বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

এক বছরে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার টাকা

এইচ এম আকতার : ৪৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়েই জন্ম গ্রহণ করছে নিষ্পাপ শিশু। বছর ব্যবধানে দেশে জিডিপির অনুপাতে ঋণ বেড়েছে সোয়া দুই শতাংশ। যার বেশিরভাগই নিতে হয়েছে দেশীয় উৎস থেকে। বর্তমানে মাথাপিছু ঋণ ৩৯ হাজার ৯৬৩ টাকা। এক বছরে মাথা পিছু ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৩৭ টাকা। চলতি অর্থবছর শেষে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে রাষ্ট্রের মোট ঋণ দাঁড়াবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ঋণের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ঝুঁকিতে পড়বে দেশ।

জানা গেছে, সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে ইতিবাচক প্রচার করলেও মাথা পিছু ঋণ নিয়ে প্রচারে আগ্রহ কম। দেশের প্রতিটি নাগরিক জাতিগতভাবে ঋণী হলেও তা সে জানে না। এ ঋণের সাথে তার কোন সর্ম্পক না থাকলেও সে ঋণী। তার মাথা দেখিয়ে ঋণ করলেও সে আসলে সুবিধাভোগী নয়।

 দেশের প্রতিটি নাগরিক যদি, তার শিক্ষা,স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসহ সকল নাগরিক সেবা পেতো তাহলে মাথাপিছু ঋণী হলে তাদের কোন প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু এসব সেবা না পেয়েও প্রতি বছরই তারা নতুন করে ঋণী হচ্ছে। কি কারণে নতুন করে ঋণী হচ্ছে তা জানতে পারছে না দেশের নাগরিক।

জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ সাড়ে একত্রিশ হাজার টাকা থাকলেও বছর ব্যবধানে বেড়ে হয়েছিল প্রায় ৩৯ হাজার ৯৬৩ টাকা। এক বছরে বেড়েছে ৭ হাজার ৪৬৩ টাকা। সম্প্রতি সরকার বড় বড় ঋণে যুক্ত হওয়ায় এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বলে মনে করছেন অনেকে। তবে জিডিপির অনুপাতে এই ঋণে এখনো স্বস্তিতে আছে বাংলাদেশ- মনে করেন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবং অর্থপ্রতিমন্ত্রী। তারা বলেন, সমসাময়িক দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে এ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যদিও ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ এসেছে।

অর্থমন্ত্রী বড় বাজেট দিলেও বেশি আয় করতে পারছেন না। এতে প্রতি বছরই বাড়ছে বাজেট ঘাটতি। আর তা মেটাতে ভরসা করতে হচ্ছে ঋণের ওপর। আবার সহজ শর্তের বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তিও কমে গেছে। ফলে অর্থমন্ত্রী বেশি নিচ্ছেন ব্যয়বহুল অভ্যন্তরীণ ঋণ। এতে বাজেট শৃঙ্খলাও নষ্ট হচ্ছে।

 কেননা, এ কারণে বিশাল টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে সুদ পরিশোধে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শুধু সুদ পরিশোধে যত টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো একটি সেতু নির্মাণ করার পরও আরও টাকা বেঁচে যাবে। আর সুদ পরিশোধে আর এত বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখতে না হলে সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেশি রাখতে পারত।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। সেই ঋণের একটা মোটা অংশ যদি হয় সঞ্চয়পত্র, তাহলে তা আরও ব্যয়বহুল। সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে, এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না।

অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে পুরো দেশের মানুষের ওপর ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। সুদসহ আগের বছরগুলোর মূল টাকাও সরকার প্রতিবছর পরিশোধ করে আসছে। পরিশোধ না হওয়া টাকা জমতে জমতেই ঋণের বোঝা এত বড় হয়েছে।

অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এ বিষয়ে বলেন, অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ বেশি টাকা রাখা হচ্ছে ঠিক আছে, এই টাকা কিন্তু দেশেই থাকছে। বৈদেশিক ঋণ বেশি নিলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পরিশোধ করতে হতো। তার চেয়ে এটাই ভালো। তা ছাড়া আপাতদৃষ্টে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার কম মনে হলেও আসলে কম না। তাদের অনেক শর্ত থাকে এবং পরামর্শক ফি বাবদ অনেক টাকা খরচ করতে হয়।

চলতি অর্থবছর শেষে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে রাষ্ট্রের মোট ঋণ দাঁড়াবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে দেশের ভেতর থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকার ঠিকমতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে। তিনি বলেন, একসময় দেশি-বিদেশি ঋণের হার ছিল অর্ধেক অর্ধেক। বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্নটি থাকে, সরকার তাই সে পথে যায় না। সরকার সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয় বেশি সুদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে। সুষ্ঠু ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য আহসান এইচ মনসুর আলাদা একটি বিভাগ গঠনের পরামর্শ দেন। 

আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে বলেন, চলতি বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দের অঙ্কটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর সরকারের নির্ভরতা কত বেশি। দুঃখজনক যে সস্তা সুদের বৈদেশিক ঋণ নিতে পারছি না একশ্রেণির সরকারি কর্মচারীর অযোগ্যতার কারণে। অর্থাৎ বিদেশি ঋণের সুদ সঞ্চয়পত্রেই সুদের অর্ধেক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, অর্থবছর শেষে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৬ কোটি ৫০ লাখ এবং মাথাপিছু ঋণ দাঁড়াবে ৪৬ হাজার ১৭৭ টাকা। বর্তমানে মাথাপিছু ঋণ ৩৯ হাজার ৯৬৩ টাকা।

মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাজেটের আকার বাড়ছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ছে না। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে চলেছে এবং সরকার বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে।

চলতি অর্থবছরের জন্য দেওয়া ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে অনুন্নয়ন বাজেট ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে সুদ পরিশোধে রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদই ৩৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। মোট বাজেটের প্রায় ১৭ শতাংশ অর্থই ব্যয় হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হবে মেয়াদি ঋণের সুদে।

চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা আছে ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু ঋণ পরিশোধে বাজেটে কমিয়ে ১৫ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা করা হয়েছে। অর্থবছরে ১৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে মেয়াদি ঋণের সুদ বাবদ।

অর্থ উপদেষ্টা ড.মশিউর রহমান বলেন,বিদেশি ঋণের সুদের হার কম হলেও নানা ঝামেলা রয়েছে। নানা শর্ত জুড়ে দেয়ায় খরচ আরও বেশি হয়। তাই সরকার অভ্যন্তরিন খাত থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। তাছাড়া ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট নেই। বিনিয়োগের সুযোগ কম থাকার কারনেই সরকার সহজেই ঋণ নিচ্ছে। এতে নেতিবাচক কিছু নেই।

পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, জিডিপির তুলণায় দেশে ঋণের পরিমান এখনও সহনীয় রয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি বড় বড় প্রকল্প বেড়ে যাওয়ার কারনেই মাথা পিছু ঋণের পরিমান বাড়ছে। এতে ঝুঁকির কিছু নেই।

তিনি আরও বলেন,বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ গ্রহনের কোন বিকল্প নেই। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন না হলে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান কোনটিই হবে না। তাছাড়া আমাদের ঋণ যেমন বাড়ছে তেমনি আয়ও বাড়ছে। এনিয়ে আমাদের সংকিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা উন্নয়ন পরিকল্পনা করেই ঋণের পরিকল্পনা করে থাকি। অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় প্রকল্প গ্রহনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বেড়েছে।

বিশ^ ব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ  জাহিদ হোসেন বলেন,রাজস্ব ঘাটতির কারনেই দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমান বাড়ছে। তবে ঋণও অর্থনীতি কর্মকান্ডের অংশ। বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে দেখতে হবে কি ধরনের শর্তে ঋণ নেয়া হয়েছে। কঠিন শর্তে ঋণ নেয়ার চেয়ে দেশিয় উৎস থেকে ঋণ নেয়া ভাল। ঋণ নেয়া এবং পরিশোধের দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে ঋণের পরিমান বাড়বেই। অর্থনীতিতে ঝুঁকিও বাড়বে। এজন্য সরকারকে আরও সর্তক থাকতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দেশে উন্নয়ন বাজেট বাড়লেও ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হচ্ছে না। এতে করে বাজেটে ব্যয় বাড়ছে। বাড়ছে ঋণের পরিমানও। যে কোন প্রকল্প গ্রহনের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি অপচয় হয়ে থাকে। এসব অপচয়রোধ করা গেলেই জাতীয় ঋণের পরিমান কমবে।

তিনি বলেন,কম সুদে অনেক বিদেশি ঋণ এখনও সরকারের পাইপ লাইনে রয়েছে। কিন্তু তা গ্রহণ না করে উচ্চ সুদে অভ্যন্তরিণ খাত থেকে ঋণ গ্রহন করছে। এতে করে বিনিয়োগের ক্ষেত্র যেমন সংকুচিত হচ্ছে তেমনি সুদের বোঝাও বাড়ছে। উচ্চ হারে ঋণ গ্রহনের ক্ষেত্র থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলে কিছুটা হলেও ঋণের বোঝা কমবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ