শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

দুর্যোগ দুর্ভোগ আর গুমের অক্টোপাসের কবলে বাংলাদেশ

সাদেকুর রহমান : পৌষের কুয়াশা মোড়ানো প্রত্যুষে নতুন সূর্যের মুখ কেউ দেখুক বা না দেখুক, এসে গেছে নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ নিয়ে যতটা উম্মাদনা হয়, ঠিক ততটা হয় না ইংরেজি ও হিজরি নববর্ষে, অন্তত এই দেশে। থার্টি ফার্স্ট নাইট নামে যতটুকু উদযাপন হয়, তাতে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি বা স্বকীয়তার লেশমাত্র থাকে না বলে তা সার্বজনীন হয়ে ঊঠছে না। গতকাল রোববার পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্তের মাধ্যমে কালের অতলে হারিয়ে গেছে ২০১৭ সাল। গ্রেগরীয়ান বর্ষপঞ্জিকার পালাবদলে ইতিমধ্যে হাজির হয়ে গেছে ২০১৮ সাল।
বিদায়ী বছরে নানা ঘটনা আলোড়িত করেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলকে। এ সময়ে কেমন ছিল বাংলাদেশ। কেমন ছিল বাংলাদেশের মানুষ? বিশ্লেষকরা এর জবাবে বলছেন, দুর্যোগ, দুর্ভোগ, লুটপাট আর হত্যা-গুমের অক্টোপাসের কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়নে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা লাখো রোহিঙ্গা সাক্ষাৎ বিপদ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ে পড়ছে দেশ ও কক্সবাজার এলাকার মানুষ। সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এ বছর চাল- পেঁয়াজের মূল্য বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড করেছে। মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় এসেছে অভিনবত্ব ও অধিকতর নৃশংসতা। নতুন বছরে সবাই প্রত্যাশা করছে, নতুন ভোরের নতুন সূর্য এক সুন্দর দিনের বারতা নিয়ে আসবে। দেশবাসীকে নিয়ে যাবে সকলকে সোনালী দ্বীপের কাছে। নতুন বছরে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক, সুখী, সমৃদ্ধ ও মানবিক এক দেশের চেহারা পাবে।
চাল-পেঁয়াজের ইতিহাস সৃষ্টিকারী মূল্য বৃদ্ধি : ভেতো বাঙালির প্রধান খাদ্যশস্য চাল নিয়ে এ বছরের চালবাজি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, ক্রেতা-ভোক্তাদের করেছে দিশেহারা। সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালের শুরুর দিকে মোটা চালের দাম ছিল কেজি প্রতি ৩৮-৪০ টাকা। গত মে মাসে তা ৫০ টাকায় উঠে ছিল। নানা উদ্যোগের ফলে নভেম্বরে তা কমে ৪০-৪২ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু সর্বশেষ গত দুই সপ্তাহে দাম কেজিতে আবার ২-৩ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ টাকায়। অথচ বাজারে আসছে নতুন চাল। গত ১১ মাসে বাংলাদেশে চালের দাম বেড়েছে সাড়ে ৩০ শতাংশ। সরকারি হিসাবেই দেশে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকায়। চালের এই দরও দেশের মধ্যে নতুন রেকর্ড ছিল। টিসিবি’র বাজারদরের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, এক মাসে সরু চালের দাম বেড়েছে ২-৩ টাকা। বর্তমানে সরু চালের কেজি ৫৮-৬৮ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৫৬-৬৫ টাকা। উন্নতমানের নাজির ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৫ টাকা। বর্তমানে এই চালের কেজি ৬৪-৬৮ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৬০-৬৫ টাকা। আর মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪ টাকা। বর্তমানে এই মানের চালের কেজি ৪৪-৪৬ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৪০-৪৫ টাকা। আর বছরের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ, সাধারণ মানের মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৩০.৩৪ শতাংশ। আর উন্নতমানের মিনিকেটের দাম বেড়েছে ২৬.৯২ শতাংশ। মোটা চাল স্বর্ণা/চায়না, ইরির দাম বেড়েছে ২৩.২৯ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিবিদদের সংগঠন ‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংস (সানেম)’ এর সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক মাসে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ গরিব হয়ে গেছেন। আগে তাদের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকলেও এখন তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। সানেম বলছে, গত ২১শে ডিসেম্বরের হিসাবে চিকন চালের দাম ৫৮ থেকে ৬৮ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৪৮ থেকে ৫৬ টাকা ও মোটা চালের দাম ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যথারীতি সানেমের এ প্রতিবেদন অস্বীকার করেছেন। তবে চালের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ যে দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে সে সত্য তিনি অস্বীকার করেননি।
চালের বাইরে সাধারণ মানুষের জন্য ভিলেন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পেঁয়াজ। এক বছরে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ২৩৮.৪৬ শতাংশ। গত অক্টোবর থেকে পেঁয়াজের দাম বাড়া শুরু করে। সেপ্টেম্বরে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া দেশি পেঁয়াজ দাম বাড়তে বাড়তে অক্টোবরে ৮০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৮০-৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় দেশি পেঁয়াজ। কিন্তু নভেম্বরের শেষদিকে তা ১০০ টাকা ছুঁয়ে ফেলে। একপর্যায়ে পেঁয়াজের দাম ১৩০ টাকায় পৌঁছায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে বছরে প্রায় ২০-২২ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে।
গুম-ধর্ষণের চিত্র : বিদায়ী বছরে দেশে ৯১ জন নিখোঁজ হয়েছিলেন, তার মধ্যে ৬৫ জনের সন্ধান এখনও মেলেনি। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান দিয়ে গতকাল এক সাংবাদিক সম্মেলনে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, সার্বিক পরিস্থিতি ‘চরম উদ্বেগজনক’। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হন ৬০ জন। এর মধ্যে দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়, আটজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়, পরিবারের কাছে ফেরত আসে সাত জন। বাকি ৪৩ জনের খোঁজ মেলেনি এখনও। এছাড়া ‘রহস্যজনক’ নিখোঁজের সংখ্যা আরও ৩১ বলে জানিয়েছে আসক। তাদের মধ্যে ৯ জন ফেরত এলেও তাদের ছয়জনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; পরিবারের কাছে ফেরত গেছেন তিনজন। ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময়’ এবং হেফাজতে মোট ১৬২ জন নিহত হন। এর মধ্যে ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও গুলিবিনিময়ে’ নিহত হন ১২৬ জন।
এ বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের ২১২টি প্রতিমা, ৪৫টি বাড়ি-ঘর ও ২১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাংচুর হয়েছে। এসব ঘটনায় একজন নিহত ও ৬৭ জন আহত হন। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় সাংবাদিক, লেখকসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে টিভি টকশোসহ সংবাদমাধ্যমে লেখা ও স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য লেখক, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকারকর্মীদের হুমকি ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রভাবশালী, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা ১২২ জন সাংবাদিক শারীরিক নির্যাতন, হামলা, হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন।
যৌন হয়রানিসহ সহিংসতার শিকার ২৫৫ জনেরর মধ্যে ১২ জন নারী আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিন নারীসহ ১৩ জন খুন হয়েছেন, বখাটেদের প্রতিবাদ করায় লাঞ্ছিত হয়েছেন ১৬৮ জন ও চার মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বিদায়ী বছরে সারাদেশের ৮১৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যা ২০১৬ সালের চেয়ে বেশি। ৩০৩ জন নারী যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হন। তাদের মধ্যে ১৪৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ জন আত্মহত্যা করেন। এসব ঘটনায় ১৮৮টি মামলা হয়েছে। অন্যদিকে এ বছর এক হাজার ৬৭৫ শিশু হত্যা ও বিভিন্নভাবে নিযাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩৯ শিশু হত্যা করা হয়, আত্মহত্যা করে ১১৭ শিশু ও রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে ৩৭ শিশুর।
২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০ নবেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রায় ২২০ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৬ জনকে। গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৬ জন। পুলিশ সদর দফতরের নথি অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে মোট ৪৩ হাজার ৭০৬টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে এর মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার মামলার ১ লাখ আসামী খালাস পেয়েছেন আর ধর্ষণ মামলায় খালাস পেয়েছেন ৮৮.৩৫ শতাংশ আসামী। নারী নির্যাতন মামলায় আসামী খালাসের পরিমাণ ৯৫ শতাংশ। আবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক পরিসংখ্যান বলছে চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে ১ হাজার ৭৩৭টি ধর্ষণসহ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
গ্যাস-বিদ্যুতে দাম বৃদ্ধিতে অসন্তোষ : বিদয়ী বছরে গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদনে কিছু সাফল্যের দেখা মিললেও এগুলোর দাম বৃদ্ধিতে গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল বছরজুড়ে। বিশ্ব বাজারে পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমার পর দেশে মূল্য সমন্বয়ের যে দাবি ভোক্তাদের তরফে ছিল, সেটা তো পূরণই হয়নি; উল্টো বছরের শুরুতেই গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণায় ভোক্তা মহলে তৈরি হয় উদ্বেগ। এছাড়া বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের নয় বছরে আটবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এই দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলছে ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলো। এর প্রতিবাদে হরতাল করে বামপন্থি দলগুলো।
বিভিন্ন পক্ষের বিরোধিতা উপেক্ষা করেই বছরের শুরুতে (২৩ ফেব্রুয়ারি) গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ঘোষণা অনুযায়ী প্রথম ধাপে মার্চ থেকে আবাসিকে এক চুলার জন্য মাসে ৬০০ টাকার পরিবর্তে ৭৫০ টাকা, দ্বিতীয় ধাপে জুনে ৭৫০ টাকার পরিবর্তে ৯০০ টাকা করা হয়। দুই চুলার দাম একইভাবে প্রথম ধাপে ৬৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ এবং দ্বিতীয় ধাপে ৮০০ থেকে বাড়িয়ে ৯৫০ টাকা করা হয়। একই তালে বাড়ানো হয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানা, চা বাগান ও বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগের বিলও। তবে গত ৩০ জুলাই গৃহস্থালিতে এক বছরে দুইবার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্ট। ফলে দ্বিতীয় দফায় জুনে যে দাম বৃদ্ধি হয়েছিল তা রহিত হয়ে যায়।
২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের মূল্যহার বাড়ানোর পর এবছরের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর আবারও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ে টানা গণশুনানি হয়। ২৩ নভেম্বর পাইকারি মূল্য না বাড়ালেও খুচরায় প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়, যা ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়।
বিশ্ব বাজারে দাম কমার পর সর্বশেষ পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল-কেরোসিনের দাম কমানো হয়েছিল ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল। তবে দাম কমানোর পরও সরকারি সংস্থার বিতরণের অধীনে থাকা এই পণ্যগুলো বেশি লাভেই বিক্রি হচ্ছিল। বিশ্ব বাজারে ডিজেলের দাম কমে প্রতি ব্যারেল ২৯ ডলারে নামার পর গত জুলাই থেকে তা বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত ১১ ডিসেম্বরের আমদানি তথ্য অনুযায়ী ডিজেল এখন প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের বেশি।
ক্যাবের হিসাবে ২০১৫-’১৬ অর্থবছরে সরকারি সংস্থা বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছিল। তবে বিপিসি বলছে, বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ার কারণে ইতোমধ্যেই ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিনে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
দুর্যোগের বছর : হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যার পর ভারি বর্ষণে পাহাড় ধসের পাশাপাশি ফের মওসুমি বন্যা, সঙ্গে নিয়মিত বিরতিতে সাগরে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় মিলিয়ে বিদায়ী বছর জুড়ে দেশের সবপ্রান্তে ছিল দুর্যোগের হানা। নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে টানা বৃষ্টিপাত দেশের মধ্যাঞ্চলের মানুষকে পর্যন্ত ভুগিয়েছে। এ বছর ১১ থেকে ১৩ জুনের ভারি বর্ষণে অন্তত ১৬০ জনের মৃত্যু হয় চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজার জেলায়। এর মধ্যে রাঙামাটিতেই মৃত্যু হয় ১২০ জনের।
এপ্রিলের শুরুতে পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে আকস্মিক বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা তলিয়ে যায়। বন্যার কারণে হাওর অঞ্চলের জেলাগুলোতে ছয় লাখ টনের মতো ধান নষ্ট হয়েছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে ফসলহানির পরিমাণ ২২ লাখ টন। মানুষের দুর্গতির মধ্যে হাওর বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়েও সমালোচনা হয়। বাঁধ নিয়ে দুর্নীতির জেরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩ প্রকৌশলী বরখাস্ত, পানি সম্পদের যুগ্মসচিবসহ ৪ জনকে দুদকে তলবও করে। এ দুর্নীতির তদন্ত খতিয়ে দেখতে দুদককে নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট।
এপ্রিল মাস ছিল ৩৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিবহুল। সাধারণত এ মাসের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪ হাজার ৫৩ মিলিমিটার; কিন্তু এবার রেকর্ড ছাড়িয়ে ৯ হাজার মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষার শুরুতে ১২-১৩ জুন ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় ঢাকায়। ১৩ জুলাই ১০৩ মিলিমিটারের রেকর্ড বৃষ্টি হয়। ২৬ জুলাই রাতে মাত্র ৬৭ মিলিমিটারের বৃষ্টিতে নগরবাসীকে দিনভর পানিজট ও যানজটে ভুগতে হয়। রাজধানীর বাইরে ২০ জুলাই সীতাকুন্ডে ২৪ ঘণ্টায় ৩৭৪ মিলিমিটার; রাঙামাটিতে ১২ জুন ৩৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। ৩ আগস্ট তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই ডুবে ঢাকার অনেক সড়ক, অল্প সময়ে এত বৃষ্টিপাত ১০ বছর পর দেখে রাজধানীবাসী। ওইদিন স্বল্প সময়ে ১২৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। জুলাই-আগস্টে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সড়কে নৌকা পারাপারের দৃশ্যও ছিল কয়েকদিন নিয়মিত।
গ্রীষ্ম মওসুমে চার দফা তাপপ্রবাহের মধ্যে ছিল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাত। মে মাসের শেষদিকে গভীর নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পর কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করে ‘মোরা’। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নিয়ে আঘাত হানা এই ঝড়ে উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় বিপুল সংখ্যক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়, মৃত্যু হয় সাতজনের। এ ঝড়ে উপকূলীয় ১৬ জেলার ২ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ ক্ষতির শিকার হয়।
হাওরে আগাম বন্যার পর জুলাইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে মওসুমের প্রথম বন্যায় অন্তত ১৩ জেলার অনেক উপজেলা প্লাবিত হয়। আগস্টের বন্যায় ৩২ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পৌনে এক কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বন্যার বিস্তার কম হলেও প্রাণহানির দিক থেকে তা ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যাকে ছাড়িয়ে যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩২ জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৮২ লাখ মানুষ। পানিতে ভেসে ও বন্যাজনিত অন্যান্য কারণে মৃত্যু হয়েছে ১৪০ জনের।
বছর শুরু হতে না হতেই ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের ত্রিপুরায় রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে দেশের পূর্ব ও দক্ষিণের সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সঙ্গ রাজধানী ঢাকাসহ মধ্য ও উত্তরের অধিকাংশ জেলা কেঁপে উঠে। এসময় সুনামগঞ্জে ভূমিকম্পে ‘আতঙ্কে’ ২ জনের মৃত্যু হয়। এপ্রিলে সিলেটসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৪ দশমিক ১ মাত্রা, নভেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪ দশমিক ৭ মাত্রার মৃদু ভূ-কম্পন হয়।
প্রাকৃতিক কারণে না হলেও মিয়ানমারে সেনা নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ে বসতি নির্মাণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এরই মধ্যে ১৫০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস হয় বলে বন অধিদফতর জানায়। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বলছে, টেকনাফ রুটের গাছগুলো উজাড় হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশের ক্ষতির হিসাব অনেক বেশি। ইতোমধ্যে পর্যটন ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। অন্যান্য দুর্যোগের মধ্যে বজ্রপাতেও অর্ধশতাধিক লোকের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে মে মাসে একদিনেই মৃত্যু হয় ১৬ জনের।
প্রধান বিচারপতির নজিরবিহীন পদত্যাগ : বছরের শুরু থেকেই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগকে কেন্দ্র করে রাজনীতি ও বিচারাঙ্গন ছিল উত্তপ্ত। সরকারের উচ্চ মহল থেকে শুরু করে শহর, নগর, বন্দর পেরিয়ে মহল্লার চায়ের দোকান পর্যন্ত ছিল এ নিয়ে আলোচনা। বিদায়ী বছরে এক বিচারপতির দুর্নীতির অনুসন্ধান বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের চিঠি, বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ঐতিহাসিক রায়, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, এস কে সিনহার ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়া এবং প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ- সবই ছিল বিদায়ী বছরের আলোচনার শীর্ষে। এছাড়া বছরের শুরুতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রীক দেবীর মূর্তি স্থাপন ও সরানোর বিষয়টিও কম আলোচিত ছিল না।
২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া এস কে সিনহার মেয়াদ শেষ হতো ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ অগাস্ট তিনি শেষ অফিস করেন এবং অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর আদালত খোলার দিন থেকে ছুটিতে যান। পরে তিনি বিদেশ বসেই পদত্যাগ করেন। তার অবর্তমানে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পান বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা।
 দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ২১জন প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করলেও পদত্যাগের ঘটনা এটাই প্রথম। রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের একটির প্রধান ব্যক্তির এমন পদত্যাগ ৪৭ বছরের ইতিহাসের প্রথম ঘটনা।
বছরজুড়েই প্রশ্ন ফাঁস : এ বছর বিভিন্ন পরীক্ষা শুরুর আগেই অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উত্তরসহ প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের দুটি চক্রকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষায় জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন গ্রেফতারদের অনেকে। এসএসসিতে বিভিন্ন পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে, যা পরদিন পরীক্ষায় হুবহু মিলে যায়। এই ধারাবাহিকতায় নভেম্বরে অনুষ্ঠিত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ব্যাপকতা পায়। প্রথম দিকে অর্থের বিনিময়ে ফেইসবুক মেসেঞ্জারে শিক্ষার্থীদের কাছে আগের রাতেই প্রশ্ন আসা শুরু করলেও এক পর্যায়ে বিভিন্ন ফেইসবুক পেইজ ও গ্রুপে উত্তরসহ প্রশ্নপত্র তুলে দেয়া হয় বিনামূল্যে। কেউ কেউ আবার আগামী বছর অনুষ্ঠেয় এএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে নার্সিং পরীক্ষারও।
প্রশ্ন ফাঁস ছাড়াও ভুল প্রশ্নের কারণে বছরজুড়েই সমালোচনায় ছিল বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা। এর মধ্যে জেএসসির ইংরেজি সংস্করণের ‘গার্হস্থ্য অর্থনীতি’ বিষয়ের সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনী প্রশ্নে ১২টি ভুল পাওয়া যায়। পরে পিইসির সিলেট অঞ্চলের ইংরেজি সংস্করণের ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিতি’ বিষয়ের প্রশ্নে অর্ধ শতাধিক ভুল ধরা পড়ে। ওই প্রশ্নপত্রটির ৫০টি নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের মধ্যে ৪০টিতেই ভাষা ও ব্যাকরণগত ভুল ছিল। এসব নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
দুর্নীতিবাজদের ‘আতঙ্কের’ বছর : বছরের শুরুতে দুর্নীতিবাজদের জন্য ২০১৭ সালটি ‘আতঙ্কের’ বছর হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। বছরজুড়ে বিভিন্ন সরকারি অফিসে ফাঁদ পেতে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতারে ‘রেকর্ডও’ গড়ে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। কিন্তু বিপরীত দিকে দুর্নীতির নিয়মিত মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা যেমন আগের বছরের চেয়ে কমেছে, তেমনি মামলা, আদালতে অভিযোগপত্র ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে ভাটার টান।
দুদক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ফাঁদ পেতে ৩৯ আসামীকে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়, ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৩ জন। আর ২০১৫ সালে চার ও ২০১৪ সালে পাঁচ জনকে ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতার করে দুদক। ২০১৬ সালের তুলনায় এ বছর নিয়মিত মামলায় আসামী গ্রেফতারের সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ২০১৬ সালে যেখানে মোট ৩৮৮ আসামীকে গ্রেফতার করা হয়, সেখানে এবছর গ্রেফতার ১৭৯ জন।
তবে বেশ কয়েকজন আসামীকে গ্রেফতারের খবর বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল। এদের মধ্যে ১৮ জুলাই নৌ-পরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ১ জুলাই সিটিসেলের সিইও মেহবুব চৌধুরী, ৮ জানুয়ারি সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঢাকা অঞ্চলের এস্টেট ও আইন কর্মকর্তা উপ-সচিব মো. মিজানুর রহমানকে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে দুদক। এছাড়া ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এইচএম তায়েহীদ জামানসহ তিন কর্মকর্তা, ৯ ফেব্রুয়ারি রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল উদ্দিন চৌধুরী, হাওর রক্ষা বাঁধ দুর্নীতির মামলায় ২ জুলাই সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফছার উদ্দীনকে গ্রেফতার করা হয়।
এ বছরের শুরুতে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রথম বারের মত পাঁচ বছর মেয়াদী ‘কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা’ হাতে নেয়, যার ধারাবাহিকতায় বছরের মাঝামাঝিতে ‘হটলাইন ১০৬’ চালু করে। এছাড়া বছরটিতে নিজস্ব হাজতখানা, সশস্ত্র পুলিশ ইউনিট, গোয়েন্দা ইউনিট গঠন করেছে সংস্থাটি। এসব উদ্যোগ দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে মনে করে দুদক। এবছর দুদকের ‘শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম’ রাজধানীর বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ৫২২ জন শিক্ষকের বদলি, কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ৯৭ জন শিক্ষকের শাস্তি, প্রশ্নফাঁস হওয়াসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস তুলে ধরে সরকারের কাছে ৩৯টি সুপারিশ করেছে। দুদকের এই উদ্যোগটি বছরের শেষ দিকে আলোচনায় উঠে আসে।
আলোচিত বেসিক ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৫৬টি মামলা হলেও কোনোটিতেই ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে আসামী করা হয়নি। তবে চার বছর আগে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে অভিযোগের মুখে থাকা বাচ্চুকে এবছরই দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। প্রথমবারের মত গত ৪ ডিসেম্বর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদক নতুন করে ২০১৮ সালে আরো কিছু মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
২০১৭ সালের নারী : বাঙালি নারীর ইতিহাসে ২০১৭ সাল গৌরবের। এ বছরই বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ হয়েছে। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ-২০১৭-এর তথ্য অনুসারে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে নারী বৈষ্যমের হার সবচেয়ে কম। এ তথ্য অনুসারে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭ নম্বরে। এ বছরের ইনডেক্স তৈরি করা হয়েছে চারটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে-অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ ও অংশগ্রহণের সুযোগ, শিক্ষাবিষয়ক অর্জন, স্বাস্থ্য ও মৃত্যুর হার এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। সফলতায় দেশ, তথা বহির্বিশ্বে এদেশের নারী তার দৃঢ় অবস্থান বজায় রেখেছে। এ বছরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিদেশী গণমাধ্যম দিয়েছে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাব। তাঁর সুদৃঢ়, ও সুকৌশলী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এ বছরই পিপলস্ এন্ড পলিটিক্স নামক এক এ্যাসোসিয়েশন ১৭৩টি দেশের মধ্যে তাঁকে তৃতীয় দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ফোর্বস প্রকাশিত বিশ্বে প্রভাবশালী নারী হিসেবে তার অবস্থান ৩০তম। শুধু দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নয় বহির্বিশ্বেও রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশী নারীরা। এ বছরই দ্বিতীয় মেয়াদে বৃটেনের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ সিদ্দিকী। তিনি বৃটিশ পার্লামেন্টে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড এ্যান্ড কিলবার্ন আসনের প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং বৃটিশ সরকারের ছায়ামন্ত্রী হিসেবে আছেন। এছাড়াও বৃটিশ র্পার্লামেন্টে উত্তর পশ্চিম লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল এ্যান্ড একটন আসনে লেবার পার্টি থেকে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রুপা হক। এবং তৃতীয়বারের মতো লন্ডনের বেথনান গ্রিন এন্ড বো আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন বাংলদেশী বংশোদ্ভূত রুশনারা আলী।
জুন মাসে বাংলাদেশ অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারর্সন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অটিজম ডিজঅর্ডার বিষয়ে বিশ্বখ্যাত চ্যাম্পিয়ন হিসেবে অভিহিত হয়েছেন এবং সংস্থাটির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। মহাকাশে সহজে ব্যবহার করা যাবে এমন ছোট ও যুগান্তকারী প্রযুক্তির যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য নাসাতে কর্মরত বাংলদেশী বিজ্ঞানী মাহমুদা সুলতানা জিতে নিয়েছেন ২০১৭ সালের নাসার সেরা উদ্ভাবন পুরস্কার। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সাহসী ভূমিকার জন্য মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘ইন্টারন্যাশনাল ওমেন অব কারেজ’ পুরস্কার লাভ করেন শারমীন আক্তার। এ বছর ক্রীড়াঙ্গনেও এগিয়ে রয়েছে মহিলারা। ২৪ ডিসেম্বরে ১-০ গোলে ভারতকে হারিয়ে সাফ অনুর্ধ ১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়ানশিপের শিরোপা জিতেছে স্বাগতিক বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বৈমনিক হিসাবে যাচ্ছেন নাইমা হক ও তামান্না-ই-লুৎফী। এ বছরের ৭ ডিসেম্বর তারা কঙ্গোর উদ্দেশ্যে রওনা করেন।
২০১৭ সালে সারাবিশ্বে আলোচনা কিংবা সমালোচনার মধ্যমণি হয়েছেন মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকারের উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী আউং সান সুচি। এ বছর সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন ও শত শত গ্রাম ধ্বংসের সময় রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি অভিযুক্ত হন। জর্জ মনবিও দ্য গার্ডিয়ানে তার লেখায় সুচির নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চেঞ্জ ডট অর্গে একটি পিটিশনে সই করতে পাঠকদের অনুরোধ জানান এবং বলেন ‘পক্ষপাতিত্বই হোক বা ভয়েই হোক, সুচি অন্যদের স্বাধীনতার অধিকার অস্বীকার করছেন, যে স্বাধীনতা এক সময় তিান নিজের জন্য চেয়েছিলেন।’ শান্তিতে আর এক নোবেলজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুও সুচির নীরবতার সমালোচনা করেছেন। এ বছর রাজনীতির আলোচনা ও প্রশংসায় রয়েছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে বৃটেনের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এবং ২০১৭ সালে পুননির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তিনি।
যাদের বিদায়ে ‘বিষণ্ণ’ বছর : বিদায়ী বছরে আমরা অনেককে হারিয়েছি, যা অনেকের মনে ক্ষতের সৃষ্টি করে। শোকাচ্ছন্ন করে স্বজন ও শুভাকাংখীদের। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বর্ষীয়ান রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমলা থেকে পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার গত ২৪ অক্টোবর ৮৫ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মুহাম্মদ ছায়েদুল হক (৭৫) ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহান বিজয় দিবসের দিন ১৬ ডিসেম্বর সকালে চিরপ্রস্থান করেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী গত ১৪ ডিসেম্বর দিনগত রাত তিনটার দিকে নগরীর বেসরকারি ম্যাক্স হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। টিভি ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ‘স্বপ্নবাজ’ মেয়র আনিসুল হক গত ৩০ নভেম্বর লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা আহমেদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ ডিসেম্বর সকাল পৌনে নয়টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এছাড়া ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রের নায়করাজ রাজ্জাক ২১ আগস্ট, ‘আগে যদি জানতাম’ খ্যাত সুরকার, সংগীত পরিচালক ও গায়ক লাকী আখন্দ ২১ এপ্রিল, কিংবদন্তীর আরেক সংগীত শিল্পী আবদুল জব্বার ৩০ আগস্ট, বংশীবাদক ও সংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী ২৪ নভেম্বর, গুণী অভিনেতা মিজু আহমেদ ২৭ মার্চ এবং চলচ্চিত্র ও নাটকের প্রবীণ অভিনেতা নাজমুল হুদা বাচ্চু ২৮ জুন এ দুনিয়া ত্যাগ করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বলিউড অভিনেতা ওমপুরি ৬ জানুয়ারি, বলিউড অভিনেত্রী রিমা লাগু ১৮ মে, আরেক বলিউড অভিনেতা ইন্দর কুমার, বিনোদ খান্না ২৭ এপ্রিল, বলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শশী কাপুর ৪ ডিসেম্বর, মার্কিন অভিনেতা রজার মুর ২৪ মে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাউন্ডগার্ডেন’ এবং ‘অডিওসেøভ ব্যান্ডের’ লিড ভোকাল ক্রিস কর্নেল ১৮ মে মারা যান।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ