শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম পার্বতীপুর রেল জংশন বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত

আমজাদ হোসেন, পার্বতীপুর : বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিম জোনের সর্ববৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশনের নাম পার্বতীপুর। রেল সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৯ সালে স্থাপিত ১৩ হাজার ৯৪২ ফুট আয়তনের প্লাটফর্ম এই রেলওয়ে জংশন দিয়ে বর্তমানে আন্তঃনগর ট্রেনসহ প্রতিদিন ৫২টি ট্রেন ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, পঞ্চগড়, চিলাহাটি, বগুড়া, বুড়িমারী, রমনা বাজার যাতায়াত করে। প্রতিদিনেই ৭০/৮০ হাজার যাত্রী ট্রেন থেকে উঠানামা করে। কিন্তু পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশন ৪৫ বছরেও আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে আজ পর্যন্ত বঞ্চিত।
পার্বতীপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি, মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি, ২৫০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বড় পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম উত্তর-পশ্চিম মৎস্য সম্প্রসারণ প্রকল্প, রেলওয়ে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা (কেলোকা), রেলওয়ে ডিজেল কারখানা, রেলহেড অয়েল ডিপো স্থাপন হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম এই ৮টি জেলায় ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, কেরোসিন এসব জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সে কারণে ব্রড গেজ লাইনে খুলনা হতে এবং মিটার গেজ লাইনে চট্টগ্রাম হতে রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল এই ডিপোতে এনে সরবরাহ করা হয়। খোলাহাটি এলাকায় বীর উত্তম শহীদ মাহবুব সেনানিবাস, বৃটিশ আমলে নির্মিত ৮টি জেলায় দেশী মদ সরবরাহ করার জন্য বৃহত্তম মাদকদ্রব্য পণ্যাগার। ৫টি জেলার প্রশিক্ষণকারীদের জন্য জাতীয় ও গবেষণা প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা বিষয়ক আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ডাক বিভাগের পোস্টাল মহকুমা পার্বতীপুরের অবস্থান। রেলওয়ের হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও বিদেশী মিশনারী দ্বারা পরিচালিত ল্যাম্ব হাসপাতালের কারণে দেশী বিদেশী যাত্রীদের গমনাগমনে জংশনটির গুরুত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ। কিন্তু ৪৫ বছরেও যাত্রী সেবার মান উন্নত হযনি। রেলের তুলনায় বাসভাড়া দেড় থেকে দুই গুণ বেশী হওয়ায় ও নিরাপত্তা ঝুঁকি কম থাকায় প্রতি মাসে যাত্রীসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে রেলের রাজস্ব আয়ের পরিমাণও। অথচ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় জোনের ১৩৭ বছরের পুরানো ও দেশের সর্ববৃহৎ ৪ লাইনের ৪ জংশন স্টেশনটি আজ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত।
বর্তমান সরকারের ৪ মন্ত্রী, ২ সচিব ও রেলওয়ের মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাগণ পার্বতীপুর রেলস্টেশন সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনের সময় এলাকাবাসী রেল স্টেশনের সমস্যায় কথা তুলে ধরা হলেও সবাই শুধু উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু স্টেশনের উন্নয়নের কাজ বাস্তবায়ন হয়নি। পার্বতীপুর রেল স্টেশনের ৫টি প্লাটফরম রয়েছে। প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ফুট। ১নং প্লাটফরমে ৪শ’ ফুট, ২ ও ৩ নম্বর যাত্রী ছাউনি ৬শ ফুট ও ৪ ও ৫নং প্লাটফরমের যাত্রী ছাউনি মাত্র ২শ ফুট। বৃটিশ আমলে নির্মিত যাত্রী ছাউনি অধিকাংশ জরাজীর্ণ। প্রয়োজনীয় ছাউনির অভাবে বর্ষাকালে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কিছুদিন পূর্বে যাত্রী ছাউনি মেরামত করলেও বিভিন্ন স্থানের ছিদ্র দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। প্লাটফরমগুলো নিচু ও খানাখন্দের কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ যাত্রীর ট্রেনে ওঠানামা করতে কষ্ট হয়। প্লাটফরমের কিছু স্থানে বৃষ্টির পানি পড়ে জমা হয়। সম্প্রতি জোড়াতালি দিয়ে প্লাটফরমের সংস্কার কাজ করা হয়েছে। তবে উঁচু করা হলেও এই দুই প্লাটফরমে প্রয়োজনীয় যাত্রীশেড তৈরি করা হয়নি। স্টেশনের পূর্ব পার্শ্বে রেল লাইনে পাথর ও মাটি ভরাট করা জরুরী। এই জায়গা ও এই নিচু রেললাইন উপরে আয় প্লাটফরম নিচে চলে গেছে।
এই জায়গা নিচু হওয়ার ফলে প্রায়ই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। রেলওয়ে জংশন এলাকায় প্রায় প্রতিটি লাইনের পাশে পর্যাপ্ত ঘাস থাকায় গবাদি পশু অবাধে বিচরণ করে। এ কারণে রেল লাইনে অনেক গবাদিপশু কাটা পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। তাছাড়া গবাদিপশু প্লাটফরমে চলাফেরায় পায়খানা করে গোবর যেখানে সেখানে থাকায় যাত্রী সাধারণের অসুবিধা সৃষ্টি করেছে।
১৯৩০ সালে নির্মিত ২০ ফুট উঁচু ও ৪শ ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যরে রেলওভার ব্রীজে ছাউনি না থাকায় রোদ বৃষ্টিতে যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো স্টেশনে পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। স্টেশনের ২,৩,৪ ও ৫নং প্লাটফরমে কোন টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। যাত্রী সাধারণ প্রয়োজনের তাগিদে শহরের গণশৌচাগারে গিয়ে প্রকৃতির কাজ সেরে আসেন। রেল স্টেশনে পানির জন্য হাহাকার অবস্থা। প্রতিনিয়ত যাত্রীদের পানির জন্য ছুটাছুটি করতে হচ্ছে। ১নং প্লাটফরমে উত্তরে টিকিট কাউন্টার সংলগ্ন একটি পানির ট্যাপ ও ২নং প্লাটফরমে উত্তরে টিউবওয়েল রয়েছে। যা দিনের বেশীল ভাগ স্টেশনের চায়ের স্টলগুলোর দখলে থাকে। পার্বতীপুর স্টেশনের ২ ও ৩নং প্লাটফর্মে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক দুটি উচ্চ শ্রেণীর হোটেল ও রেস্টুরেন্ট বৃটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকে ভালভাবে চলে আসছিল। স্বাধীনতার কয়েক বছরও এই দুটি হোটেলে যাত্রীদের খাবার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু পরে হোটেল দুটি বন্ধ হয়ে যায় এবং পরিত্যাক্ত অবস্থায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এই দুটি হোটেল সংস্কার করে রেল কর্তৃপক্ষ ভাড়া দিলে আয়ের উৎস এবং ভোজনালয় দুটি চালু থাকলে যাত্রী সাধারণের খাবার ব্যবস্থার সুবিধা হত। যাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগার থাকলেও যাত্রীর বসার স্থান পায় না। কারণ সব সময় থাকে তালাবদ্ধ। ১নং প্লাটফর্মে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ভিন্ন ভিন্ন বিশ্রামাগার থাকলেও দেখা যায়। শুধুমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণির মহিলা বিশ্রামাগারটি খোলা থাকে। সেখানে মহিলা-পুরুষ একত্রে অবস্থান করায় মহিলারা অস্বস্তি বোধ করে। এর কারণ হিসেবে জানা যায় ওয়েটিং রুমে বেয়ারা ও আয়ার ৪টি পদে লোক থাকার কথা থাকলেও আছে শুধু একজন বেয়ারা। সুইপারের সংখ্যা খুব নগণ্য। নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবে স্টেশনটির বিভিন্ন স্থান নোংরা আবর্জনা স্তূপে ভরে থাকে। ছিন্নমূল অনেক মানুষ প্লাটফর্ম ও আশেপাশের এলাকায় বসত গড়ে তুলে প্লাটফম ও আশেপাশে এলাকায় অপরাধের আখড়ায় পরিণত করেছে। জংশনের পণ্যবাহী ট্রেনের মালামাল ওজনের জন্য একমাত্র মেশিনটিও দীর্ঘদিন ধরে অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। জংশনে চলাচলকারী ট্রলি, ডাক বিভাগের ভ্যানগুলোতে রাবারের চাকা না থাকায় শব্দ দূষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক বাতির অভাবে সন্ধ্যার পর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রেলওয়ে এলাকা। ফলে দুর্বৃত্ত, ছিচকে চোর এই সুযোগে যাত্রী সাধারণের ব্যাগ ও জিনিসপত্র চুরি করে। তাছাড়া যাত্রী সাধারণ ট্রেনে উঠানামার সময় ভিড়ে ছিনতাইকারীরা মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু যাত্রী সাধারণ তা জানতেই পারে না। ১নং প্লাটফর্মে বৈদ্যুতিক পাখা থাকলেও ২, ৩, ৪, ৫ নং প্লাটফর্মে কোন বৈদ্যুতিক পাখা নেই ফলে যাত্রী সাধারণ গরমে অতিষ্ট হয়ে যায়। টিকিট কাউন্টারে মোসাফির খানায় আরও কিছু বৈদ্যুতিক পাখা দরকার ফলে যাত্রী সাধারণ আবেদন করেছেন। আবার প্রায় লক্ষ্য করা যায় যে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকছে। সেই মুহূর্তে অন্য আরেকটি যাত্রীবাহী ট্রেন গন্তব্যস্থানে প্লাটফরম থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক যাত্রী গন্তব্য স্থান যেতে ট্রেন ফেল করতে বাধ্য হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় বেশীর ভাগ সময় মাইকিং না করাতে অনেক সময় যাত্রীরা নির্ধারিত ট্রেন ফেল করে ঘন্টায় পর ঘন্টা ধরে প্লাটফরমে অপেক্ষা করতে হয়। ইহাছাড়া ট্রেনের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য এখানে কোন অনুসন্ধান কেন্দ্র নেই। টিকিট বিহীন রেল ভ্রমণ রোধ নিশ্চিত করতে বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে স্টেশনের পূর্ব পার্শ্বে একটি লোহার বেড়া দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অযতœ ও মেরামতের অভাবে জরাজীর্ণ হলে তা লোহার বেড়াটি সম্পূর্ণ চুরি হয়ে যায়। বর্তমানে বাউন্ডারী ওয়াল বা অন্য কিছু দিয়ে ঘেরা দেওয়া হয়নি। ফলে টিকিটবিহীন যাত্রী সাধারণ অনায়াসে চলাফেরা করছে। প্রায় ৫০-৬০ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত পার্বতীপুর শহর রেলপথ দ্বারা নতুন বাজার ও পুরাতন বাজার এলাকা দু’ভাগে বিভক্ত। শহরের নতুন বাজার ঢাকা মোড়ের নিকট অর্থাৎ স্টেশনের উত্তরে ১নং রেলগেটটি দিনরাত ২৪ ঘন্টা বন্ধ থাকায় জনগণকে প্রায় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। জনসাধারণ বিকল্প পথে রিক্সা, ভ্যান, মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহনে চলাফেরা করতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে সব সময় ট্রেন যাতায়াত করার অজুহাতে রেল গেটটি সবসময় বন্ধ করে রাখা হয়। তাছাড়া এই গেটে ১জন মাত্র গেটম্যান কর্মরত রয়েছে। এই রেলগেটের উপর একটি ওভারব্রীজ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু এলাকাবাসীর এ দাবী আজও বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে এই স্টেশনে দিয়ে ঢাকাগামী দ্রুতযান, একতা ও নীলসাগর আন্ত:নগর এক্সপ্রেস, রাজশাহীগামী তিতুমীর ও বরেন্দ্র আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ও খুলনাগামী রূপসা ও সীমান্ত আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর চাহিদার তুলনায় আসন বরাদ্দ কম থাকায় ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটে যাতায়াতকারী ট্রেনযাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। টিকিট না পাওয়ার কারণে বুকিং স্টাফদের সাথে যাত্রীদের ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। ট্রেনের টিকিট না পেয়ে বাধ্য হয়ে এসব ট্রেনযাত্রী বাসযোগে সড়ক পথে চলাচল করছে। সব ট্রেনের টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি হলেও যাত্রী সেবার মান একেবারে বাড়েনি। যাত্রীদের অভিযোগ রেলওয়ে কর্মরত একশ্রেণীর এ্যাটেনডেন্ট যাত্রী সেবার চেয়ে নিজের পকেটের সেবার দিকে বেশী নজর দিয়ে থাকে।
স্টেশনে চলছে প্রশাসনিক নৈরাজ্য, টং দোকানীদের প্লাটফর্মে অত্যাচার, নোংরা পরিবেশ, পানির অভাব আলোর অভাব বখাটে, মাদকাসক্ত, ভাসমান পতিতা, চোরাচালানি ও ছিচকে চোরের উপদ্রপে যাত্রী সাধারণকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে।
পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশন উন্নয়নের জন্য পার্বতীপুর রেলওয়ের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী প্রায় ১০০ কোটি টাকা ইস্টিমেট করে রেল কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করলেও কোন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম ঐতিহ্যবাহী পার্বতীপুর জংশনখ্যাত রেল স্টেশন আজ তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সেজন্য স্টেশনটি রাজশাহী বা সিলেটের মত আধুনিকীকরণ নির্মাণ কাজ করা বিশেষ প্রয়োজন বলে এলাকাবাসী ও যাত্রী সাধারণ দাবি জানিয়েছেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ