শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সমকালীন বাস্তবতা ও আমাদের করণীয়

জুয়াইরিয়া জয়নব : দিনাজপুরে ১৪ বছরের কিশোরী ইয়াসমিন। ১৯৯৫ সালের ২৪শে আগস্ট বিপথগামী কিছু পুলিশ সদস্যের হাতে নির্মমভাবে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয় এ কিশোরী। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতাকে দমাতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে সাতজন নিরীহ মানুষকে। সেই থেকে ২৪ শে আগস্ট জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে  আসছে। ২২বছরের এই দীর্ঘ সময়ে এই দিবসকে কেন্দ্র করে কম কর্মসূচি বাস্তবায়িত  হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, আজ ২০১৭ সালে এসেও নারী নির্যাতনের কমতি তো দেখি-ই না বরং আরো নৃশংস হত্যা ও সংখ্যাধিক্যের ভয়াবহ মাত্রা দেখতে পাই।
ইয়াসমিনের সেই ঘটনামূল দিনাজপুরেই ধর্ষণের হার বেড়েছে কয়েক গুণ। গত তিন বছরের পরিসংখ্যানে  এসব ঘটনার ৫৬ শতাংশ ভিকটিম-ই আবার শিশু। শুধু দিনাজপুরেই নয়, সারা দেশেই বেড়েছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন গণধর্ষণের ঘটনা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে সারা দেশে জানুয়ারি থেকে জুন ২০১৭ পর্যন্ত ২৮০ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে ১৬ জন নারী ধর্ষণের পর হত্যা ও একই সময়ে ২৪৫ জন শিশুকে হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে দেখা যায় যে, দশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিবাহিত জীবনে কোন না কোন সময়ে আর্থিক, পারিবারিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার ৮০ দশমিক ২ ভাগ নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে..
২৪ শে আগষ্ট জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের পাশাপাশি ২৫ শে নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস ধরে বাংলাদেশেও এখন নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটিকে কেন্দ্র করে আনুষ্ঠানিকতার শেষ নেই। কিন্তু সঠিকভাবে বাড়ছেনা কার্যকরী কোন পদক্ষেপের হার। নারী নির্যাতন বৃদ্ধির পিছনে যে কারণগুলো অনেক বেশী কাজ করছে, তা হলো-
- বেশীর ভাগ ঘটনারই কোনো সুষ্ঠু বিচার হয়না। বরং বিচারহীন এইসব অমীমাংসিত ঘটনা নির্যাতনকারীদের সাহস আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
- বর্তমান সমাজের নৈতিক অবক্ষায় ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব ও এইসব অনাকাক্সিক্ষত  ঘটনার জন্য দায়ী।
- নানা ধরনের অপসংস্কৃতি বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন, মিডিয়ায় নারীদের অমর্যাদাকর উপস্থাপন-এইসব বিষয়ই নারীদের প্রতি সহিংসতার হার বাড়িয়ে দিচ্ছে।
- নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আরো বড় একটি বাস্তব কারণ হচ্ছে-অধিকাংশ নারীই নিজের নারীত্বের সঠিক মর্যাদা  ও অধিকারের বিষয়ে অসচেতন।সমাজের প্রচলিত তথাকথিত নারী স্বাধীনতার চেতনা অনুসরণ করতে গিয়ে বিয়ে নারীর প্রকৃত মর্যাদা, শালীন অবস্থান, বুনিয়াদী দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে বেশিরভাগ নারীই আজ নিজের প্রকৃত সম্মান  হারিয়ে ফেলছেন।
এছাড়াও শুধুমাত্র শারীরিক নির্যাতন নয় বরং মানসিক বহুমুখী  নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা অহরহ। যেসব ঘটনার প্রকৃত চিত্র বা পরিসংখ্যান কোন খবরে আসেনা।
মহান স্রষ্টার অপূর্ব এক নিয়ামত নারী। সভ্যতার বিনির্মাণে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান অনন্য ও অনস্বীকার্য।  রাসূল (স) স্বয়ং সমাজে নারীর প্রকৃত মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে প্রচলিত জাহেলী রসম- রেওয়াজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। কন্যা সন্তান জীবন্ত প্রোথিতকরণ, নারীকে নিয়ে দেহব্যবসা করানোর মতো ঘৃণ্য অপকর্মকে আল্লাহর রাসূল (সা) সমূলে উৎপাটিত করেছিলেন সমাজ থেকে। মুসলমানদের মনে আল্লাহভীতি উৎসারিত নৈতিক মূল্যবোধ এতটাই দৃঢ় ছিল যে, আমরা দেখি ব্যভিচারের শাস্তি পাথরাঘাতে মৃত্যুদন্ড একথা জেনেও একজন নারী নিজে এসে রাসূল (সা) এর কাছে অপরাধ স্বীকার করে নিজের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে নেয়।
আজকের এই আধুনিক সমাজের জন্য পনেরশত বছর আগের মুহাম্মদ (সা) এর গড়ে তোলা সেই ইসলামী সমাজ অনুসরণীয় মডেল হতে পারে। ইসলামী শরীয়ত প্রদত্ত পর্দা প্রথার উন্নত নৈতিকতা, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে নারীর জন্য প্রদত্ত ইনসাফপূর্ণ অধিকার ব্যবস্থা, ব্যভিচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি- এ সবই নারীকে দিতে পারে সঠিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সুনিশ্চিত গ্যারান্টি।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আজ আমাদের এই বিষয়গুলোর দিকে সচেতন দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন -
- নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া। কুমিল্লার তনু হত্যার অমীমাংসিত ঘটনা অথবা বগুড়ার ধর্ষিতা মা-মেয়ের ন্যাড়া মস্তক আমাদের তুফান সরকারের মত প্রভাবশালী অপরাধীদের নির্লজ্জ্ব দাপটের সামনে বিচার বিভাগের অসহনীয় দুর্বলতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা চাই না যে ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তির।
- সন্তানদের বিপথগামীতা থেকে রক্ষা করতে সুষ্ঠু পারিবারিক শিক্ষা, নৈতিকতার চর্চা, মূল শিক্ষা ব্যবস্থায় যথার্থ নৈতিক শিক্ষা প্রদান আজ সময়ের দাবী। সেই সাথে প্রয়োজন ধর্মীয় অনুশাসনের যথার্থ অনুসরণ করা।
- নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষদের ভূমিকার চাইতে নারীর ভূমিকা ও করণীয় অনেক বেশি। একজন নারীকে এক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোতে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন -
১. নিজের মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়ে নিজেকে সচেতন থাকা।
২. ঘরে ও বাইরে নিজের শালীন বহিঃপ্রকাশ নিশ্চিত করা।
৩. সকল ধরনের অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
৪. নারী হিসেবে নিজের বুনিয়াদী দায়িত্ব পালন করে সমাজে নিজের অধিকার সুনিশ্চিত করা।
৫. নিজ পরিবার,স্বামী,সন্তানকে নারীর প্রকৃত মর্যাদা ও অধীকার দেয়ার বিষয়ে সচেতন করে তোলা।
নারী নির্যাতনমুক্ত একটি সমাজ গড়তে হলে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া সময়ের অনিবার্য দাবি। তাহলেই দিবসটির যথার্থতা মূল্যায়ন করা সম্ভব।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ