খুলনায় চিংড়িতে পুশ উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে
খুলনা অফিস : জেল ও জরিমানা দিলেও কোন কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না সাদা সোনাখ্যাত চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ। পুশ বন্ধে নগরী ও জেলায় র্যাব, কোস্ট গার্ড, মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তর কখন একক আবার কখনও বা যৌথভাবে অভিযান চালাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার বিকেল ৫টায় নগরীর নতুন বাজার এলাকার মাসুম এন্টারপ্রাইজ ও ইরান ফিসে অভিযান চালায় র্যাব-৬। এ সময় মাসুম এন্টারপ্রাইজের ৬শ’ কেজি এবং ইরান ফিসের ৯শ’ কেজি বাগদা ও গলদা চিংড়ি জব্দ করা হয়। এর মধ্যে ১৩শ’ কেজি চিংড়ি বিনষ্ট করা হয়। এর মধ্যে ২শ’ কেজি এতিমখানায় বিতরণ করা হয়। ইরান ফিসের মালিক মো. ইরানকে নগদ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং চিংড়িতে পুশ করার সময় নয়ন, মো. লিফাত হোসেন, মো. নুর নবী ও মো. সগীরকে হাতেনাতে ধরা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নয়নকে ১৫ দিনের এবং বাকি তিন জনকে৭ দিনের জেল দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন র্যাব-৬ এর ক্যাপ্টেন মোজাম্মেল হোসেন খাঁন, মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তর খুলনা’র উপ-পরিচালক প্রফুল্ল কুমার সরকার, পরিদর্শক লিপটন সরদার।
অপর দিকে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর এলাকার আবু তাহেরের মৎস্য ডিপোর পুশকরা চিংড়ি নসিমনযোগে ক্রিমসন রোছেলা সী ফুডস এ বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়ার সময় গেটের সামনে থেকে ৮০ কেজি বাগদা চিংড়ি জব্দ করা হয়। চিংড়ির দেহে সাগু, জেলি ও ভাতের মাড় পুশ করার অপরাধে ডিপো মালিককে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তরের পরিদর্শক মো. তরিকুল ইসলাম এ চিংড়ি জব্দ করেন এবং পুড়িয়ে বিনষ্ট করা হয়। ডিপো মালিককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ দপ্তর এবং র্যাবের যৌথ ভাবে গত ২১ আগস্ট নগরীর নতুন বাজার এলাকার রাব্বি এন্টারপ্রাইজে অভিযান চালিয়ে অপদ্রব্য পুশ ৩শ’ কেজি বাগদা চিংড়ি জব্দ করে। ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিষ্ঠানের মালিককে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। গত ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে র্যাব-৬’র একটি বিশেষ টিম নগরীর নতুন বাজার এলাকার ফাতেমা ফিস, অপু ফিস, আঁখি ফিস ও সুমন ফিসে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ বিরোধী অভিযান চালায়। এ অভিযানে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় চার প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ৭শ’ কেজি বাগদা ও গলদা চিংড়ি জব্দ করা হয়। এর মধ্যে ৭শ’ কেজি চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা ছিল এবং বাকি ১ হাজার কেজি চিংড়ি পুশ প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় ছিল। ওই অভিযানে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অঙ্গজয় মার্মা ফাতেমা ফিসকে ৭৫ হাজার টাকা, অপু ফিসকে ২০ হাজার টাকা, আঁখি ফিসকে ৫০ হাজার টাকা ও সুমন ফিসকে নগদ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তর গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে রূপসার ন্যাশনাল সী ফুডস্ এর সামনে অভিযান চালিয়ে দেড়শ’ কেজি অপদ্রব্য জেলি পুশকরা বাগদা চিংড়ি জব্দ করে। চিংড়ি মালিককে নগদ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জব্দ করা চিংড়ি রূপসা নদীতে ফেলে বিনষ্ট করা হয়। গত ১০ সেপ্টেম্বর ফুলতলা উপজেলার জামিরা বাজারের রফিকুল মৎস্য ডিপোতে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ বিরোধী অভিযান চালিয়ে ১ মণ চিংড়ি জব্দ করা হয়। এছাড়া তিন মৎস্য ব্যবসায়ীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তর খুলনা’র উপ-পরিচালক প্রফুল্লা কুমার সরকার বলেন, চিংড়ির দেহে অপদ্রব্য পুশ বন্ধে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তর, র্যাব-৬ এবং কোস্ট গার্ডের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে বাগেরহাটে সাদা সোনাখ্যাত গলদা চিংড়ির দাম কেজিতে ৩শ’ টাকার বেশি কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন জেলার ৪৩ হাজার চিংড়ি চাষি। আর এ খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন আমদানিকারক দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দার কারণেই এ অবস্থার জন্য দায়ী। এদিকে গলদা চিংড়ির দাম কমে যাওয়া অন্যদিকে কিছুদিন আগে অতিবৃষ্টিতে চিংড়ি ঘের ভেসে যাওয়ার কারনে চরম হতাশায় ভুগছেন চাষিরা। অনেকেই চাষি আবার ব্যাংক, এনজিও ও মহাজনদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে চিংড়ি ঘের করেছিলেন। এখন সব মিলিয়ে জেলার চিংড়ি চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজারে গলদা চিংড়ির দাম কেজিতে ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা দাম কমে যাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছে চাষিরা। এর আগে অতিবৃষ্টিতে প্রায় ১১ হাজার ঘের ভেসে ও বাগদা চিংড়িতে ভাইরাস সংক্রমণেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিভিন্ন দেশে রফতানির জন্য চিংড়িগুলোকে বিভিন্ন গ্রেডে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে পঞ্চম গ্রেডের বর্তমান দর ৭৫০ টাকা যা মাস তিনেক আগে ছিল ১১০০ টাকা। আর ১০ গ্রেডের দাম ৯৫০ টাকা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে ৬৫০ টাকায়। আর এ কারনেই জেলার অধিকাংশ চিংড়ি চাষিরা ঘের থেকে চিংড়ি ধরা বন্ধ রেখেছেন। বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের শ্রীঘাট গ্রামের চিংড়ি চাষি শেখ লিয়াকত আলী বলেন, আমার পাঁচ বিঘার একটি চিংড়ি ঘের রয়েছে। রেণুর দাম, খাবার ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে এ বছর আমার খরচ হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। চিংড়ি বিক্রির মওসুম শুরু হলেও এখনও ২০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে পারিনি। হঠাৎ বাজার পড়ে যাওয়ায় মাছ ধরা বন্ধ রেখেছি। লাভ তো দূরের কথা এ বছর আসল উঠা নিয়েই শঙ্কায় আছি। জেলার কচুয়া উপজেলার বিলকুল গ্রামের আব্দুল বারেক পাইক জানান, ১২ বিঘা জমিতে ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গলদা চাষ করেছিলাম। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। মওসুম শুরু হলেও দাম পড়ে যাওয়ায় মাছ ধরা বন্ধ রেখেছি। বাজার এ রকম থাকলে ঋনের টাকা কিভাবে পরিশোধ করবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। সদর উপজেলার বারাকপুর মৎস্য আড়ৎদার সমিতির সভাপতি জাকির হোসেন জানান, এজেন্টরা আমাদের যেভাবে বুঝান সেভাবেই চিংড়ির বাজারটা চলছে। দাম বাড়া-কমায় সরকারের মৎস্য বিভাগের তদারক না থাকায় তারা এ সুযোগটি নিচ্ছে। তিনি চিংড়ি শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান। বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জিয়া হায়দার জানান, জেলার প্রায় ৪৩ হাজার চাষি প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করেন। দাম পড়ে যাওয়া সবাই বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন। যুক্তরাজ্যসহ আমদানিকারক দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চিংড়ির দাম পড়ে গেছে বলে আমাদের দেশের রফতানিকারকরা দাবি করছেন। এছাড়া বছরের এ সময়টায় চাষিরা ঘের প্রস্ততি করার জন্য সব চিংড়ি ধরে বিক্রি করে দেন। রফতানিকারকরা মাছের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার এ সুযোগটা অনেক সময় নিয়ে থাকে। তবে চিংড়ির দাম আবার আগের জায়গায় ফিরবে বলে আশা করছেন তিনি।