সাংবাদিক গৌরী হত্যার ঘটনায় বিশেষ তদন্ত দল গঠনের নির্দেশ
৬ সেপ্টেম্বর, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এবিপি আনন্দ : ভারতের ব্যাঙ্গালোর শহরে যে নারী সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, তার তদন্তে নেমে পুলিশ বেশ কিছু প্রমাণ যোগাড় করেছে। সিনিয়র সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে মঙ্গলবার রাতে তার নিজ বাড়ির সামনে গুলী করে হত্যা করা হয়।
পুলিশ বলছে, মিজ লঙ্কেশের বাড়ির সামনে থাকা দুটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা যোগাড় করেছে, যেখানে আততায়ীদের পরিচয় সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যেতে পারে বলে তারা মনে করছে। তবে দুটি ক্যামেরার রেকর্ডারেই পাসওয়ার্ড দেয়া আছে। তদন্তকারীরা অবশ্য গণমাধ্যমকে এটা নিশ্চিত করেছেন যে, হত্যাকারীরা মোটরবাইকে চেপে এসেছিল। হামলা চালানোর আগে থেকেই তারা মিজ লঙ্কেশকে অনুসরণ করেছিল বলেও পুলিশ মনে করছে।
ওদিকে ময়না তদন্তের পরে তার মরদেহ সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা রয়েছে। গৌরী লঙ্কেশ ঘোষিতভাবেই দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত কলম ধরতেন। প্রশ্ন তুলতেন হিন্দুত্ববাদ নিয়ে। তাঁর লেখার কারণে মানহানির মামলা করেন এক বিজেপি সংসদ সদস্য। ওই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলও খাটতে হয়েছিল মিজ লঙ্কেশকে। তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন।
গৌরী লঙ্কেশের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, দক্ষিণপন্থী মতবাদ নিয়ে চলা বেশ কয়েকটি সংগঠনের কাছ থেকে নিয়মিত হুমকি পাচ্ছিলেন তিনি। সাহিত্যিক ও লেখক মঙ্গলেশ ডবরালের কথায়, এই হত্যা নিশ্চিতভাবেই তাঁর মতামতের সঙ্গে সম্পর্কিত। গত দুবছর ধরে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলো টার্গেট করেছিল গৌরীকে। গৌরী লঙ্কেশের আগেও দক্ষিণপন্থীদের সমালোচনাকারী বেশ কয়েকজন লেখক, যুক্তিবাদী নিহত হয়েছেন।
এদিকে ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে হত্যার ঘটনায় একটি বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) কাজ করবে বলে জানিয়েছেন কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া। এ তদন্ত দলের প্রধান হিসেবে থাকবেন পুলিশের কোনও এক আইজি। গতকাল বুধবার পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সিদ্দারামাইয়ার এসব কথা জানান। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই এর কাছে তদন্তের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হতে পারে বলেও জানান তিনি।কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশের এক আইজির নেতৃত্বে বিশেষ একটি তদন্ত দল এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করবে। আমি ডিজিপিকে নিন্দেশ দিয়েছে।এ ঘটনার তদন্তে যতসংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তাকে নেওয়া সম্ভব যেন নেওয়া হয় এবং ভালোভাবে এ ঘটনার তদন্ত করে। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলেই মনে হচ্ছে।’ ভারতয়ি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ এবং সম্ভাব্য খুনীদের ব্যাপারে কিছু বলছে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সিদ্দারামাইয়া।
তিনি বলেন, ‘আমরা এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাই, ভীরুচিত্তের মানুষরাই এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালাতে পারে।’ এরইমধ্যে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছে গৌরীর পরিবার। সিবিআই-এর কাছে তদন্ত হস্তান্তর প্রসঙ্গে সিদ্ধারামাইয়া বলেন, ‘হত্যাকারীদের পাকড়াও করা যাবেবলে আমি বিশ্বাস করি। সিবিআই তদন্তের জন্যও আমি রাজি আছি। নিহতের পরিবার যদি এমনটা চায় তবে আমরা সিবিআই এর কাছে তদন্ত হস্তান্তর করব।’ গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বেঙ্গালুরুর পশ্চিমে অজ্ঞাতপরিচয়ের তিন দুর্বৃত্ত মোটরবাইকে এসে গৌরীকে লক্ষ্য করে গুলী চালিয়ে পালিয়ে যায়। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর সব দিনের মতোই মঙ্গলবারও কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। সে সময় ঘটনাস্থলে ওৎ পেতে রেখেছিল ৩ মোটর সাইকেল আরোহী। গৌরী সদর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করার সময় পরপর ৭ রাউন্ড গুলী বর্ষিত হয়। এরমধ্যে ৩টি গুলী গৌরীর শরীরে আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মুত্যু হয়।চল্লিশবছর আগে বাবার শুরু করা লঙ্কেশ পত্রিকার দায়িত্ব নিয়েছিলেন গৌরী। ভাই ইন্দ্রজিৎসহ পত্রিকাটি চালাতেন তিনি। এরমধ্যে নিজস্ব সংবাদপত্র গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকাও রয়েছে। তার পত্রিকায় সাম্প্রদাযকি সম্প্রীতির সপক্ষে এবং দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদের বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করা হয। পরে ভাইয়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য বেশ কিছু প্রকাশনা শুরু করেন গৌরী।বিভিন্ন ডানপন্থী সংগঠনের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সরব গৌরীর মৃত্যুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সাংবাদিকরা কর্নাটকের যুক্তিবাদী লেখক এম এম কালবুর্গি হত্যার মিল খুঁজে পাচ্ছেন। যদিও এখনও কর্ণাটক পুলিশ এই দুটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে যোগ থাকার কোনও প্রমাণ হাতে পায়নি বলে দাবি করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
জীবনের শেষ দিনেও রোহিঙ্গা ও
মানবাধিকার প্রশ্নে সরব ছিলেন
ভারতের নির্ভীক সাংবাদিক বলে পরিচিত ৫৫ বছরের গৌরী লঙ্কেশের। বরাবরই হিন্দুত্ববাদীদের কট্টর সমালোচক হিসেবেও পরিচিতি ছিল তার। বিভিন্ন মানবাধিকার ইস্যুতে সোচ্চার থাকা গৌরী জীবনের শেষ ২৪ ঘণ্টায়ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রেখে গেছেন সেই সরবতারই চিহ্ন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট, নোট বাতিলকে কটাক্ষ করে কয়েকটি পোস্ট ও সমকামীদের অধিকার সংক্রান্ত একটি ইউটিউব লিঙ্ক এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সমালোচনামূলক পোস্ট নিজের ফেসবুক ও টুইটার পেজে জীবনের শেষ ২৪ ঘন্টায় শেয়ার করেছিলেন তিনি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেন ফেরত পাঠাতে চায়, এ বিষয়ে কেন্দ্রের কাছে সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন সংক্রান্ত একটি খবর সহ বেশ কয়েকটি ওয়েব লিঙ্ক সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন গৌরী।এবিপি আনন্দ আরও জানায়, গত তিনমাসে গৌরীর কন্নড সাপ্তাহিকীতে শেষ আটটি লেখায় ছিল কেন্দ্রীয় সরকার ও তার নেতাদের সমালোচনা। তার অন্তিম সাপ্তাহিক নিবন্ধের বিষয় ছিল উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর ঘটনা। তিনি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা কাফিল খানের অপসারণের সিদ্ধান্তেরও তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।গৌরী গত ২৪ ঘন্টায় ফেসবুকে ও টুইটারে যে পোস্টগুলী শেয়ার ও রিটুইট করেছেন, সেগুলীর অধিকাংশই ছিল বিজেপির প্রতি সমালোচনামূলক। এরমধ্যে কেরালার আমলা জেমস উইলসনের পোস্টও রয়েছে। জেমস প্রায়শই বিশেষ করে নোট বাতিল নিয়ে কেন্দ্রের সমালোচনামূলক পোস্ট করেন।
গৌরীর একটি টুইট হলো- “আমার কেন মনে হয় যে ‘আমাদের’ কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেই লডাই করছি? আমরা সবাই আমাদের ‘বড শত্রু’ কে, তা জানি। আমরা কি সবাইকে সে ব্যাপারে মনোযোগ দিতে পারি না?” অবশ্য, এই টুইটের বিষয়বস্তু অবশ্য স্পষ্ট নয়।গৌরীর ফেসবুক প্রোফাইল তার টুইটার টাইমলাইনের মতোই। তার ফেসবুক পেজে রয়েছে দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার একটি ছবি। আর টুইটারর পেজে রয়েছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা কানহাইয়া কুমারের ছবি।আততায়ীর গুলীতে খুন হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে গৌরী বাবা প্রায়ত সাংবাদিক পি লঙ্কেশের সঙ্গে তোলা তার একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। শিক্ষক দিবসে ওই পোস্টের মাধ্যমে বাবাকে শ্রদ্ধা জানান গৌরী।