বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

জাতীয় স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের ঢল

 

মো. শামীম হোসেন, সাভার থেকে : হাতে লাল-সবুজের পতাকা আর রঙ বেরঙের ফুল, হৃদয়ে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিয়ে গতকাল শনিবার কূয়াশা ¯œাত ভোর থেকে লাখো মানুষের ঢল নামে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে। দেশের বীর সন্তানদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার ফুলে ফুলে ঢেকে যায় রাজধানীর অদূরে অবস্থিত স্মৃতিসৌধের পাদদেশ। স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের জমায়েতে ছিল ছেলো-বুড়ো, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরি এবং গণতন্ত্রকামী মানুষ। 

প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসের সূচনা হয়। পূব আকাশে সূর্য উঁকি দেওয়ার পর সকাল সাড়ে ৬টার কিছু পরে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের উদ্দেশে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে প্রথমে শ্রদ্ধা জানান প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্ব মানচিত্রের অন্যতম বিষ্ময় বাংলাদেশের মহান বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকীর সকালে বিএনপি চেয়ারর্পাসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও সাভারের স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। এছাড়া সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

 প্রেসিডেন্ট ভোর ৬ টা ৩৫ মিনিটে স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের শ্রদ্ধা জানান। এসময় তিন বাহিনীর সুসজ্জিত একটি দল তাকে প্রদান করে গার্ড অব অনার। বিউগলে বেজে ওঠে করুন সুর। তিনি কিছুক্ষণ নীরবে দাড়িঁয়ে শহীদদের স্মরণ করেন। প্রায় একই সময় প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে লাখো শহীদের শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর আনুষ্ঠানিকতা। পরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করে ৬টা ৪৮ মিনিটে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকা ত্যাগ করেন। এ সময় জাতীয় সংসদের স্পীকার, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, কূটনীতিক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর আমন্ত্রিত সদস্যসহ সামরিক ও বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। এরপরই জাতীয় পার্টির (এ) চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এইচ এম এরশাদ দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্মৃতিসৌধ এলাকা ত্যাগের সাথে সাথেই পরই লাখো জনতার ঢল নামে। বেলা ১১টা ৫ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দলের নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে লাখো শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এসময় তার সাথে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী সহ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, ফজলুল হক মিলন, রুহুল কুদ্দস তালুকদার দুলু, নাজিম উদ্দিন আলম, মীর সরফত আলী সপু, সাইফুল ইসলাম নিবর, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, শফিউল বারী বাবু, রাজীব আহসান প্রমুখ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ঢাকা জেলা বিএনপি ডা. দেওয়ান মো.সালাউদ্দিন বাবু, সাভার থানা বিএনপির সভাপতি মাহমুদুল হাসান আলালসহ দলের সহযোগী সংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীর সমাবেশ ঘটে সেখানে। বেলা বাড়লে ভিড় বাড়তে থাকে বিএনপি নেতাকর্মীদের। তাদের হাতে হাতে পোস্টার আর গায়ে খালেদা-তারেক আর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হতে ইচ্ছুক নেতাদের ছবি আঁকা গেঞ্জিতে ভরে ওঠে আশপাশ। খালেদা আসতেই অভিনব ভঙ্গিমায় ছাতা মেলে ধরেন অনেকে। সে ছাতায় সাভার থানা-বিএনপি সভাপতির ছবি সাঁটা।

তবে একের পর এক সম্ভাব্য প্রার্থী তাদের প্রার্থীতার কথা জানান দিতে চেষ্টার কমতি করেননি কোনো। মাথায় ক্যাপ, গায়ে গেঞ্জি আর হাতে ধরা ছাতা নিয়ে খালেদার গাড়ি ঘিরে ধরেন। এভাবে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেবার পাশাপাশি খালেদার চোখে বা নেক নজরে পড়ার জন্য মরিয়া মহড়া দিলেন তারা। এর আগে খালেদা জিয়া স্মৃতিসৌধে পৌঁছার আগে থেকেই স্থানীয় নেতাকর্মীরা স্মৃতিসৌধে জড়ো হন। প্রায় আধঘণ্টা আগে স্মৃতিসৌধের পাদস্থান থেকে মহাসড়ক পর্যন্ত একপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা। নেতা-কর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলে গোটা এলাকা। এ উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ সময় সাভার স্মৃতিসৌধ ও এর আশপাশে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।  

সকাল নয়টায় সংগঠনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শুকুর আলী শুভর নেতৃত্বে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) নেতৃবৃন্দ ও সদস্যরা বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় ডিআরইউ সহ-সভাপতি গ্যালমান শফি, সাংগঠনিক সম্পাদক নূরুল ইসলাম হাসিব, দফতর সম্পাদক মোঃ জেহাদ হোসেন চৌধুরী, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল হক ভূঁইয়া, সাংস্কৃতিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী, আপ্যায়ন সম্পাদক কামাল উদ্দিন সুমন, কল্যাণ সম্পাদক কাওসার আজম, কার্যনির্বাহী সদস্য জান্নাতুল ফেরদৌস পান্না, মো. জাফর ইকবাল ও এস এম এ কালাম উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ডিআরইউ সদস্য আমান-উদ-দৌলা, সেলিম সামাদ, ইকরামুল কবীর টিপু, আবু সালেহ আকন, মো. সরোয়ার আলম, আব্দুল লতিফ রানা, মো. কামরুজ্জামান খান, মোহাম্মদ আল আমিন, ফজলুর রহমান প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়াও জাসদ, সিপিবি, ওয়ার্কার্সপার্টি, বাসদ, সাম্যবাদীদল, গণতন্ত্রী পার্টি, গণফোরাম, জাতীয়পার্টি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযোদ্ধা’৭১, যুবদল, যুবইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, কৃষকলীগ, কৃষকদল, কৃষক সমিতি, ক্ষেতমজুর সমিতি, বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কর্মসংস্থান ব্যাংক নির্বাহী কর্মকর্তা কর্মচারী, বিএলআরআই, শেখ হাসিনা জাতীয় যুব কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি সহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ফুল দিয়ে একাত্তরের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। পৌষের সকালে বিপুল সংখ্যক মানুষ ফুল হাতে আসেন। লাখো মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভরে যায় স্মৃতিসৌধ।

এদিকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ছবি সম্বলিত অস্থায়ী স্থিরচিত্র প্রদর্শনী। তবে স্মৃতিসৌধের মূল নকশা অনুসারে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, লাইব্রেরি ও স্থায়ী ম্যুরালসহ বেশ কিছু স্থাপনা নির্মিত না হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন অনেকে।

১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকীতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে রয়েছে সাতটি স্তম্ভ, অজ্ঞাতনামা শহীদদের কবর ও লেক এবং সুবিশাল সবুজ ভূমি। তবে প্রণীত নকশা অনুসারে পূর্ণতা পায়নি জাতীয় স্থাপনাটি। তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, লাইব্রেরি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত স্থায়ী ম্যুরালসহ বেশ কিছু স্থাপনা নির্মিত হয়নি। তবে দু’টি ম্যুরালের একটির দেয়াল তৈরি হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে অযতেœ-অবহেলায় পড়ে আছে দেয়ালটি। তবে মহান বিজয় দিবসে একদিনের জন্য দৃষ্টি কেড়েছে ম্যুরাল দেয়ালটি। ঢাকা জেলা পুলিশ অস্থায়ীভাবে সেখানে স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে এসে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার আলোকচিত্র দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম।

এ বিষয়ে সাভার গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, ম্যুরাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই প্রদর্শনের জন্য তৈরি করা হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ