শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

উসাইন বোল্টের অজেয় থাকার রেকর্ড

নাজমুল ইসলাম জুয়েল : মানুষের প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির মিল খুব কম সময়ই হয়ে থাকে। তবে কিংবদন্তীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পর্ন আলাদা। যেমন উসাই বোল্ট, জ্যামাইকার এই গতি দানবের শেষটা মনের মতো হয়নি। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে শূন্য রানে ফিরেছিলেন স্যার ডন ব্রাডম্যান। ফুটবলের ঈশ্বর দিয়াগো ম্যারাডোনা, পেলে, জিনেদিনে জিদান এদের কারও বিদায়ই রঙিন ছিলো না। বিদায়টা রাঙাতে পারেননি গতি দানব উসাইন বোল্টও। হিটে ভালো টাইমিং হয়নি। সেমিফাইনালের সুবিধা করতে পারেননি। হতাশার ধারাবাহিকতা ফাইনালে কাটিয়ে উঠতে পারলেন না বোল্ট। ক্যারিয়ারে গত নয় বছরে এই প্রথম কোনো দৌড়ে তৃতীয় হয়ে শেষ করলেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি। নিজের শেষ ব্যক্তিগত দৌড়ে সোনা জিততে ব্যর্থ হয়ে বোল্ট যেন প্রমাণ করলেন, তিনিও মানুষ! গতির ঝড় তুলে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারে সোনার পদক জিতেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিন গ্যাটলিন। লন্ডন স্টেডিয়ামে ৯.৯২ সেকেন্ডে সবার আগে দৌড় শেষ করেন গ্যাটলিন। ৯.৯৪ সেকেন্ডে রূপা জিতেন যুক্তরাস্ট্রের ক্রিস্টিয়ান কোলম্যান। আর ৯.৯৫ সেকেন্ডে তৃতীয় হন বোল্ট। ২০০৫ সালে হেলসিঙ্কির আসরের এক যুগ পর বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারে সেরা হলেন গ্যাটলিন। ১০০ মিটারে শেষটা বোল্টের সুখকর হলো না বটে। তবে সমর্থকদের হৃদয়ে তিনি চিরকাল অমর হয়েই থাকবেন ১০০ মিটারে ৯.৫৮ সেকেন্ড রেকর্ডের মালিক। হেরে স্বাভাবিকভাবেই হতাশ বোল্ট। তবে সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি। ‘এটা চমৎকার ছিল, আমি এতদিন যা চাইতাম তাই পেতাম, এখন আর সেটা হচ্ছে না। জানতাম, তারা আসবে এবং আমাকে সমর্থন করবে। আমি স্বরূপে বেরিয়ে আসতে পারিনি এবং জিততে পারিনি বলে দুঃখিত। আমার শুরুটাই আমাকে শেষ করে দিয়েছিল। সাধারণত আমি ধীরে ধীরে আরও ভালো করি কিন্তু এটা একযোগে আসেনি। এ কারণেই হেরেছি। সমর্থন ছিল অসাধারণ। তারা আমার সঙ্গে ছিল এবং আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছে এবং আমি এটাকে সম্মান জানাই।’ আগামী ১২ অগাস্ট ৪*১০০ মিটার রিলেতে দৌড়ে ক্যারিয়ারে ইতি টানবেন ‘অমর’ উসাইন বোল্ট।
দেখা যাক শেষটা কতটা রাঙ্গাতে পারেন বিদ্যুৎ বোল্ট। বিদ্যুৎ চমকের মতই যেন উত্থান তার। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে গতির ঝড় তুলেছিলেন। রেকর্ডের পর রেকর্ডে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন রেকর্ড বইয়ের সব পাতা। ৯টি অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী (এক সতীর্থের ডোপ পাপে এখন ৮টি) উসাইন বোল্টই পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম মানব। ২০০৯ সালে বার্লিন বিশ্ব অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশিপে ৯.৫৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে যে রেকর্ড তিনি গড়েছেন, সেটা আদৌ কেউ ভাঙতে পারবে কি না সন্দেহ। সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময়কে তাই বেধে রাখতে পারেননি বিশ্বের দ্রুততম মানবও। এক দশকেরও কম সময় হয়তো ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ঝড় তুলেছেন। সময়ের বহমানতায় অবশেষে তার বিদায় নেয়ার সময় হয়ে এসেছে। উসাইন বোল্টও তার বুটজোড়া তুলে রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। রিও অলিম্পিকের আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটাই তার শেষ অলিম্পিক এবং ২০১৭ লন্ডন অ্যাথলেটিক মিটে ক্যারিয়ারের শেষ দৌড়টি দেবেন তিনি। এরপরই শেষ হয়ে যাবে সর্বকালের সেরা অ্যাথলেটের ক্যারিয়ার। বয়ে গেছে সময়।
২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক থেকে আর দ্বিতীয় হননি উসাইন বোল্ট। যেখানেই দৌড় দিয়েছেন, সেখানেই মুকুট উঠেছে তার মাথায়। ২০১১ দায়েগু ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়েছিলেন একবার শুধু। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে এটা অন্যতম এক ট্র্যাজেডি। এছাড়া উসাইন বোল্ট সব জায়গায় প্রথম; কিন্তু এবার আর পারলেন না। এখন তিনি কতটা সেরা এই প্রশ্ন ওঠার যথেষ্ট কারণ আছে। একে তো ইনজুরি। বয়সের একটা ছাপও পড়ে গেছে শরীরের ওপর। তারওপর এই মৌসুমে বোল্ট এতটাই ধীরগতিতে দৌড়াচ্ছেন যে অতিবড় ভক্তও এখন ভয় পাচ্ছেন, লন্ডন অলিম্পিক স্টেডিয়ামের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে না তিনি পেছনে পড়ে যান! দুইবার তিনি ১০০ মিটারের দৌড় শেষ করেছেন ১০ সেকেন্ডের বেশি সময় নিয়ে। সর্বশেষ দুই সপ্তাহ আগে মোনাকোয় তিনি দৌড়েছেন ১০ সেকেন্ডের কম সময় নিয়ে, ৯.৯৫ সেকেন্ডে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড মিটে তো বোল্টের সব প্রতিদ্বন্দ্বীই দৌড়ে অংশ নিয়েছেন। জাস্টিন গ্যাটলিন, ইয়োহান ব্লেক- সবাই’ই তো উপস্থিত। তো বোল্ট কী পারবেন, নিজের মুকুট ধরে রাখতে। এমনই এক আশা-আশঙ্কার দোলাচলে দুলতে দুলতে হয়তো দর্শকরা বসবেন টিভি সেটের সামনে, মাত্র ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ের দুনিয়া কাঁপানো এক ক্রীড়া ইভেন্ট- অ্যাথলেটিকের ১০০ মিটার স্প্রিন্ট দেখতে।
এদিকে বিদায় বেলায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন বোল্ট। খেলাধুলার জগতে অনেক বছর থেকেই ঢুকে পড়েছে ডোপিংয়ের বিষ। অ্যাথলেটরা নিষিদ্ধ ওষুধ ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন। বিষয়টার দ্রুত সমাধান করতে না পারলে মৃত্যু ঘটবে অ্যাথলেটিক্সের। অ্যাথলেটদের এমন সতর্কবার্তাই দিয়েছেন উসাইন বোল্ট। বোল্টের মতে, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মদদে ডোপিংয়ের ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর ওই বাজে অবস্থা কাটিয়ে উঠছে ক্রীড়াবিশ্ব। তবে অবৈধ ওষুধ ব্যবহারের প্রবণতাকে পুরোপুরি বন্ধ করতে আরও অনেক কিছু করতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্বের দ্রুততম মানব।
ওয়ার্ল্ড মিট শুরুর আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না, এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আর হতে পারে। তবে এখন তা কাটিয়ে ওঠার পথে। আশা করা যায়, অ্যাথলেটরা দেখবে কি হচ্ছে এবং বুঝতে পারবে তারা যা করছে তা বন্ধ না করলে খেলাধুলা শেষ হয়ে যাবে।’ বোল্টের আলো ঝলমলে ক্যারিয়ারেও পরোক্ষভাবে ডোপিংয়ের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অলিম্পিকের গত তিন আসরে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার এবং ১০০ মিটার রিলেতে সোনা জিতে ইতিহাস গড়েছেন তিনি। কিন্তু ডোপিংয়ের কারণে গতিদানবের অনন্য ‘ট্রিপল ট্রিপল’ রেকর্ডটি এখন আর নেই। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে জ্যামাইকার ১০০ মিটার রিলেতে সোনাজয়ী দলের সদস্য নেস্টা কার্টারের ডোপ নেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় বোল্টকে ওই ইভেন্টের পদক ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। ডোপিংয়ের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার বোল্ট বিশ্বাস করেন, ডোপিং নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা সমস্যা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, ‘ডোপিং নিয়ে আপনি কখনোই সুখী হতে পারেন না। এটা খেলাধুলার জন্য ভালো নয়। তবে অনেক বছর ধরে আমরা ভালো কাজ করছি। এটা পরিষ্কার হচ্ছে এবং আমরা অনেক অ্যাথলেটকে ধরছি। একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, আপনি যদি ধোঁকা দেন তাহলে আপনি ধরা পড়বেন।’ এ বছর মাত্র তিনবার ট্র্যাকে নেমেছেন বোল্ট। প্রতিবারই জিতেছেন, তবে নিজের সেরা ছন্দে ছিলেন না। প্রথম দু’বার তো ১০০ মিটার শেষ করতে ১০ সেকেন্ডের বেশি সময় নিয়েছেন। দুই বছর পর পর হওয়া অ্যাথলেটিক্স বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে মোট ১১টি সোনা জিতেছেন বোল্ট। ২০১১ সালে ১০০ মিটারে ডিসকোয়ালিফাইড হয়েছিলেন তিনি। এটি ছাড়া ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি আসরে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার এবং ১০০ মিটার রিলেতে সেরা ছিলেন তিনি। এবারের আসরে ২০০ মিটারে অংশ নিচ্ছেন না, বোল্ট সেটা জানিয়ে রেখেছেন আগেই।
এদিকে ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছাটার পালে এবার বোধহয় হাওয়া লাগতে যাচ্ছে। বহুবার বলেছেন তার ইচ্ছাটির কথা। কিন্তু সবাই সেটা মজা বলেই ধরে নিয়েছেন। কারণ বিশ্বের দ্রুততম মানব এমনই, সংবাদ সম্মেলনে হাসি ঠাট্টাতেই সব প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। কিন্তু এবার বোল্টের এজেন্ট গুরুত্বের সঙ্গে জানালেন লন্ডনের ট্র্যাক থেকে অবসর নেওয়ার পর বোল্ট পেশাদার ফুটবলে নাম লেখাবেন। এরই মধ্যে নাকি ইউরোপের নামকরা অন্তত ১২টি ক্লাব থেকে তাকে ট্রায়াল দেওয়ার অনুরোধ করেছে। ‘উসাইনের বয়স এখন মাত্র ৩০, আরও চার বছর তিনি ট্র্যাকে দাপিয়ে বেড়াতে পারতেন। কিন্তু সেটা তিনি করবেন না, কেননা ট্র্যাক থেকে যা অর্জনের তার সবই পেয়েছেন তিনি। এখন বোল্টের মাথায় ঘুরছে শুধুই ফুটবল।’
ব্রিটিশ একটি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রিকি সিমস নামের বোল্টের এজেন্ট এমনটাই জানিয়েছেন। এটাও নিশ্চিত করেছেন যে জার্মানির ক্লাব বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডে বোল্ট অনুশীলনও করবেন। ‘ট্র্যাক থেকে অবসর নেওয়ার পর তার সামনে হাজারটা পথ খোলা রয়েছে। বোল্ট নিজেও তার জীবনের নতুন অধ্যায় খোলার অপেক্ষায় আছে। বিশেষ করে ফুটবল নিয়েই তার আগ্রহ বেশি। আমি কোনো ক্লাবের নাম বলতে পারব না, তবে এটা জেনে রাখুন বোল্ট ট্র্যাক থেকে অবসর যাওয়ার পরই কয়েকটি ক্লাবে ফুটবল ট্রায়াল দেবেন।’ কিন্তু ইউরোপীয় ফুটবল কি এতটাই সহজ। সেখানে অন্য খেলার কোনো তারকা কি শুধু চাইলেই নাম লেখাতে পারেন? ‘পুমার প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে বোল্টের কথা হয়েছে। তিনি বোল্টের বিশেষ বন্ধু, একই সঙ্গে বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড ক্লাবের অন্যতম পরিচালকও। তিনিই বলেছেন অন্তত ছয় থেকে নয় মাস ওই ক্লাবটির সঙ্গে ফুটবল অনুশীলন করতে। আর বোল্ট এমন একজন ক্রীড়াবিদ যে কোনো নয় মাসের মধ্যে অন্তত ফুটবলে নিজেকে একটা জায়গায় পৌঁছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।’ অর্থাৎ, ট্র্যাক থেকে অবসর নেওয়ার পর ফুটবলেই যে পুরো মনোযোগ দেবেন বোল্ট, তা এক প্রকার নিশ্চিত।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ