংকিং খাতে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও মনিটরিং বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আইনে সংস্কার করতে হবে।
নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে নতুন ব্যাংকের পরিচালকেরা। এর মধ্যে মেঘনা ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ১০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মিডল্যান্ড ব্যাংক থেকে ১৮ কোটি টাকা, মধুমতি ব্যাংক ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা, এনআরবি ব্যাংক ২ কোটি ১০ লাখ টাকা, সীমান্ত ব্যাংক ৩৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারার ব্যাংক ৬৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন পরিচালকেরা।
পুরনো ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংকের কিছু কিছু পরিচালক তাদের নিজ নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন।
বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৫৩টি ব্যাংক থেকেই পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে নতুন ৯ ব্যাংকের সব ক’টি থেকেই পরিচালকেরা ঋণ নিয়েছেন। যেমন মেঘনা ব্যাংক থেকে প্রায় ৪২৮ কোটি টাকা, মিডল্যান্ড ব্যাংক থেকে ৩৫৩ কোটি টাকা, মধুমতি ব্যাংক থেকে ৪০২ কোটি টাকা, এনআরবি ব্যাংক থেকে ১৭৪ কোটি টাকা, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ৯৪৯ কোটি টাকা, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক থেকে ৬২১ কোটি টাকা, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংক থেকে ৫৮৮ কোটি টাকা, দি ফারমার্স ব্যাংক থেকে ২০৮ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন অন্য ব্যাংকের পরিচালকেরা।
 প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে পুরনো ব্যাংকগুলোর মধ্যে পরিচালকদের ঋণ রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ১১ হাজার ৯১০ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংকের ৯ হাজার ১০৬ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়ার ৫ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৮ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৬ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
এর বাইরেও রয়েছে নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকদের বেনামি ঋণ। এ কারণে ব্যাংকিং খাতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। ওই সূত্র জানিয়েছে, খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশই বর্তমান ও সাবেক ব্যাংক পরিচালক, তাদের স্ত্রী-পুত্র-সন্তান বা তাদের নিকটাত্মীয়দের কাছে আটকা পড়ে আছে। এসব ঋণ প্রস্তাব, অনুমোদন ও বিতরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্যাংকগুলোর পরিচালকের সংখ্যা এক হাজারের কাছাকাছি হলেও এ ধরনের সমঝোতাভিত্তিক বড় অঙ্কের ঋণ বিনিময় করেন শতাধিক পরিচালক। যাদের কয়েকজন বেশি বিতর্কিত। মূলত এদের কাছেই পুরো ব্যাংকিং সেক্টর জিম্মি হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এসব পরিচালকের ঠেকানো না গেলে পুরো ব্যাংকিং খাতের জন্যই অশনিসংকেত বয়ে আনবে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখনই নজর দেয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করছেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ