বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

উল্টো পথের গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

রাজপথে রং সাইড বা উল্টো পথ দিয়ে গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে পুলিশ সম্প্রতি ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। গত রোববার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত সড়কে পুলিশের চালানো এই আকস্মিক অভিযানে অনেক রথি-মহারথিই ফেঁসে গেছেন। তাদের মধ্যে প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সরকারের সিনিয়র সচিবসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছেন এমনকি খোদ পুলিশের কর্মকর্তারাও। মঙ্গলবারের অভিযানে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফ এবং সেনা সদস্যদের গাড়িও রেহাই পায়নি। সেদিন আটক অর্ধ শতাধিক গাড়ির একটির ভেতরে পুলিশের একজন অতিরিক্ত ডিআইজিও ছিলেন। কিন্তু তার দেহরক্ষী এবং ড্রাইভার কথাটা জানানোর পরও কর্তব্য পালনরত পুলিশ সদস্যরা তাকে ছাড় দেননি। রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালানোর অপরাধে বরং জরিমানা করেছেন। প্রথম তিনদিনে যাদের গাড়ি আটক করা হয়েছে তাদের প্রত্যেককেই জরিমানা দিতে হয়েছে। কয়েকজন চালকের লাইসেন্সও জব্দ করেছে পুলিশ। ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান সহসা থেমে যাবে না। কোনো কারণে কৌশল হিসেবে দিন কয়েকের জন্য স্থগিত রাখা হলেও যে কোনো সময় আবারও শুরু করা হবে। পুলিশ এমন অবস্থা নিশ্চিত করতে চায়, যাতে ট্রাফিক জ্যাম বা জরুরি প্রয়োজন ধরনের কোনো অজুহাত দেখিয়েই কারো পক্ষে আইন লংঘন করা এবং রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালানো সম্ভব না হয়। পুলিশ এমনকি মন্ত্রীদের পতাকাবাহী গাড়িকেও ছাড় দেবে না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
রাজধানীতে রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে ট্রাফিক বিভাগ তথা পুলিশের এই অভিযান সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছে। তারা এর প্রতি সর্বতোভাবে সমর্থনও জানিয়েছে। এমন প্রতিক্রিয়াই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, রাজধানী ঢাকা এরই মধ্যে যানজটের নগরী হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে। রাজধানীর প্রাত্যহিক যানজট সম্পর্কে টিভি ও সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমেও সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে বহুদিন ধরে। এসব রিপোর্টে হাজার হাজার গাড়ির ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাসহ সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের বিবরণ থাকে, পাশাপাশি থাকে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কথাও। বহু মানুষের পক্ষে সময়মতো অফিসসহ কর্মস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। স্কুলগামী ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা ঘন্টার পর ঘণ্টা একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। অবস্থা এমনও হয় যে, মুত্যুর মুখোমুখি এসে পড়া রোগীকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও হাসপাতালে পৌঁছানোর সুযোগ পায় না। ফলে অনেকেরই মৃত্যু ঘটে রাজপথে এবং বিনাচিকিৎসায়। বৃষ্টির সময় পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে সে সম্পর্কে জানা গেছে অতি সাম্প্রতিক সময়েও। বিশেষ করে আষাঢ় ও শ্রাবণের প্রবল বর্ষণের দিনগুলোতে রাজধানী মহানগরী তো অচল ও স্থবিরই হয়ে পড়েছিল।
যানজটের বিষয়টি নিয়ে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনাও কম হয়নি। কিন্তু সরকার তথা পুলিশসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর পক্ষে যানজট কাটিয়ে ওঠার মতো কোনো ব্যবস্থা নেয়াই সম্ভব হয়নি। নির্ভরযোগ্য কোনো পরিকল্পনার কথাও জানতে পারেনি জনগণ। এর ফলে মানুষের দুর্ভোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি। এই ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত তথ্য-পরিসংখ্যানও অত্যন্ত ভীতিকর। গত জুলাই মাসে এক গবেষণা রিপোর্টে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, তীব্র যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন মানুষের ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর অর্থের দিক থেকে প্রতি বছর ক্ষতি হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকার। সে হিসেবে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮৪ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছে, যানজটের ফলে রাজধানীতে গাড়ির গতি অনেক কমে গেছে। ১০ বছ আগেও ঢাকায় একটি যানবাহন ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারতো। এখন সে একই যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ছয় দশমিক দুই কিলামিটারে এসে নেমেছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অবস্থায় পরিবর্তন না ঘটানো গেলে ২০২৫ সালে ঢাকায় যানবাহনের গতি আরো কমে ঘণ্টায় মাত্র চার কিলোমিটারে নেমে আসবে। তখন মানুষ হেঁটেই যে কোনো যানবাহনের চাইতে কম সময়ে বেশি দূরে যাতায়াত করতে পারবে। উল্লেখ্য, একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। সেদিক থেকে ঢাকায় যানবাহনের গতি মানুষের গতির প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেছে।
এমন অবস্থায় দরকার যেখানে যানজট কমিয়ে আনার চেষ্টা করা সেখানে বেশ কিছুদিন ধরে শুরু হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কর্মকান্ড। দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, এমপি এবং সচিবসহ উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা যানজট এড়ানোর উদ্দেশ্যে রং সাইড বা উল্টো রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে তাদের মতো বিশেষ কিছুজনের সময় বাঁচলেও যানজট আরো বেশিক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগও বাড়ছে কয়েক গুণ। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো, এই বিশেষজনেরা কিন্তু ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে যথেচ্ছভাবে ট্রাফিক আইন লংঘন করছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ক্ষমতাশালী হওয়ার কারণে এতদিন তাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে বিশেষজনদের সংখ্যাও কেবল বেড়েছেই। তাদের দেখাদেখি ইদানীং আরো অনেকেই রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করেছিল। ফলে যানজট পরিস্থিতিরও ক্রমাগত অবনতি ঘটছিল। এমন এক অবস্থার মধ্যে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে বলেই পুলিশের অভিযানকে জনগণ সমর্থন জানিয়েছে। আমরা মনে করি, কোনো ধমক বা হুমকির মুখে বন্ধ বা স্থগিত করার পরিবর্তে এই অভিযান অব্যাহত রাখা দরকার। আমাদের বিশ্বাস, রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করা গেলে রাজধানীর যানজটও অনেকাংশেই কমে আসবে। আমরা চাই, রাজধানী ঢাকা সম্পূর্ণরূপে যানজটমুক্ত হোক এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠুক।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ