বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নির্বাচনের প্রস্তুতি আর সংলাপ নিয়েই বছর গেল ইসির

মিয়া হোসেন : বিদায়ী ২০১৭ সালে নানা কারণে আলোচনায় এসেছে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশন। বিদায়ী বছরের শুরুতেই দায়িত্ব নেয় কে এম নূরুল হুদার কমিশন। দায়িত্ব নেয়ার পরই কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পন্ন করে আলোচনায় আসে কমিশন। আর বছর শেষে অনুষ্ঠিত হয় রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। বছরের মাঝখানে একটি উল্লেখযোগ্য সময় আলোচনায় ছিল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ও সংলাপ নিয়ে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে হোমওয়ার্ক সম্পন্নের পর ছয় সিটি ও আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার চ্যালেঞ্জ এখন ইসির সামনে।
বিদায়ী বছর বিশ্লেষণে দেখা যায়, কে এম নুরুল হুদার কমিশন¡ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে প্রথম আলোচনায় উঠে আসে। এর চেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলেন সংলাপের উদ্যোগ নিয়ে।
এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভোটের আলোচনার সূত্রপাত ঘটায় ইসি। তবে, প্রাথমিকভাবে সব অংশীজনদের সংলাপে বসাতে পেরে যতটা স্বস্তিতে ছিলেন, তারও বেশি অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে সংলাপের উত্থাপিত দু-একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে। যার পক্ষ ইসি নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী এবং সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি।
সংলাপে বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখা, এর জন্য আরপিওতে এই বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা। সঙ্গে ইভিএমকে নির্বাচনে না রাখার দাবি। অপরদিকে, সেনাবাহিনীর বিপক্ষে এবং ইভিএমের পক্ষে ছিলেন ক্ষমতাসীনরা। দল দুটির এ দাবির ক্ষেত্রে পক্ষ হয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিএনপির কোনো দাবিই না মেনে ইভিএম কিংবা ডিভিএমকে আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত না করার পক্ষে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। তবে, আইন-সংস্কার কমিটির প্রস্তাব চূড়ান্ত করে আইনে রূপ দিতে সরকারের কাছে পাঠালে কমিশনের অবস্থান পরিষ্কার হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে স্পর্শকাতর এসব ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির রোষানলে পড়তে পারেন।
চলতি বছরে আরেকটি বড় ধাক্কা ছিল স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রমে স্থবিরতা  তৈরি হওয়াকে কেন্দ্র করে। স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র মুদ্রণ ও বিতরণ প্রতিষ্ঠান ওবারর্থুর ব্যর্থতা কমিশনকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তবে, বর্তমান এনআইডির ডিজি ব্রি. জে. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের কর্মতৎপরতার কারণে বছর শেষে কমিশনকে সেই সমালোচনা থেকে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। এখন স্মার্টকার্ড মুদ্রণ ও বিতরণে সরকার আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে ১০ কোটি ৬০ লাখ অর্থাৎ সব ভোটার এই কার্ডটি পেয়ে যাবেন।
দুই সিটি নির্বাচন: গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি খান মো. নূরুল হুদার কমিশন দায়িত্ব নেয়ার আগে বিদায়ী কাজী রকিব কমিশনের বিতর্কিত ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইসির ভাবমূর্তিকে তলানিতে নিয়ে যায়। এরপর বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতার মধ্যে কাটে বিদায়ী কমিশনে গোটা মেয়াদ। তবে, নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর মুখোমুখি হয় নানা আলোচনা-সমালোচনার। বিশেষ করে বিএনপি বর্তমান কমিশনের নানা সমালোচনা করে আসছে। এরই মধ্যে আসে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। মার্চের এই নির্বাচন ছিল কমিশনের জন্য রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলের সমালোচনা থেকে আলোচনায় আসার। একই সঙ্গে কমিশনের হারানো আস্থা ফেরানোর। সে নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু নৌকা প্রতীকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনজুম সুলতানাকে প্রায় ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। এ নির্বাচন দৃশ্যমান সুষ্ঠু হলেও এরপর মনে হয়েছিল, কমিশন কিছুটা হলেও বিএনপির আস্থায় আসতে পেরেছে। তবে সর্বশেষ ২১শে ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে বিএনপির সেই সমালোচনায় সঙ্গী থাকলো ইসির। এ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর অবস্থান তৃতীয়। জাপার প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা প্রায় লক্ষাধিক ভোটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টুকে পরাজিত করেন। এই নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সিইসি বলেন, এ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কোনো ভোটার, নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বা কোনো প্রার্থীর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। ভালো নির্বাচন করার পরও বিএনপির সমালোচনা থেকে রক্ষা মেলেনি ইসির। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ফলাফল মেনে নিলেও কারচুপির অভিযোগে ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচনের ফলাফল বর্জন করেন বিএনপির প্রার্থী। তবে, বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল সবার গ্রহণ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
রোডম্যাপ ঘোষণা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনি কাঠামোসমূহ পর্যালোচনা ও সংস্কার; নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ; সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনঃনির্ধারণ; নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ; বিধি অনুসারে ভোটকেন্দ্র স্থাপন; নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ এই ৭টি করণীয় বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে চলতি বছরের ১৬ই জুলাই রোডম্যাপ ঘোষণা করে বর্তমান কমিশন। এতেও তারা বিভিন্ন মহলে প্রশংসা পায়। যদিও বিএনপি কিছু বিষয়ে সমালোচনা করেছে। এর আগে সংস্কার কমিশন হিসেবে পরিচিত ১/১১’র শামসুল হুদা কমিশন সংলাপের আয়োজন করে সফল হয়েছিল। পরে রকিব কমিশন সংলাপের আয়োজন করলে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কোনো সাড়া পায়নি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি বিএনপিসহ অধিকাংশ দলের অংশগ্রহণ ছাড়ায় একতরফা নির্বাচন করে সমালোচনা নিয়ে বিদায় নেয় রকিব কমিশন। এ ছাড়া উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও ওই সংসদ নির্বাচনের মতো ছিলো বিতর্কিত।
রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন: চলতি বছরের ৩১শে জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংলাপ শুরু করে ইসি। এরপর গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, নারী নেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ২৪শে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৩ মাস সংলাপ করে কমিশন। সংলাপে সব মহলের প্রতিনিধিরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন এবং নিজেদের মতামত কমিশনের কাছে উপস্থাপন করেন। সংলাপে অংশগ্রহণ করা প্রতিটি মহলই কমিশনের উদ্যোগের প্রশংসা করার পাশাপাশি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা ইসির পক্ষে যে, একা সম্ভব নয় এ বিষয়টি স্পষ্ট করেন। এ রকম মতামত বিগত কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনের সময় পায়নি তারা। সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও জানান, আস্থার যাত্রা শুরু হলো। তিন মাসব্যাপী চলা সংলাপ শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা জানান, রাজনৈতিক দলসহ সবার কমিশনের প্রতি আস্থা রয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমরা দিতে পারবো বলে আশা করি।
স্মার্টকার্ড প্রকল্প: বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দেশের ৯ কোটি নাগরিকের হাতে ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে সব নাগরিকের হাতে স্মার্টকার্ড দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু, বিদেশি কোম্পানি ব্যর্থ হওয়ার পর চলতি বছরের ২৭শে আগস্ট থেকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল ও ব্যবস্থাপনায় স্মার্টকার্ড পারসোনালাইজেশন শুরু হয়। চুক্তি ভঙ্গের কারণে ফ্রান্সের কোম্পানিটি ১৩৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছে। এই প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ পর্যন্ত থাকলেও সম্প্রতি আবার এক বছর বাড়িয়ে তা ২০১৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের সকল ভোটার স্মার্টকার্ড পাবে বলে ঘোষণা দেয় কমিশন। ২০১৬ সালের ৩রা অক্টোবর থেকে নাগরিকের হাতে স্মার্টকার্ড বিতরণ শুরু হয়। সবক’টি মহানগরে বিতরণ কার্যক্রম শুরু করার পর, বর্তমানে আরো ২৭টি জেলা সদরে এটি বিতরণ চলছে। ওবার্থুর পর বিশ্বব্যাংক প্রকল্প থেকে সরে পড়ায় সরকার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ইসির নিজস্ব উদ্যোগে এখন এই কার্ড দেয়া হবে ভোটারদের। তবে কমিশনের এই সাফল্য নতুন বছরেও অব্যাহত থাকবে কিনা এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা বাড়তে শুরু করেছে। কারণ উত্তর সিটির মেয়র পদে উপনির্বাচনের পর গাজীপুর, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট সিটিতে ভোট আয়োজন করতে হবে ইসিকে। এসব নির্বাচনে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা দেখাতে পারলে জাতীয় নির্বাচনে সব দলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ