শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

তবুও পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির রহস্য কি?

* দেশে চাহিদা ২২ লাখ টন
* উৎপাদন ২১ লাখ ৫৩ হাজার টন
* আমদানি ১১ লাখ ৫ হাজার টন
এইচ এম আকতার: পেঁয়াজের ঝাঁঝে ক্রেতার চোখের পানি থামছে না। ঊর্ধ্বমুখী দামে নিত্যপণ্য পেঁয়াজ ক্রেতার নাগালের বাইরে। দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২২ লাখ টনের মতো। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ২১ লাখ টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, এর বাইরে প্রতি বছর আমদানি হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিএইর এ তথ্য হিসাবে নিলে দেশে পণ্যটির বার্ষিক সরবরাহ ২৯ থেকে ৩২ লাখ টন। প্রশ্ন হলো এত পেঁয়াজ গেলো কোথায়। উদ্বৃত্ত সরবরাহ সত্ত্বেও প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে অস্থির হচ্ছে পেঁয়াজের বাজার। চলতি বছরও আকাশ ছুঁয়েছে পণ্যটির দাম।
জানা গেছে, দেশে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন বাংলাদেশের পেঁযাজের বাজার ভারতনির্ভর। আসলে এটি সঠিক নয়। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী শ্রেণী এ গুজব ছড়িয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। তাদের ভাষায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি না করলে বাংলাদেশ চলবে না। তাদের ভাষায় দেশের আমদানি করা অধিকাংশ পেঁয়াজ আসে ভারত থেকে।
কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে উল্টো কথা। এতে দেখা যায় মাত্র ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। বাকি চাহিদা দেশীয় পেঁয়াজ দিয়েই পূরণ করা সম্ভব। অথচ প্রতি বছর ভারত থেকে প্রায় ১০-১২ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। প্রশ্ন হলো চাহিদার অতিরিক্ত ৮ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ যায় কোথায়। এর বাহিরেও অবৈধ পথে ভারত থেকে পেঁয়াজ আনা হয়ে থাকে। তাহলে কেন বলা হয় বাংলাদেশ ভারতনির্ভর। এ তথ্য দিয়ে কারা ফায়দা লুটছে। পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। তাহলেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। তা না হলে তাদের ইচ্ছা মতই বাজার উঠা নামা করবে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকালও প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২০-১৩০ টাকায়। খুচরা বাজারে কোথাও তা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা। একই পেঁয়াজ এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল ১১০-১২০ টাকায়। অর্থাৎ সরকারি হিসাবেই সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরায় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ২৫ টাকা পর্যন্ত।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ডিএইর হিসাব অনুযায়ী চাহিদার প্রায় কাছাকাছি পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে দেশে। এর ওপর আমদানিও করা হচ্ছে। উৎপাদন ও আমদানির এ তথ্য হিসাবে নিলে উদ্বৃত্ত সরবরাহে পেঁয়াজের দাম কমে আসার কথা। যদিও বাজারে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। প্রতি দিনই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু বাজারে তার কোন প্রভাব নেই।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুন্সী সফিউল হক বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উৎপাদনের তথ্য পুরোপুরি সঠিক নাও হতে পারে। কারণ এরই মধ্যে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। উৎপাদন সাড়ে ২১ লাখ টন হলে এত আমদানির পর বাজার স্থিতিশীল হওয়ার কথা, কিন্তু সেটি হচ্ছে না। ফলে উৎপাদন ও চাহিদার তথ্যে কোথাও দূরত্ব রয়েছে। সেটি দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে মন্ত্রণালয়। এর বাইরে কেউ কারসাজি করে থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে দামের যে অস্বাভাবিক ব্যবধান, সেটিও কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু সেই উদ্যোগ কাজে আসেনি। এর অন্যতম কারণ হলো বাজার মনিটরিং না থাকা। সরকার যদি নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতো তাহলে পেঁয়াজের বাজার এতটা লাগামহীন হতো না। সরকার বলছে বাজার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। তাদের যুক্ত হলো সরবরাহ কম থাকার কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
ডিএইর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর দেশে ২ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের উৎপাদন হয় ২১ লাখ ৫৩ হাজার টন। আর চলতি অর্থবছর উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২১ লাখ ৬০ হাজার টন। এ হিসাবে চাহিদার প্রায় শতভাগ দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের মাধ্যমে পূরণ হওয়ার কথা।
যদিও ডিএইর হিসাবের সঙ্গে মিলছে না বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ১৭ লাখ ৩৫ হাজার টন। বিবিএসের কর্মকর্তারা বলছেন, গত অর্থবছরের উৎপাদন এর চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে উৎপাদন দাঁড়ায় ১৯ লাখ টনের কিছু বেশি।
বিবিএসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী বিবিএসের তথ্যকেই গ্রহণযোগ্য মনে করতে হবে। যে তথ্য ডিএই ও বিবিএস যৌথভাবে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করছে, সেটি বাড়িয়ে বা কমিয়ে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেই।
যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সরেজমিন উইং) অঞ্জন কুমার বড়ুয়ার দাবি, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মাঠপর্যায়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তারা মোট আবাদ ও উৎপাদনের হিসাব করে থাকেন। তাদের তথ্যে গরমিলের সুযোগ নেই।
তবে বিবিএসের পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি তথ্য বিবেচনায় নিলেও চাহিদার উদ্বৃত্ত জোগান থাকে পণ্যটির। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছর দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয় ৭ লাখ ৩৭ হাজার টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছর জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি হয় ১১ লাখ ৫ হাজার টন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই (জুলাই-নভেম্বর) পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬৬ টনের।
জানা গেছে, চালের পর এবার পেঁয়াজের বাজারে চালের সিন্ডিকেট সক্রিয় হযে উঠেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই সরকারের কোন উদ্যোগ। এতে করে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের বাজার। মজুদ সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে না পারলে এই বাজার আরও লাগামহীন হয়ে পড়বে।
দাম বাড়ার কারণ হিসাবে পাইকারী ও খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ী বলছে, একদিকে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশে বৃষ্টির কারণে প্রচুর পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে মোকামগুলোতে বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মজুদ রেখেছে। এছাড়া আমদানি খরচও বেড়েছে। ফলে হু হু করে দাম বেড়েছে।
এসব সিন্ডিকেটের গুদামে মজুদ রয়েছে কয়েক লাখ টন পেঁয়াজ। হঠাৎ করে পেঁয়াজের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তারা আমদানি মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত দিচ্ছে। অথচ অন্তর্জাতিক বাজারে পেঁয়াজে দাম বাড়েনি। সরকার চাইলে ভারত ছাড়া অন্য কোন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে পারে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই।
 মোকামের আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে প্রায়ই এমন অভিযোগ শোনা যায়।
জানা গেছে,ভারতই বাংলাদেশের পেঁয়াজ,রসুন,আদা, মরিচসহ মসলার বাজার নির্ভর করে। ভারতের বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়লেই বাংলাদেশের বাজারেও বাড়তে থাকে। ব্যাখ্যা একটাই ভারতের বাজারে দাম বেড়েছে। একটি দেশ এভাবে একটি প্রতিবেশি দেশের ওপর নির্ভর করতে পারে না। আর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণেই তাদের ইচ্ছামত দাম বাড়ে দাম কমে।
সূত্র মতে, বাংলাদেশে এসব পণ্যের যে বছর ফলন ভাল হয় সে বছর  ভারতেই পণ্যের আমদানি মূল্যও কম থাকে। এতে করে দেশি পণ্যের তুলনায় ভারতীয় পণ্যের দাম কম থাকে। আর এ কারণে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। এতে করে স্থানীয় উৎপাদনকারকরা লোকসানের সম্মুখীন হয়। ফলে পরবর্তী বছর  ঐ পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ হারায়। এতে পণ্যটির মূল্য বাড়তে বাধ্য।
এ বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে ভারতীয় কৃষকরা পেঁয়াজের দাম কম হওয়ার কারণে রাস্তায় ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল মাত্র ৫ টাকা। বাংলাদেশের বাজারে তাদের পেঁয়াজ তখন বিক্রি হয়েছে ২০-২৫ টাকায়। মাত্র ৪ মাসের ব্যবধানে এমনকি হলো সে পেঁয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০-১৪০ টাকা।
ভরতের ৪টি রাজ্যে আগাম বন্যা হলেও পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এমন রাজ্যে কোন বন্যা হয়নি। তাছাড়া শীত মওসুমেই সারা বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। ভারত আর বাংলাদেশে বছরে এক মওসুমেই এই পেঁয়াজের উৎপাদন হয়ে থাকে। তাহলে চলতি বছরের জুন মাসের বন্যায় পেঁয়াজের ওপর কোন প্রভাব পড়ার কথা নয়। এতে বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় এই দাম বৃদ্ধির পেছনে দুই দেশের সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে। কিন্তু এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের দায় কার। সরকার যদি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি না করে বিকল্প কোন দেশ থেকে আমদানি করতে পারে তাহলেই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে পড়বে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ধুপখোলা বাজারে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে রীতিমতো মাথায় হাত পলাশ নামে ক্রেতার। তিনি বলেন, পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে আগে গৃহিনীর চোখে পানি আসতো। এখন পানি ক্রেতার চোখে। কারণে এত বেশি দাম আগে কেউ পেঁয়াজের দেখেনি। এ নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ থাকলেও তা প্রকাশ পাচ্ছে না।
আমদানি করা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বড় ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা লোভের অভিযোগ সামনে আনছেন আড়তদাররা। তারা বলছেন, মূলত আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে বড় ব্যবসায়ীরা দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সঠিকভাবে বাজার মনিটরিংয়ের অভাব এই জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা।
নিম্ন আয়ের মানুষের দাবি সরকার খোলা বাজারে আতপ চাল বিক্রি করলেও তার কোন ক্রেতা নেই। এসব ট্রাকে সরকার  পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারে। এতে করে পেঁয়াজের বাজার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু সরকার তা না করে দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
ক্রেতাদের অভিযোগ সরকার যদি মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার না করে তাহলে এ পণ্যটির দাম আরও বাড়বে। কারণ নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে আরও তিন মাস সময় লাগবে। এর আগে পেঁয়াজের দাম কমার কোন সুযোগ নেই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ