এনভিসিতে বাধ্য করা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানরা অস্তিত্ব সংকটে
কামাল হোসেন আজাদ/ শাহজালাল শাহেদ/ শাহনেওয়াজ জিল্লু, কক্সবাজার : মিয়ানমারের আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানরা চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। কোনভাবেই নমীয় হচ্ছে না বর্মী প্রশাসন। সংকট সমাধানে বাংলাদেশ প্রেরিত প্রস্তাবের পাল্টা প্রস্তাবে সংঘাতের পথে হাটছে মিয়ানমার। রীতিমতো উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়াচ্ছে মগসেনারা। পাড়া-মহল্লাভিত্তিক বৌদ্ধদের সশস্ত্র সংগঠন নাডালাও পিছিয়ে নেই নিরীহ মুসলমান নির্যাতনে। নয়া সেনাপ্রধান সাফ জানিয়েছেন, স্বদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের থাকতে হবে বৌদ্ধদের দয়া সমর্থন নিয়ে। এমন ঘোষণার পর থেকে কট্টর বৌদ্ধ শাসিত দেশটিতে উগ্রপন্থীরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চরমভাবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নিরপরাধ নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষে কোন সমর্থনই যেনো মিলছে না রাজ্যটি থেকে। কৌশলি বর্মী সরকার একতরফা বৌদ্ধ ধর্মানুসারি উগ্রপন্থীদের পক্ষালম্বন করে মুসলমানদের আষ্টে-পিষ্টে বেঁধে বাঙ্গালি প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এমনকি তাদের হাতে এনভিসি কার্ড তুলে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মুসলমান জাতটি মুছে দিতে রোহিঙ্গাদের পেছনে জুড়ে দেয়া হচ্ছে “সন্ত্রাসী” তকমা।
সূত্রমতে, বার্মার আরাকান রাজ্যে সেনাবাহিনী, বার্মা পুলিশ এবং উগ্রবাদী কিছু বৌদ্ধ সন্ত্রাসী ২৫ আগস্ট থেকে সেনা অভিযানের নাম করে নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ করে। এতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান নিহত হন। ধর্ষণের শিকার হন অসংখ্য রোহিঙ্গা মা-বোন। অগণিত রোহিঙ্গা গুলীবিদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং অনেকেই কিছুটা সুস্থ হয়ে বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
বর্মী সেনা, পুলিশ, উগ্রবাদী বৌদ্ধ সম্মিলিতভাবে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন করলে এতে অতিষ্ট হয়ে প্রায় ৬ লক্ষ ২০হাজারের মত রোহিঙ্গা অধিবাসী বর্তমানে বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে রয়েছে।
এই পরিস্থিতিকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস গণহত্যা উল্লেখ করে বিবৃতি দেন এবং অবিলম্বে এই সেনা অভিযানের নামে গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানান। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সোচ্চার হন এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ এবং বার্মার ক্ষমতাসীন নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বার্মার সামরিক বাহিনীকে তাদের দেশে আমন্ত্রণের উপর স্থগিতাদেশ দেন। কিন্তু বার্মার সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ এসব বৈশ্বিক চাপের কোন কুণ্ঠাবোধ না করে নানা সময় নানা ধরনের উদ্ভট মন্তব্য করতে থাকেন। তিনি প্রথমদিকে রোহিঙ্গাদেরকে বাঙ্গালি হিসেবে অভিহিত করে বলেছিলেন, “বাঙ্গালিরা বাংলায় চলে গেছে”। এতে করে বুঝা যায় তারা রোহিঙ্গাদেরকে বাঙ্গালি হিসেবেই পরিচিতি দিতে চায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা রোহিঙ্গাদেরকে নানাভাবে চাপ দিয়ে এনভিসি নিতে বাধ্য করছে। রোহিঙ্গাদেরকে জিম্মি করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে এনভিসিসহ ছবি তুলে বার্মা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করছে যে রোহিঙ্গারা তাদের দেশের নাগরিক নয় বলেই তারা স্বেচ্ছায় এনভিসি নিচ্ছে।
এরপরেই বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্মা সফরের সময়েই বার্মা সরকারের এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বার্মা বাংলাদেশকে কোন সময়সীমা দেয়নি। এসময় বাংলাদেশ থেকে প্রদত্ত দশ দফা প্রস্তাবের কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবই মেনে নেয়নি বার্মা। উল্টো এর বিপরীত করে একটি প্রস্তাব পাঠায় বাংলাদেশের কাছে। যেটি বাংলাদেশের প্রদত্ত সমস্ত প্রস্তাবের সাথে সাংঘর্ষিক।
বার্মা-বাংলাদেশ এই আলোচনা চলার সময়েই বার্মার এক হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে পড়ে। মূলত বাংলাদেশকে উস্কে দিতেই এ ধরনের কাজ করা হয় যেন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য বার্মা- বাংলাদেশ যে আলোচনা চলমান রয়েছে তা ভেস্তে দিতে পারে। এতেও তারা সফল হয়নি। রোহিঙ্গারা যে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সেখানেই বর্মী সীমান্তরক্ষী বাহিনী মাইন পুঁতে রাখে মাটিতে। যাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের সময় এসব মাইনের বিস্ফোরণে মারা যান। কিছু রোহিঙ্গা মাটিতে পুঁতে রাখা এসব মাইনের বিস্ফোরণে নিহত হন। এতেও বর্মী বাহিনী ক্ষান্ত নয়, বাংলাদেশে প্রবেশরত রোহিঙ্গা বোঝাই অনেক নৌকা নদীতে ডুবিয়ে দেয় তারা। এতে করে রোহিঙ্গা নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ কয়েকদিনের ব্যবধানে শতাধিক রোহিঙ্গা পানিতে ডুবে মারা যান।
এতে করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বার্মার চূড়ান্ত বর্বরতা প্রকাশ পায়। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের থার্ড কমিটিতে বার্মার বিরুদ্ধে একটি রেজুলেশন পাশ হয়। কিন্তু বার্মার দাবি এ প্রস্তাব ত্রুটিপূর্ণ। বার্মা রাষ্ট্রদূত হাউ দো সুয়ান প্রস্তাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, খসড়া প্রস্তাবে যা কিছু বলা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়ে গেছে। প্রস্তাবটি এক পক্ষের অভিযোগের উপর ভিত্তি করে আনা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে বার্মার অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, এর মাধ্যমে বার্মার জনগণকে অপমান করা হয়েছে। এছাড়া এ প্রস্তাব পাশ হবার পরেই বার্মার নয়া সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে বলেন, বৌদ্ধরা না চাইলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হবে না। এবং বাংলাদেশে পরিবারসহ পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। এতে করে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করা মোটেই সহজ হবে না। তার এ বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়টি দীর্ঘায়িত হওয়ার একটি ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন তিনি।