বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ঢাকায় নিহত সাইফুল ছিল হতদরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্র

খুলনা অফিস : ঢাকায় নিহত জঙ্গি সাইফুল ইসলাম ছিল হতদরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্র। সাইফুলের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না এলাকাবাসীও। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাও বলেছেন, সাইফুলের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা হয়তো থাকতে পারে। তবে এলাকায় চলাফেরার সময় তার মধ্যে কখনোই সন্দেহজনক আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি।

সাইফুল ইসলাম খুলনার দৌলতপুরস্থ সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। সে খুলনার নৌ-বাহিনী কলোনিতে থেকে লেখাপড়া করত। গত ৪ আগস্ট চাকুরির সন্ধানে সাইফুল খুলনা থেকে ঢাকায় যায়। ঢাকায় যাওয়ার পর সর্বশেষ সে গত রোববার বাড়িতে যোগাযোগ করেছিল। সেসময় জানিয়েছিল সে সোমবার বাড়িতে আসবে। কিন্তু সোমবার বাড়িতে আসেনি। মঙ্গলবার তার আত্মঘাতির সংবাদ পাওয়া যায়। এ খবর পেয়ে তার প্রতিবন্ধী মা আসমা বেগমসহ তার পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় ডুমুরিয়া থানা পুলিশ সাইফুল ইসলামের পিতা নোয়াকাটি মাঠেরহাট জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. আবুল খায়েরকে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। 

এলাকাবাসী জানায়, খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়নের নোয়াকাটি গ্রামের হাফেজ আবুল খায়েরের একমাত্র ছেলে সাইফুল ইসলাম। সে ২০১১ সালে স্থানীয় উলা দাখিল মাদরাসা থেকে দাখিলে গোল্ডেন জিপিএ-৫ অর্জন করে। ২০১৩ সালে খুলনা আলিয়া মাদরাসা থেকে আলিম পাস করে খুলনার সরকারি বিএল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হয়ে শেষ বর্ষে পড়াশুনা করছিল। সাইফুল ইসলাম তার পিতার একমাত্র ছেলে। এ ছাড়া তার সাবিয়া খাতুন ইরানী ও তামান্না খাতুন নামে দুটি বোন রয়েছে। সাইফুলের মা আসমা বেগম একজন প্রতিবন্ধী। অভাব অনটনের মধ্যে তাদের সংসার চলে।

এদিকে নিহত সাইফুল ইসলামের প্রতিবেশীরা জানান, হতদরিদ্র পরিবারের একমাত্র ছেলে সাইফুল ইসলাম। সে খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্টে লেখাপড়া করতো। মাঝে মধ্যে সে বাড়িতে আসতো। তাকে সে এলাকার কোন বাজে ছেলেদের সাথে চলাফেরা করতে ও আড্ডা দিতে দেখা যায় নি। এলাকায় সে মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিল।

সাইফুলের বোন সাবিয়া খাতুন ইরানী জানায়; তার ভাই সাইফুল ইসলাম বিএল কলেজে পড়াকালীন সময় একটি মেসে থাকতো এবং মাঝে মধ্যে বাড়ি আসতো। আমার পিতার স্বল্প আয়ে সংসার চালানোর পর ভাইকে লেখাপড়ার খরচ দিতে পারতো না। এ জন্য সে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতো। সে সব সময় পিতা-মাতাকে বলতো আমাদের এই দুর অবস্থা থাকবে না। এ বছরের মধ্যেই আমি চাকুরি নিয়ে সংসারের খরচ বহন করতে পারবো। তবে সে কারোর সাথে আড্ডা দিত না। তার ভাই সাইফুল ইসলাম গত ৪ আগস্ট শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করে চাকরি খোঁজার কথা বলে বাড়ি থেকে চলে যায়। এলাকায় সে কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না বলেও তিনি জানান। সাইফুলের ছোট বোন ইরানী বলেন, তার ভাই কখনো শিবির বা জেএমবির সাথে জড়িত ছিলো না।

সাইফুলের বোন ইরানী খাতুন বলেন, ‘সাইফুল ছিল শান্ত প্রকৃতির ছেলে। এলাকায় যখন আসত সে কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ পর্যন্ত করতো না। সে পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। জঙ্গির ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা আমরা মেনে নিতে পারছি না। এটি আমাদের পরিবারের জন্য দুঃখজনক ঘটনা। এলাকার কোনও লোক সাইফুলের বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ মেনে নেবে কি না আমাদের সন্দেহ আছে। উলা মাদরাসায়ও সাইফুলের সুনাম রয়েছে।’

সাইফুলের ছোট বোন তামান্না খাতুন বলেন, ‘ভাই (সাইফুল) ঢাকায় যায় চাকরি খোঁজার জন্য। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দেবে বলে বাড়িতে জানিয়েছিল।’

সাইফুলের পিতার চাচাতো ভাই আব্দুর রউফ মোল্লা বলেন, ‘ছোট বেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। এ ছেলে এ ধরণের কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। এলাকার কেউই তা বিশ্বাস করবে কি না সন্দেহ আছে।’

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন সরদার বলেন, ‘সাইফুল খুলনায় থেকে পড়াশোনা করতো। তবে মাঝে মাঝে গ্রামে আসতো। আমরা তার জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িত হওয়া সম্পর্কে কোনও তথ্য আগে জানতে পারিনি।’

সাহস ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস জানান, সাইফুলের ব্যাপারে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা বা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকার কোনও তথ্য আগে এলাকার মানুষ জানতে পারেনি। সে লেখাপড়া নিয়েই খুলনায় ব্যস্ত থাকতো। তার সম্পর্কে এ বিষয়টি নিয়ে আরও খোঁজ-খবর নেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

সাহস ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘দরিদ্র পরিবারের ছেলে সাইফুল। ওর বাবা খয়ের মসজিদ থেকে পাওয়া আয় দিয়ে সংসার চালান। পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া চার শতক জমিই তার ভরসা। তার কোনও কৃষি জমিও নেই। খয়ের বা সাইফুলের সম্পর্কে আগে কখনও এ ধরণের তথ্য শোনা যায়নি।’

ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাবিল হোসেন জানান, দুপুরের পর সাইফুলের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানকালে ওই বাড়ি থেকে সন্দেহজনক কোনও সামগ্রী পাওয়া যায়নি।

খুলনা জেলা পুলিশ সুপার মোল্যা নিজামুল হক বলেন, নিহত সাইফুল ২০১১ সালে উলা দাখিল মজিদিয়া মাদরাসা থেকে দাখিল পাশ করেন। তিনি ২০১৪ সালে খুলনা শহরের আলীয়া কামিল মাদরাসা থেকে আলীম পাশ করেন। সর্বশেষ সাইফুল সরকারি বিএল কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান সম্মান শ্রেণীর শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলো।

উল্লেখ্য, সাইফুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঢাকার পান্থপথের ওলিও ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি হোটেলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াত সদস্যদের অভিযানে নিহত হন।

খুলনা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে নোয়াকাটি গ্রাম। খুলনা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার গেলে ডুমুরিয়া উপজেলা সদর বাসষ্ট্যান্ড। সেখান থেকে ১ কিলোমিটার গেলে ডুমুরিয়া থানা। থানা থেকে ডুমুরিয়া বারোআড়িয়া সড়কের প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে রাস্তার পাশেই সাইফুল ইসলামদের বাড়ি।

সেখানে উপস্থিত হলে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সের শত শত নারী, পুরুষ। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলে দেখা যায় টিনশেডের চাল মাটির দেয়াল দেয়া জীর্ণ ঘর। ঘরের মধ্যে প্রচুর অন্ধকার। ওই ঘরের খাটের উপর বসে চিৎকার করে কাঁদছে সাইফুলের ছোট বোন তামান্না খাতুন। তারই পাশে নির্বাক বসে আছেন সাইফুলের বাক প্রতিবন্ধি মা আসমা বেগম। অঝোরে কেঁেদ চলেছে সাইফুলের আরেক বোন ইরানী খাতুন।

স্থানীয় এলাকাবাসী মো. জসিম উদ্দিন জানায়, সাইফুল খুব ভাল ছেলে ছিল। মুরব্বিদের সম্মান করত। কিন্তু কিভাবে জঙ্গি হল বুঝতে পারছি না।

সাহস ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য খান শফিকুল ইসলাম বলেন, সাইফুলকে খুবই ন¤্র, ভদ্র ছেলে হিসেবে জানি। সে কারও সাথে ঝগড়া করেছে এমন শুনিনি। ১০ দিন আগে বাড়ি থেকে নিজের একাডেমিক সার্টিফিকেট, ছবিসহ প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র নিয়ে সাইফুল ইসলাম ঢাকায় যায়। তারপর মঙ্গলবার সাইফুলের নিহত হওয়ার কথা জানতে পারি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ