শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

শিক্ষায়তনগুলো যমুনাপুলিন বা বৃন্দাবন নয়

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : খবরও তরতাজা, মুচমুচে এবং ভিন্ন স্বাদের হতে পারে। হ্যাঁ, এমনই মজার একটি খবর পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে। আজকাল সংবাদপত্র, টেলিভিশনও যেন অনলাইন মিডিয়া থেকে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। ঘটনার মুহূর্তে ছড়িয়ে দিতে পারে যেকোনও খবর এ মাধ্যমটি। আগের মিডিয়াগুলো তা পারছে না। রেডিও তেমন আজকাল আর শোনেই না অনেকে। আর অনলাইন মিডিয়ায় যেকেউ তাৎক্ষণিক খবর বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে পারেন। শুধু ক্ষুদ্র একটি ডিভাইস সঙ্গে থাকলেই হয়।
আগের দিনে ছাত্রছাত্রীরা মাঝেমধ্যে ক্লাস ফাঁকি দিতো। কারণ পড়ালেখা রেডি না করে ক্লাসে যাওয়া মানে বেধড়ক স্যারের পিটুনি খাওয়া। কানধরে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা। আর নয়তো বেঞ্চে পেন্সিল রেখে তার ওপর হাঁটু পেড়ে দাঁড়ানো। কী কঠিন শাস্তি তা যে ভোগ করেনি তার পক্ষে অনুভব করা মুশকিল।
যাই হোক, আগে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিতেন পড়া না পারলে, দুষ্টুমি করলে কিংবা স্কুল ফাঁকি দিলে। এখন কিন্তু শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিতে পারেন না শিক্ষকরা। বরং শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকদের মাঝেমধ্যে শাস্তি দেয়। শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের ভয়ে ক্লাসেই যান না। এমনই একটি খবর চাউর হয়ে গেছে অনলাইন মিডিয়ায়। ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। একজন শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের ভয়ে ক্লাসে যাচ্ছেন না। অবশ্য সংগত কারণে শিক্ষকের নাম এবং তিনি কোন বিভাগে শিক্ষকতা করেন তা উল্লেখ করা হয়নি। এসব উল্লেখ করলে বেচারা হয়তো আর কোনওদিনই ওখানে শিক্ষকতা করতে পারতেন না।
কোনও কোনও শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের সঙ্গে পিটিসপুটুস করবার রসালো খবর প্রায়শ পাওয়া যায়। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে নাকি এ কামে বেশ পারদর্শী। কেউ কেউ পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট পাইয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে সুন্দরী ছাত্রীদের শয্যাসঙ্গিনী করতেও নাকি পটু বলে প্রকাশ।
কোনও ‘কৃষ্ণপ্রাণ’ শিক্ষকের ছাত্রীর সঙ্গে রাধাপ্রেম যদি প্রকাশ পেয়ে যায় সবার সামনে তাহলে ছাত্রদেরতো ক্ষুব্ধ হবারই কথা। হয়তো ঘটনা বা রটনা এমনই। এ না হলে গুরুজী ক্লাস নিতে যাচ্ছেন না কেন? অথবা চবি’র এই গুরু-শিষ্যার জুটি কোনও কুঞ্জবনে চুটিয়ে লীলাকামে মেতে আছেন।
এইতো চার-পাঁচ দশক আগেও শিক্ষকরা ছিলেন মর্যাদার আসনে। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের খুব সম্মান করতো। আমরা শিক্ষকদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস করতাম না। এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। শিক্ষক যেমন নিজের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন, তেমনই ছাত্রছাত্রীরাও শিক্ষকদের কচু দেখাতে পরওয়া করছে না। এমনকি অনেক ছাত্র আজকাল শিক্ষকদের ওপর চড়াও হবার দুঃসাহস দেখাচ্ছে।
একজন শিক্ষক কেবল শিক্ষা দেন, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান বা পাঠদান করেন এমন নয়। গোটা জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শিক্ষক। দেশের রাষ্ট্রপরিচালককেও শিখতে হয় শিক্ষকের কাছে। অর্থাৎ রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সৈনিক যাই হোন না কেন, শিক্ষক সবার গুরু। গুরুর কাছে শিক্ষা ব্যতীত সবাই প্রায় গরুই থাকেন। গরু দিয়ে হয়তো আগের দিনে হালটানা যেতো। গাড়িও টানতো গরুতে। আজকাল তাও চলে না। বলতে পারেন গরু এখন বিপন্ন প্রাণী। যারা গুরুর কাছে লেখাপড়া শেখেননি, তারা আসলেই গরু। এই গরুকেই মানুষ করেন গুরু বা শিক্ষক। যে জাতি শিক্ষকদের মর্যাদা দেয় না, সে জাতির দুর্গতি ত্বরান্বিত হয়।
যা হোক, শিক্ষকসমাজ অবশ্যই সম্মানের যোগ্য। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিক্ষক যথাযোগ্য মর্যাদার আচরণ দাবি করতেই পারেন। কিন্তু শিক্ষক যদি অশিক্ষকসুলভ আচরণ করেন, শিক্ষার্থীর সঙ্গে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন, তাহলে কি তিনি সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত থাকতে সক্ষম হবেন? নিশ্চয়ই না। আলোচ্য চবি শিক্ষক এমন কোনও অনৈতিক বা অসামাজিক কার্যকলাপ করেছেন, যার জন্য ছাত্রছাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়েছে। তিনি ক্লাস নিতে যাবার সাহস পাচ্ছেন না।
আমি যখন ঠাকুরগাঁওয়ের জাবরহাট হাইস্কুলে পড়ি তখন একজন শিক্ষক অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করায় আমরা তাঁকে ক্লাস নেয়া থেকে বিরত রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। পরে তিনি স্কুল থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। অবশ্য চবির গুরু যে কী আচরণ করেছেন তা স্পষ্টত জানা যায়নি। আমরা জাবরহাট হাইস্কুলে ক্লাস নেয়া থেকে যে শিক্ষককে বিরত রেখেছিলাম তিনি তেমন মারাত্মক কিছু করেননি। তবে প্রধানশিক্ষকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছিলেন।
আমরা চাই না কোনও শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের দ্বারা কোনওভাবে অপদস্থ হন। এমন কাজ ছাত্র-শিক্ষক কারুর জন্যই সম্মানজনক নয়। তাই এটা ছাত্র-শিক্ষক সবার মনে রাখা দরকার।
এ পোস্টটা যখন শেষ করতে যাচ্ছি, তখন ৩ জানুয়ারির ইত্তেফাকের শেষপৃষ্ঠার শেষকলামের সবশেষে একটি নিউজে চোখ আটকে গেল। সেটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক সম্প্রতি ছুটির দিনে বিভাগীয় কক্ষে শিক্ষাচর্চার পরিবর্তে অনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হবার দরুন  তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এদের একজনকে এক বছরের জন্য অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আরেক জন শিক্ষকের শাস্তিটা অবশ্য ইত্তেফাকে উল্লেখ করা হয়নি। এই হচ্ছে এক শ্রেণির শিক্ষকের চরিত্র। তাও ভাগ্য ভালো যে, শিক্ষকদের সিংহভাগ এখনও রাধা-কৃষ্ণ সাজেননি বা সাজতে চেষ্টা করেন না। তবে কলেজ-ভার্সিটির অন্তত বাংলা বিভাগে আদিরসের প্রেমলীলা পড়ানো হয় তা হয়তো সবারই জানা। এতে যদি সেই পাঠ কোনও শিক্ষক-শিক্ষিকা কিংবা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ প্র্যাক্টিস করেনই, তাহলে দোষ দেবেন কাকে? অবশ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলায়তন যমুনাপুলিন, মথুরা বা বৃন্দাবন নয়, তা বোধ হয় সবাই সবসময় মনে রাখতে পারেন না। সমস্যা আসলে এটাই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ