শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

পানিবদ্ধতায় শহুরে জীবন আটকে আছে

আবু মালিহা : আমাদের দেশের বহুল সমস্যা গুলোর মধ্যে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ‘পানিবদ্ধতা’। বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণ দু’মাস বর্ষাকাল। প্রাকৃতিক ঋতুর এ প্রভাবে অবিরাম বর্ষণে এদেশের মাঠ, ঘাট, খাল, বিল, নদী-নালার পানি প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। তাই পানিময় এ সমস্যার কারণে অনেক সময় দেশের বড় বড় শহরগুলোর অবস্থা করুণ হয়ে দাঁড়ায়। নদী-নালার পানি উপচে যেমন গ্রাম গ্রামান্তর ভেসে যায়, কখনো কখনো বন্যার আকার রূপ নেয়।
এমনকি শহরাঞ্চলও প্লাবিত হয়ে যায় এ বন্যার কারণে বা অবিরাম বর্ষণের প্রভাবে যা কিনা নাগরিক জীবনে অনেক বিড়ম্বনা এবং নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় প্রবল বন্যার কারণে নদীর পাড় ভেঙ্গে যায়, গ্রাম ভেসে যায় এমনকি নদী সংলগ্ন বাজার, মসজিদ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সরকার কর্তৃক দেয়া বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাঁধ ভেঙ্গে সবকিছু তছনছ করে দেয়। বিশেষ করে এবারের দু’ দু’বারের মত বন্যার প্রভাব দেখা দিয়েছে। চৈত্রের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অবিরাম নজীরবিহীন বর্ষণ তাই আরো আতঙ্কিত করে তুলেছে এ দেশের জনজীবন। এখন তো শহরগুলোর অবস্থা নাজুক রূপ নিয়েছে। পানিবদ্ধতায় নগর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এ যেন সারা দেশময় নদী বা পানির সাগরে ভাসছে। গত কয়েক দিন আগেও ঢাকার রাস্তায় নৌকা চলাচলের নজীর সৃষ্টি হয়েছে। মানুষজন নৌকায় করে সড়ক পথে যাচ্ছে, পাশাপাশি গাড়ীর বহরও পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে।
এ কোন অদ্ভূত শহর! পানির নৌকা এখন রাজধানী শহরের সড়ক পথেই চলাচল করছে! আহা... ডিজিটালের রূপ মাত্রা! এ যেন স্বপ্নালোকের বিস্ময় শহর! এমনিতেই এদেশ নদীবিধৃত অঞ্চল! তার পাশাপাশি নগর, বন্দর ও শহর গড়ে উঠেছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ভারী বৃষ্টিতে বা অতিরিক্ত বর্ষণে শহর বন্দরের অবস্থা একটুখানি বেগতিক হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে, রাজধানী ঢাকা শহর সহ বিভাগীয় শহরগুলোর এমন করুণ অবস্থা কেন হবে! এর কারণ হচ্ছে, অপরিকল্পিত ভাবে শহর, বন্দর গড়ে তোলা। বিশেষ করে বিভাগীয় শহর সহ অন্যান্য জেলা শহরগুলোর মধ্যে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, ঘর-বাড়ী, দালান কোঠা নির্মাণ সহ বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন রূপ নিয়মনীতি না মানাই হচ্ছে এর মূল কারণ। যত্রতত্র ভবন নির্মাণ এবং বিশাল বিশাল অবকাঠামোগত মার্কেট ও স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমি ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কোন ছাড় না মেনেই এসব স্থাপনা তৈরী করা হচ্ছে। এতে যেমন কর্তৃপক্ষের দারুন উদাসীনতা আছে, তেমনি আছে দুর্নীতির মাধ্যমে বিল্ডিং কোড না মানার অপসংস্কৃতি। তাই প্রশাসনিক নানা জটিলতা ও দুর্নীতির কারণেই নাগরিক জীবনের ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এবং নাকাল হচ্ছে শহুরে মানুষের জীবন যাপন পরিবেশ, গণমাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত এ সমস্ত সমস্যার কথা নিয়মিত তুলে ধরলেও পরবর্তী সময়ে এ সমস্ত সংকট ও সমস্যার ব্যাপারে প্রশাসনের মাথা ব্যথা খুব একটা আছে বলেও জনসাধারণ মনে করছে না।
এবারের বন্যায় গ্রামাঞ্চলের অবস্থা যেমন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তেমনি শহরগুলোর অবস্থাও আরও মারাত্মক। ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। পানিবদ্ধতায় শহুরে জীবন অচল হয়ে পড়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের ভয়াবহতা দিনে দিনে মারাত্মক আকার ধারণ করছে। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে শুরু করে আওয়ামী এমপি-মন্ত্রীদের কথার মধ্যেই রয়ে যাচ্ছে সমাধানের পরিকল্পনা। বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। জনগণের দুর্ভোগ সহনশীলতার বাইরে গিয়ে মানুষ এখন শুধু হাহাকার করছে, কীভাবে এর থেকে পরিত্রাণ লাভ করা যায়। গত কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণে সমস্ত দেশের পানি বৃদ্ধির ভয়াবহতা চরম আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে ভারত তিস্তা বাঁধের সবগুলো সøুইস গেট খুলে দিয়ে আমাদের অবস্থা আরো বেগতিক হয়ে উঠেছে। যা ভারত দুরভিসন্ধিমূলকভাবে ভরা বর্ষা মৌসুমে স্লুইস গেট খুলে দেয় আর শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রেখে আমাদের কৃষিবিভাগ সহ সমস্ত কিছুতে সংকট সৃষ্টি করে। যা বর্তমান সরকারের মতে ভ্রাতৃত্ব এবং বন্ধুত্বের নমুনা! এ কেমন নির্মম রসিকতা! নতজানু পররাষ্ট্রনীতির এমনই পরিণতি। এ যাবৎ কাল পর্যন্ত (বিশেষ করে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়) ভারত বন্ধুত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি বলে জনগণের বিশশ্বাস!
যাই হোক, বর্তমান সময়ে অতিরিক্ত পানি বৃদ্ধির কারণে গ্রাম-গ্রামাঞ্চল তো বটেই শহর নগর এমনকি রাজধানী ঢাকা সহ বিভাগীয় শহরগুলোর পানিবদ্ধতায় করুণ আকার ধারণ করেছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য অবশ্যই সরকার পানি উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ডেঞ্জার পয়েন্টগুলোতে বাঁধ প্রকল্প রিপিয়ারিং এর মাধ্যমে আরো উন্নত প্রকল্প গ্রহণ করে নতুন নতুন বাঁধ দেয়ার মাধ্যমে শহরগুলোতে পানি ঢুকার সকল পথ বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন এলাকাগুলোতে পরিকল্পিত বাঁধ এবং সুুয়ারেজ নির্মাণের জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে পরিকল্পিত রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণ ও পানি বেরিয়ে যাবার উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যাতে শহরে বৃষ্টির পানি বা অতিরিক্ত বর্ষণের কারণে কোনভাবে পানি আটকে না থাকে।
কখনো কখনো দেখা যায় প্রকল্প বিভিন্ন ধরনের নেয়া হলেও সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এবং কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির কারণে সে সমস্ত প্রকল্প দুর্বল অবকাঠামো তৈরী হলে সেগুলির স্থায়িত্ব এবং নির্মাণ শৈলীর ত্রুটির কারণে টিকে থাকে না। যার পরিণতিতে অসময়ে সেগুলি নড়বড়ে হয়ে পড়ে এবং বাঁধ প্রকল্প ভেঙ্গে পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। তাই এবারের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে দেশের সকল মানুষের সহানুভূতির প্রতি লক্ষ্য রেখে আগামীতে সরকার সত্যিকারের প্রকল্প গ্রহণ করে জনগণের স্বার্থে এবং দুঃখ-কষ্ট লাঘবে যেন প্রকল্প গ্রহণ করে এবং মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে দুর্নীতি বন্ধ করে দেশসেবায় একনিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে পারলেই কেবল পানিবদ্ধতা সহ সকল ধরনের সমস্যা সমাধানের একটা সুরাহা হবে বলে জনগণ প্রত্যাশা করে। নতুবা নিজেদের ধান্ধায় থাকলে কোন দিনই দেশের জনগণের সমস্যার সমাধান হবে না। তাই সরকার দ্রুত পানিবদ্ধতা সহ সব সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবে, দেশের জনগণ সেই আকাঙ্খাতেই প্রহর গুনছে। কেননা, বর্তমান পরিস্থিতিতে শহুরে জীবন যেন পানিবদ্ধতায় আটকে আছে।
-সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ