শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

গৌতম বুদ্ধের অহিংসার বাণী এবং মিয়ানমারে বৌদ্ধদের মুসলিম নির্যাতন

এডভোকেট আব্দুস সালাম প্রধান : আমাদের বসবাসের এই বিশ্ব এক সময়ে সবদিক থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বর্তমানে জল, স্থল ও আকাশ পথে এবং আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির বদৌলতে গোটা বিশ্ব এখন বিচ্ছিন্নতা মুক্ত হয়ে হাতের মুঠোয় এসে দাঁড়িয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে এ মহাবিশ্ব এখন ৬০০ কোটি মানব জাতির বসবাসের একটি গ্রাম। বর্তমান বিশ্বের ৬০০ কোটি মানুষের মধ্যে ৫০০ কোটি মানুষ ইসলাম, বৌদ্ধ, সনাতন (হিন্দু) ও খৃষ্ট ধর্মের অনুসারী। বৌদ্ধ ধর্ম ২৫০০ বছর ধরে বিশ্বের ৬৫ কোটি মানুষের বিশ্বাস ও কর্মে প্রভাব রেখে চলেছে। এই ধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধার্থ বা মহামতি গৌতম বুদ্ধ বর্তমান নেপালের প্রাচীন কপিলা বস্তু নগরিতে খৃষ্টপূর্ব ৬৩৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন। খৃষ্টপূর্ব ৫২৩ সনে বৌদ্ধ মতে মৃত্যুবরণ বা মহানির্বান লাভ করেন। তার মহা নির্বানের ১০০ বছর পর বুদ্ধের রেখে যাওয়া আদর্শ ভারতীয় উপমহাদেশসহ আফগানিস্তান, মংগোলিয়া, তিব্বত, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, কোরিয়া উপদ্বীপ, ভিয়েতনাম, লাওস, ক¤েবাডিয়া, শ্রীলংকায় ছড়িয়ে পরে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্রাবির জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন যাবৎ বর্ণবাদী আর্য্যদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল। সেজন্য সর্বদাই তারা তাদের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীনতা এবং ন্যায় বিচার পাওয়ার প্রত্যাশায় নুতন কোন আদর্শ গ্রহণে উৎসাহিত ছিল। বৌদ্ধ ধর্মমত নুতনভাবে একটি ধর্মমত হিসাবে প্রসারের একপর্যায়ে বাংলা অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ তাদের মুক্তির মন্ত্র হিসাবে বৌদ্ধ ধর্মমত গ্রহণ করে। বাংলাদেশে কুমিল্লার ময়না মতি বৌদ্ধ বিহার এবং নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার সোমপুর বৌদ্ধ বিহার এর ধ্বংসাবশেষ বা পুরাকীর্তি তারই প্রমাণ বহন করে। বগুড়ার মহাস্থানগড় দক্ষিণ পূর্ব ভারতের বৌদ্ধ শাসকদের রাজধানী ছিল। মহাস্থানের প্রাচীন নাম পৌন্ড্র নগরী। মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষ এর মধ্যভাগে গোপাল ভিটা নামে একটি ভিটা আছে। গোপাল একজন সাধরণ কৃষকের সন্তান ছিলেন। স্থানীয় জনগণ তাকে ভালবেসে তার গুনমুগ্ধ হয়ে গণভোটে রাজা হিসাবে নির্বাচিত করে। সম্ভবতঃ পৃথিবীতে জনগণ কতৃক সরাসরি নির্বাচিত প্রথম রাজা ছিলেন গোপাল। তার আগে পৃথিবীর কোথাও কোন রাজা জনগণ কতৃক নির্বাচিত হয়েছিল বলে জানা যায় না। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় রাজা ছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের আর একটি প্রমাণ এই যে, বাংলাদেশের একজন বৌদ্ধ রাজকুমার বিজয় শ্রীলংকা জয় করেন এবং সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটান। বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার বজ্রযোগীনি গ্রামে জন্ম গ্রহণকারী অতিশ দীপঙ্কর নামক একজন বৌদ্ধ পন্ডিত চীনের তিব্বতে গমন পূর্বক বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন। প্রাচীন ভারতের অসামান্য প্রভাবশালী সম্রাট অশোক পূর্বে হিন্দু ছিলেন। কলিংগ যুদ্ধে বিশাল পরিমান মানুষের প্রাণহানীতে তিনি অনুতপ্ত ও মর্মাহত হয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তার মাধ্যমে সমগ্র ভারত উপমহাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। ৬৩২ খৃষ্টাব্দে মহানবী (দঃ) এর ইন্তেকালের পর আফগানিস্তানের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। অপরদিকে বাংলাদেশের অধিকাংশ বৌদ্ধ ধর্মালম্বী সাধারণ মানুষ এবং নি¤œ বর্ণের হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বর্তমান দুনিয়ার একটি অন্যতম বৌদ্ধ প্রধান দেশ বরং বলা চলে একটি কট্টরপন্থি বৌদ্ধ রাষ্ট্র মিয়ানমার। যার পূর্বনাম ছিল বার্মা। এদেশের আনাচে কানাচে হাজার হাজার প্যাগোডা আছে। প্যাগোডাগুলো মুল্যবান ধাতু বা পাথরে নির্মিত। এসমস্ত প্যাগেডায় বিভিন্ন মুল্যবান ধাতু দ্বারা নির্মিত ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি বসানো আছে। প্রতিদিনি বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারিরা প্যাগোডায় যান। বুদ্ধ মূর্তিকে প্রণাম করে উচ্চারণ করেন “বৌদ্ধং শরনং গচ্ছামি সংঘং গচ্ছামী, ধর্মং শরনং গচ্ছামী। সব্বে স্বত্বা শুখিতা ভবন্তে।’’ বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমার। মিয়ানমার ও ভারত ব্যতিরেকে অন্য কোন রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সীমানা সংযুক্ত নাই। মিয়ানমার একসময় বৃটিশ সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে লর্ড ক্লাইভের বাহিনীর সাথে পলাশীর যুদ্ধে শেষ বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা পরাজিত ও পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে শহীদ হন। সেসময় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চল ইংরেজদের দখলে চলে যায়। ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে সনে শেরে মহিশুর টিপু সুলতানকে পরাজিত ও শহীদ করে ইংরেজরা দক্ষিণ ভারতে আধিপত্য বিস্তার করে। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহে সামগ্রীকভাবে গোটা ভারতের জনগণ বৃটিশদের নিকট পরাজিত হয়। ফলে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ পার্শ্ববর্তী শ্রীলংকা বৃটিশ শাসনভুক্ত হয়। ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র আলাদাভাবে বৃটিশদের কাছে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দের ৫ই জানুয়ারী বার্মা বর্তমান মিয়ানমার বৃটিশ শাসন মুক্ত হয়। মিয়ানমার বার্মা নামে নতুন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানের বৃহৎ আকারের মিয়ানমার ও বিশাল আকৃতির ভারত বৃটিশ সম্রাজ্যবাদীদের দয়ার দান। এ দুটি রাষ্ট্র বৃটিশ কলোনীর অন্তর্ভুক্ত না হলে মিয়ানমার অন্তঃত সাতটি এবং ভারত অন্তঃত পঁচিশটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে হয়ত জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে দিত। বর্তমান মিয়ানমার রাষ্ট্রটিতে ৫ কোটি ৬০ লাখ ৮৯ হাজার ৪০৮ জন লোক বাস করে। যারা ১০০টি নৃতাত্বিক জাতি গোষ্ঠিতে বিভক্ত। প্রধান প্রধান জাতিগোষ্ঠিগুলোর ভাগ নিম্নরূপ : বার্মিজ ৬৮% ভাগ, শান ৯% ভাগ, কারেন ৭%, চাইনিজ ৩% ভাগ, বাকি ১৩% মুসলিম বা রোহিঙ্গা।
বার্মা বর্তমান মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠী তথা রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : বর্তমান মিয়ানমারের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের তীরঘেষে আরাকান অঞ্চল। এ অঞ্চলের ভিতর দিয়ে মিয়ানমারের ইরাবতি নদী বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। বাংলাদেশ মিয়ানমার উভয় দেশের সীমান্তের ভিতর দিয়ে নাফনদী বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বঙ্গোপসাগরের উপকুলীয় অঞ্চল মিয়ানমারের আরাকান, বাংলাদেশ চট্টগ্রাম নোয়াখালী অঞ্চলে ব্যবসার সুবাদে আরব বণিকদের যাতায়াত ছিল। এ অঞ্চলে অনেক মুসলিম আরব বণিক ১১/১২ শত বছর পূর্বেই বিবাহশাদী করেন এবং বসতি স্থাপন করে স্থায়ী হয়ে যান। তাদের মাধ্যমে ১১-১২ শত পূর্বেই আরাকান ও চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে ইসলামের অনুসারীদের বিস্তার ঘটে। ভারতবর্ষ বৃটিশ কলোনীতে রুপান্তর হওয়ার পূর্বে এখন থেকে ৫-৬ শত বৎসর আগেই আরাকান অঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বৃটিশরা ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে আরাকানসহ সহ গোটা মিয়ানমারকে তাদের কলোনীভুক্ত করার পূর্বে আরাকান মাযানমারের অংশ ছিল না। আরাকান অঞ্চলে রোসাংগ নামে একটি পৃথক স্বাধীনরাষ্ট্র ছিল। রোসাংগ রাজ্যের ২য় সংখ্যা গরিষ্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠী ছিল মুসলমান। বর্তমানে যাদেরকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বলা হচ্ছে তারা রোসাংগ রাজ্যে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠীর উত্তর পুরুষ। রোসাংগ রাজ্যে মুসলমানরা রাজ সভার অনেক গুরুত্বপুর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মহাকবি আলাওল রোসাঙ্গ রাজ সভার প্রধান কবি ছিলেন। রোসাংগ রাজসভার অমাত্য প্রধান ছিলেন মাগন ঠাকুর। তিনি ছিলেন আরব বংশাদ্ভুত কোরাইশ বংশীয় মুসলমান। মাগন ঠাকুরের আনুকুল্যে ও উৎসাহে মহাকবি আলাওল ফারসী ও হিন্দি ভাষা থেকে “পদ্মাবতী” “সতী ময়না” ‘লোর চন্দ্রানী’, ‘ইউসুফ জুলেখা’, কাব্যের বাংলায় পদ্মানুবাদ করেন। মাগন ঠাকুর রোসাংগ রাজার স্থানীয় ভাষায় দেয়া উপাধী। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ মুসলমান।
মহাকবি আলাওল রোসাংগ রাজ্য ও মাগন ঠাকুর সম্পর্কে মন্তব্য করেন “রোসাংগ রাজ্য নানা জাতি শোভমান মাগন ঠাকুর তার অমাত্য প্রধান।”
মহানবী (দঃ) এর তিরোধানের অল্পদিনের মধ্যে ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বকোন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী এবং মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের জনগণের সমর্থন লাভ করে। এক সময় বাংলা অঞ্চলের প্রধানতঃ বৌদ্ধ ধর্মালম্বী দ্রাবির জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ও নি¤œ বর্ণের হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্যাপক হারে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
ঐ সময়ে আরাকান অঞ্চলে বসবাসরত অধিকাংশ অর্ধ বাংলা ভাষী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। রোহিঙ্গাদের মত মিশ্রিত বাংলা ভাষী জনগোষ্ঠী ভারতে আসাম এবং উরিষ্যায় বসবাস করেন। উরিয়া ও অহমিয়া ভাষা ব্যবহারকারী আসামি এবং উরিষ্যার জন গোষ্ঠিকে আমরা যেমন বাংলাদেশ থেকে গমনকারী জনগোষ্ঠী হিসাবে চিহিত করি না। ঠিক সেভাবেই রোহিংগা অর্ধ বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার যাওয়া জনগোষ্ঠী নয়। ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে বৃটিশরা সাবেক বার্মার রাজধানী ইয়াংগুন দখল করে। পরে বর্তমান মিয়ানমারের যে মানচিত্র আমরা দেখি তার সব অঞ্চল ইংরেজরা মিয়ানমার রাষ্ট্রভুক্ত করে। মিয়ানমারের পূর্বনাম ছিল বার্মা। একই সময়কালে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মালয় দ্বীপপুঞ্জ, সিঙ্গাপুর, ফিজি দ্বীপপুঞ্জ বৃটিশ কলোনীভুক্ত হয়। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ফিজি মালয় উপদ্বীপ সম্পূর্ণ মিয়ানমার সমগ্র ভারতবর্ষ অর্থাৎ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, শ্রীলংকা একটি সম্রাজ্য হিসাবে বিরাজিত ছিল কমপক্ষে ১৯০ বছর। ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান নামে এবং ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে মিয়ানমার বার্মা নামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বৃটিশদের আগমনের পূর্বে এ সমস্ত দেশের নিজেদের কোন কঠর প্রহড়াযুক্ত সীমান্ত ছিলনা। ফলে সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠী বৃটিশদের আগমনের অনেক পূর্ব থেকেই নিজেদের রুটি রুজি উপার্জন ও শান্তিপুর্ণ আবাস স্থাপনের লক্ষ্যে এসব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সেজন্যই আমরা দেখতে পাই যে, শ্রীলংকায় ২৫ভাগ ভারতীয় তামিল জনগোষ্ঠীর বাস। ফিজিতে অর্ধেক নাগরিক ভারতীয়। মালয়েশিয়ায় ১০% ভারতীয় এবং সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে ১০% জনগোষ্ঠী ভারতীয় বংশদভূত। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মিলিতভাবে ৪০% জনগোষ্ঠী চীনাবংশদ্ভুত। দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ে এক সময়ে বৃটিশ কলোনীভুক্ত ছিল। এ দুটি রাষ্ট্রে কমপক্ষে ২৫% মানুষ বৃটিশ বংশদ্ভূত মানুষ প্রায় দুইশত বছর ধরে সেখানে বসবাস করে আসছে। একটি বিরাট সংখ্যার ভারতীয় বংশদ্ভুত জনগণ দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক। বাংলাদেশে বসবাসরত সাঁওতাল ও ওঁড়াও উপজাতির লোকজন বর্তমান ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগনা থেকে আগত জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে উপকূলের বরগুনা জেলার আমতলীতে বসবাসরত রাখাইন জনগোষ্ঠী বর্তমান মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের রাখাইন জনগোষ্ঠীর উত্তর পুরুষ। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা উপজাতির লোকজন মুল মিয়ানমার ভূখন্ড থেকে আগমনকারী জনগোষ্ঠীর উত্তরপুরুষ। আমাদের বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটের মনিপুরি উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ভারতের মনিপুর রাজ্য থেকে আগত জনগোষ্ঠীর উত্তর পুরুষ। ভারতের আসাম রাজ্যের নওগাঁ জেলায় বসবাসরত কয়েক লক্ষ বাঙ্গালী বৃটিশ কলোনিয়াল যুগে বাংলা অঞ্চল থেকে সেখানে গিয়ে বসতী স্থাপন করে। কয়েক লক্ষ মানুষ সারা ভারতবর্ষ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সব জাতি উপজাতী বা বিভিন্ন ভাষাভাষি জনগোষ্ঠী এ সমস্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। হয়ত শতশত বছর পূর্বেই তারা জন্মভূমি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান আবাসভূমিতে বসতী স্থাপনের কাজটি সেরে ফেলেছে। ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে ভারত পশ্চিমে নামে দুটি নুতন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলে বর্তমান ভারতের কমপক্ষে ৫০ লক্ষের মত মুসলমান বর্তমান বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে তাদের বসত ভূমি স্থানান্তর করে। আবার বর্তমান বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ৩০/৪০ লক্ষ হিন্দু ও শিখ জনগোষ্ঠী ভারতে চলে যায় এবং সেখানে তাদের নুতন বসতী স্থাপন করে। এসব স্থানান্তরিত হওয়া জনগোষ্ঠী ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ফিজি, সিঙ্গাপুরের বৈধ নাগরিক। সুদূর অতীতকালে ভারতে মধ্য এশিয়া থেকে আর্য জাতির আগমন ঘটে। পরে শক, হুন, মোগল, পাঠান, আফগানসহ অনেক জাতি গোষ্ঠির মানুষ ভারতে অনুপ্রবেশ করে বসতী স্থাপন করে এবং ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যায়।
বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন -
“শক, হুন, মোগল, পাঠান
এক দেহে হলো লীন’’
একই চিত্র দেখা যায় অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ক্যারিবিয়ান সাগরীয় দেশ সমূহে। এসব দেশের লোকজনের ৯৯ ভাগই নবাগত বা অভিবাসি। সুতরাং বর্তমান মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে যদি বাংলা অঞ্চল থেকে অনুপ্রবেশকারী জনগোষ্ঠী হিসাবে ধরেও নেয়া হয় তাতে কোন অবাস্তবতা বা অবৈধতার লেশ মাত্র নাই। এখন গোটা পৃথিবীতে মানব সমাজের বসবাসের স্থান পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচিত। এটি একটি মানজাতির চিরন্তন প্রক্রিয়া আধুনিক মিয়ানমার এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করিতে পারে না। বর্তমান সময়েও বৃটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ গোটা বিশ্বে নুতনভাবে মানবজাতির আবাস স্থাপন প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। (চলবে)
* লেখক : এডভোকেট, জজ কোর্ট, রংপুর

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ