মংলা বন্দর দিয়ে পাট রফতানি বন্ধ
খুলনা অফিস : কন্টেইনার জটিলতায় মংলা বন্দর দিয়ে পাট রফতানি হচ্ছে না। দীর্ঘ একযুগেও এ সমস্যা সমাধান না হওয়ায় লোকশানে সর্বস্বান্ত এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। আর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে প্রান্তিক চাষিদের উপর। পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। সেই সাথে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মংলা বন্দর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের কাঁচা পাট উৎপাদন ও রফতানির প্রায় ৭০ ভাগই হয়ে থাকে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চল থেকে। পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এ অঞ্চলের ৩৩টি সরকারি-বেসরকারি পাটকল আর শতাধিক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। আমদানি-রফতানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও মংলা বন্দর দিয়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি বন্ধ করে দিয়েছেন এ অঞ্চলের রফতানিকারকরা। বিভাগীয় শহর খুলনা থেকে সড়ক পথে ৪৮ কিলোমিটার আর নদী পথে গেলে তা দাঁড়ায় ৫২ তে। এত কাছে হলেও এ অঞ্চলের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিকারকদের কাছে মংলা বন্দর যেন বহু দূরের পথ। জটিলতা শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। পাট রফতানিতে সে বছরই বাধ্যতামূলক করা হয় কন্টেইনার ব্যবহার। কন্টেইনার স্বল্পতা, উচ্চহারে কন্টেইনার ভাড়ার কারনে তখন থেকেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় বিদেশী বায়াররা। ফলে বিপুল পরিমাণ রফতানি শুল্ক হারাচ্ছে মংলা বন্দর। আর বাড়তি খরচ, সময় ও ঝুঁকি নিয়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে এ অঞ্চলের রফতানিকারকরা।
বাংলাদেশ পাট এ্যাসোসিয়েসনের সভাপতি সৈয়দ আলী জানান, পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে কন্টেইনার ব্যবহার বাধ্যতামূলক হয়ায় মংলা বন্দর দিয়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করা যাচ্ছে না। খুলনা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ৬৪৫ কিমি। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে আঠারো থেকে চব্বিশ ঘন্টা। সেখানে মংলা বন্দর পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র দেড় থেকে দুই ঘন্টা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পৌঁছাতে আমাদের ঝুঁকিতে থাকতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনা, প্রতিকুল আবহাওয়ায় আরিচা-দৌলতদিয়া মাওয়া-কাওড়াকান্দি ফেরিতে পণ্যবাহী গাড়ি আটকে পড়া, সর্বোপরি নানা ধরনের ঝুঁকিতে থাকতে হয়। আর এসব ক্ষতির ঝুঁকি পুষিয়ে নিতে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে আমাদের ইন্স্যুরেন্সসহ বাড়তি খরচ বহন করতে হয়। কিন্তু মংলা বন্দর ব্যবহার করলে পণ্য পরিবহনে ক্ষতির ঝুঁকি একেবারেই কম থাকে। পাশাপাশি ইন্স্যুরেন্সের বাড়তি খরচসহ অতিরিক্ত পরিবহন খরচ আমাদেরকে বহন করতে হয় না।
সূত্র জানায়, যেখানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে প্রতি বেল (১ বেল=১৮০ কেজি) পাট বা পাটজাত পণ্যে সিএন্ডএফ খরচ ৫০ থেকে ৬০ টাকা, সেখানে মংলা বন্দরে সিএন্ডএফ খরচ মাত্র ১০ থেকে ১৫ টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতি বেল পণ্য পৌঁছাতে খরচ হয় ১৭৫০ থেকে ২১০০ টাকা, সেখানে মংলা বন্দরে পণ্য পৌঁছাতে খরচ হয় মাত্র ৩০০ থেকে ৩১৫ টাকা। পণ্য রফতানিতে মংলা বন্দর ব্যবহারে এত সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র কন্টেইনার জটিলতায় এ বন্দর দিয়ে পাট রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না। আর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাট রফতানি করতে গিয়ে খরচ বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে প্রান্তিক পাট চাষিদের উপর। যেহেতু পণ্য বন্দরে পৌঁছাতে পরিবহন খরচ রফতানিকারককে বহন করতে হয়, সেহেতু রফতানির বাড়তি খরচ পুষিয়ে নিতে কৃষকদের কাছ থেকে কম মূল্যে পাট ক্রয় করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ফলে প্রান্তিক পাট চাষিরা তাদের উৎপাদিত পাটের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আর চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় মংলা বন্দরে কন্টেইনার ভাড়া বেশী এবং কন্টেইনার চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। চট্টগ্রাম থেকে চায়না পণ্য পাঠাতে কন্টেইনার ও জাহাজ ভাড়া লাগে ৮ থেকে ১০ মার্কিন ডলার। আর মংলা বন্দর থেকে পণ্যে লাগে ৪০ থেকে ৪৫ মার্কিন ডলার। যেহেতু জাহাজ ও কন্টেইনার ভাড়া বায়ারদের বহন করতে হয় সেহেতু বাড়তি খরচ করে মংলা বন্দর থেকে পন্য নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে বিদেশী বায়াররা।
মংলা শিপিং এসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন রফিক জানান, মংলা বন্দরে কন্টেইনারবাহী জাহাজ কম আসে, ফলে কন্টেইনারের মজুদও কম থাকে। ফলে মংলা বন্দরে কন্টেইনার প্রয়োজন হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজ ভাড়া করে মংলা বন্দরে আনতে হয়। আর তাই জাহাজ ভাড়ার বাড়তি খরচের কারনে মংলা বন্দরে কন্টেইনার ভাড়া বেশী। এছাড়া কন্টেইনার চেকিং এর নামে কালক্ষেপন ও হয়রানির শিকার হতে হয়। স্কানিং মেশিন থাকলেও পর্যাপ্ত জনবল নেই এই আজুহাতে কাস্টমস্ সেটা এখনও চালু করছে না। আমদানিকৃত পণ্যের ছাড়পত্র নিতে ফাইল প্রসেসিং এ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ করেন তিনি। আর্থিক লেনদেনে বনিবনা না হলে কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ফাইল প্রসেসিং ইচ্ছাকৃত জটিলতার সৃষ্টি করে বলে তিনি দাবি করেন।
মংলা বন্দর দিয়ে কেন পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর এম ফারুক হাসান জানান, বিদেশীদের চাহিদা অনুযায়ী সরকার আইন করে কন্টেইনার ছাড়া পাটজাত দ্রব্য রফতানি করা যাবে না। এর ফলে কন্টেইনার স্বল্পতার কারনে এ বন্দর দিয়ে পাট রফতানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। আর এই জটিলতা দূরীকরণে বন্দরে কন্টেইনারবাহী পণ্য আমদানি বৃদ্ধির লক্ষে সিপিং এজেন্টদের সাথে বৈঠক করা হয়েছে। বন্দরে যাতে পর্যাপ্ত কন্টেইনার পাওয়া যায় সেজন্য ইমপোর্টের ভলিউয়াম বাড়ানোর জন্য ইম্পোর্টারদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
আমদানিকৃত পণ্য ছাড়ে চেকিং হয়রানী ও ফাইল প্রসেসিং এ দীর্ঘ সূত্রিতার অভিযোগ অস্বীকার করে মংলা বন্দর কাস্টমস এর ডেপুটি কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম জানান, কাস্টমস তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার চেষ্টা করেন মাত্র। আর এর ফলে রাজস্ব ফাঁকি ও মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানিকারকরা তাদের চোরাকারবার করতে না পারায় ক্ষিপ্ত হয়ে কাস্টমসকে দোষারোপ করেন। তার মতে, মূলত. ভৌগলিক কারনে মংলা চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় জাহাজ কম আসে। যেখানে বঙ্গোপসাগর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৪৬ কিলোমিটার সেখানে বঙ্গোপসাগরের আক্রাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দরের জেটির দূরত্ব ১৪৩ কিলোমিটার। আর এই দূরত্বের কারণেই মংলা বন্দরে জাহাজ কম আসে।