বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

রুজির মালিক আল্লাহ

আবদুল মান্নান তালিব ; এক শহরে ছিল এক সৎ যুবক। সারাদিন খাটা-খাটনি করে যা কিছু পেত তা দিয়ে গুড়-মুড়ি কিনে কোন রকমে কায়ক্লেশে দিন গুজরান করতো। আর আল্লাহর শোকর গুজারি করতো। আল্লাহর প্রতি ঈমান তার কখনো টলমল করেনি। সে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ যখন তাকে সৃষ্টি করেছেন তখন তার আহারও যোগাবেন। আল্লাহ তাকে অনাহারে মারবেন না। তাই কোনদিন কিছু উপার্জন করতে না পারলেও সে কারো কাছে হাত পাততো না। মানুষের কাছে ভিক্ষা চাওয়াকে সে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় অপমান মনে করতো।

একবার সে বড় কষ্টে পড়লো। কোথাও কোন কাজ পেল না। পর পর ক’দিন অনাহারে কাটালো। ক্ষুধায় কাতর হয়েও সে কাজের সন্ধানে ফিরতে লাগলো। অবশেষে দুর্বলতার কারণে তার পক্ষে পথ চলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। এখন কি করবে সে ভেবে কোন কুল-কিনারা করতে পারছিল না। তবুও সে চলতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো, আল্লাহ হয়তো কোন একটা উপায় করে দেবেন।

কিছুদূর চলার পর নির্জন পথে হঠাৎ সে একটা কাপড়ের থলি দেখতে পেল। থলিটি বড়ই সুন্দর। কি জানি কার থলি এটা নিয়ে আবার কোন ফ্যাসাদে পড়বো। একথা চিন্তা করে সে এগিয়ে গেল। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আবার মনে হলো, থলিটা আমি না নিলেই বা কি অন্য কেউ তো তুলে নিয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং আমি ওর আসল মালিকের হাতে পৌঁছে দেই। একথা চিন্তা করে সে আবার ফিরে এসে থলিটা উঠিয়ে নিল।

 সে থলিটা উড়িয়ে নিয়ে উলটে পালটে দেখল। মনে হলো এর মধ্যে কিছু মূল্যবান জিনিস আছে। সে থলির মুখটা খুলে ফেলল। তার মধ্যে দেখল একটা মূল্যবান সোনার হার ও কিছু স্বর্ণমুদ্রা। এমনি তো সে অনাহারে ছিল কয়েকদিন থেকে। ক্ষুধায় নাড়ি চোঁ চোঁ করছিল। তার পর পিছলে যেতে লাগলো। চিন্তা হলো: এটা পরের জিনিস। আর পরের জিনিস না বলে নেয়া হারাম। কিন্তু তিন দিনের অনাহারের পর এখন তার ক্ষুধায় মারা পড়ার অবস্থা। এ অবস্থায় হারামও হালাল হয়ে যায়। কাজেই এ থেকে তার প্রয়োজন পরিমাণ একটা মুদ্রা গ্রহণ করলে ক্ষতি কি? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরের বিবেক জেগে উঠলো।

বিবেক তাড়া দিল: এ হতে পারে না। তিন দিনের অনাহারের পর তুমি কি আল্লাহর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেললে? আল্লাহ কি তোমাকে নিজের মেহনতের উপার্জন থেকে অন্ন দান করতে পারেন না? তুমি পরের দ্রব্য গ্রহণ করতে যাবে কেন? হাজার হোক এ স্বর্ণমুদ্রা তো পরের। তুমি ভিখ মেগে নয়, তার অগোচরে তার জিনিস গ্রহণ করতে চাও। অথচ আল্লাহর নিকট থেকে গ্রহণ করতে চাও না। তোমার কাছে ঈমানের সম্পদ আছে। এই তুচ্ছ পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে তোমার সেই ঈমানের সম্পদ হারিয়ে ফেলো না। এটা পরের ধন এবং পরের ধন হারাম-এতে সন্দেহ নেই। কাজেই থলির ধনে হাত দিয়ো না। সে বিবেকের ডাকে সাড়া দিল। আল্লাহ কাছে তওবা করল। তারপর থলিটা ঘরে রেখে তার মালিকের খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। মনে করলো, মালিকের খোঁজ করতে করতে হয়তো একটা কাজের খোঁজও পেয়ে যাবে।

শহরের পথে কিছু দূর চলার পর সে একটা ঘোষণা শুনতে পেলো। এক বৃদ্ধ ঘোষণা করছে: ‘আমার একটা মূল্যবান থলি হারিয়ে গেছে। তার মধ্যে সোনার হার ও স্বর্ণমুদ্রা আছে। যদি কেউ পেয়ে থাকে তাহলে তা ফিরিয়ে দিলে তাকে পাঁচশো টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।’

গরীব লোকটি বুঝতে পারলো, সে যে থলিটি পেয়েছে সেটি নিঃসন্দেহে এই বৃদ্ধের। সে দৌড়ে বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বললো:

‘আসুন আমার সাথে। আপনার থলির সন্ধান আমি দিচ্ছি।’

বৃদ্ধ তার সঙ্গে চললো। ঘরে গিয়ে সে থলিটি বৃদ্ধের সামনে রাখলো।

আনন্দে বৃদ্ধের দু’চোখের তারা চক চক করে উঠলো। সে তাকে পুরস্কার দিতে চাইলো। পাঁচশো টাকা তার সামনে রাখলো।

‘আমি এ পুরস্কার নিতে পারি না,” সে বললো। ‘কেন/’ বৃদ্ধের কণ্ঠে বিস্ময়।

‘থলি মালিকের কাছে পৌঁছে দেয়া আমার কর্তব্য ছিল। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। এ জন্য পুরস্কার আল্লাহর নিকট থেকে গ্রহণ করবো।’

বৃদ্ধ তার জন্য দোয়া করে চলে গেলো।

তারপর বহু দিন অতিাহিত হয়েছে। দুনিয়ার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু দরিদ্র যুবকের জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। একদা কাজের সন্ধানে তাকে নিজের দেশ ত্যাগ করতে হলো। সে একটি সামুদ্রিক জাহাজে সফর করছিল। আবহাওয়ার মধ্যে দুর্যোগের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে ভীষণ ঝড়-তুফান শুরু হয়ে গেল। পাহাড়ের সমান উঁচু উঁচু ঢেউগুলো জাহাজটিকে মাথায় করে নিয়ে নাচতে লাগলো। হঠাৎ একটি বিরাট ঢেউয়ের আঘাতে জাহাজটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। জাহাজের একটি ভাঙা তখতার সাহায্যে যুবকটি ভেসে চললো। ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে আসার পর সমুদ্র তীরে ঝুঁকে পড়া একটা গাছের ডালে তার তখতা আটকে গেল। সে লাফিয়ে ডালটি ধরে গাছে চলে বসলো। তারপর সমুদ্র তীরে নেমে এলো। নিকটে একটি লোকালয়ের সন্ধান পেয়ে সেখানে চলে গেলো। সেখানে মসজিদে বসে আল্লাহ স্মরণ করতে লাগলো।

সে অত্যন্ত সুন্দর করে কুরআন শরীফ পড়তে পারতো। তার গলার আওয়াজও ছিল বড় মিষ্টি। তার কুরআন পাঠে মুগ্ধ হয়ে লোকেরা তাকে বেশ আদর করতে লাগলো। সে দিনে ছেলেমেয়েদের ও রাতে বয়স্কদের কুরআন শিক্ষা দিতো। ধীরে ধীরে তার প্রতি এলাকার লোকদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বেড়ে গেল।

সে ছিল অবিবাহিত। তার বন্ধু ও ভক্তের দল তাকে সেই অঞ্চলে বিয়ে দেবার চেষ্টা করলো। সেখানকার জনৈক খোদাভীরু ধনী বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছিল। তার একটি অবিবাহিত কন্যা ছিল। তার সাথে ঐ যুবকের বিয়ে দেয়া হলো।

বিয়ের রাতে বর-কনের সাক্ষাত হলো। ‘এ কি?’ কনের গলায় যে হার ঝুলছে তা যে তার নিজের দেশে সেই কুড়িয়ে পাওয়া হার। হারটি সে ভালো করেই চেনে। সে হার তো সেই পথিক ধনী বৃদ্ধকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাহলে...তাহলে সেই বৃদ্ধের কন্যাই কি তার স্ত্রী?

সে ভাবতে লাগলো। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো সেই বৃদ্ধই তার পিতা। আল্লাহর অপার মহিমা ও করুণা দর্শনে যুবক বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়লো। তার মাথাটি আপনা আপনি আল্লাহর দরবারে নুয়ে পড়লো। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ