শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

হেপাটাইটিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস জনিত লিভার প্রদাহ বিশ্রামে থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একা একাই রোগটি সেরে যেতে পারে। তবে কোন কোন সময় প্রদাহের তীব্রতা বেশি হলে হাসপাতালে ভর্তি থেকে সাপোর্টিভ চিকিৎসা নেয়া লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে থেকে চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন হয়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস জনিত দীর্ঘ মেয়াদী লিভার রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। বিশ্বায়নের কল্যাণে এবং বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উত্তরোত্তর উন্নতি হওয়ায় বাংলাদেশে বসেই এই চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ তৈরী হয়েছে।
হেপাটাইটিস বি ভাইরারেস চিকিৎসা : হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের চিকিৎসা নির্ভর করে মানব লিভারে ‘বি’ ভাইরাসের দশার ওপর। আমরা আগেই জেনেছি, হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস লিভারের কোষে সুপ্ত অবস্থায় বহুদিন অবস্থান করতে পারে। এছাড়া বংশবৃদ্ধি করতে থাকলে উক্ত ভাইরাসের বিপরীতে ইনফ্লামেশন হয়। ফলে লিভার কোষের ক্ষতি সাধন হয় এবং ধীরে ধীরে তা লিভার সিরোসিস-এর দিকে ধাবিত হয়।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস লিভার কোষে সুপ্তাবস্থায় থাকলে শুধুমাত্র এইচবিএস এজি নামক মার্কারটি রক্তে পাওয়া যায় (অর্থাৎ এইচবিএস এজি পজিটিভ পাওয়া যায়)। এই অবস্থাকে হেপাটাইটিস ‘বি’ ক্যারিয়ার দশা বলে। ক্যারিয়ার দশায় কোন শারীরিক সমস্যা হয় না এবং একজন স্বাভাবিক মানুষের মতই জীবন যাপন করা যায়। তবে এ অবস্থায় কমপক্ষে ছয় মাস অন্তর অন্তর লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শে থেকে হেপাটাইটিসের দশা পরীক্ষা করে নিতে হয়। কেন না ‘বি’ ভাইরাস যে কোন সময় সুপ্তাবস্থা থেকে বংশবৃদ্ধি শুরু করতে পারে। বংশবৃদ্ধিরত অবস্থায় দীর্ঘ দিন যাবত লিভার প্রদাহ হতে থাকে। এ অবস্থাকে দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহ তথা ক্রনিক হেপাটাইটিস বলা হয়। ক্রনিক হেপাটাইটিস অবস্থা থেকে চিকিৎসা গ্রহণ শুরু করতে হয়। এ অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহণ না করলে সিরোসিস হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। ক্রনিক হেপাটাইটিস ও সিরোসিসের প্রাথমিক অবস্থার চিকিৎসা একই রকম। এই অবস্থায় হেপাটাইটিস ‘বি’-এর বংশবৃদ্ধি রোধের জন্য বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের চিকিৎসায় প্রথম আবিষ্কার হয় ইন্টারফেরন নামক ইঞ্জেকশন। ভাইরাস মানব লিভারে প্রবেশের পর শারীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম অস্ত্র হিসেবে ইন্টারফেরন নিঃসৃত হয়। ইন্টারফেরন শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ক্রিয়াশীল করার মাধ্যমে ভাইরাসকে বিতারিত করতে চেষ্টা করে। হেপাটাইটিস বি এর চিকিৎসা প্রথম শুরু হয় জিনপ্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্টারফেরন তৈরীর মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ সালের দিকে এটি প্রথম আমেরিকান ফুড এন্ড ড্রাগ এ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক বাজারতাজকরণে স্বীকৃতি পায়। তখন থেকেই এটি বাংলাদেশেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সপ্তাহে তিনটি করে ২৪ সপ্তাহে ৭২টি ইঞ্জেকশন চামড়ার নিচে পুশ করতে হয়। পরবর্তীতে ইন্টারফেরনের গঠনে হালকা পরিবর্তন করে পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন-টু আলফা ও পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন টু বিটা নামক ইন্টারফেরন আবিষ্কার করা হয়। এগুলো শরীরে অধিক সময় ক্রিয়াশীল থাকে। ফলে প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে একটি করে সর্বমোট চব্বিশটি ইঞ্জেকশন পুশ করলেই হয়। বাংলাদেশে প্রথমে শুধুমাত্র বাহির থেকে আমদানীকৃত ইন্টারফেরন পাওয়া যেত। ফলে চিকিৎসার মোট খরচ চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকার মত পড়ে যেত। এখন বাংলাদেশেও কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারফেরন ও পেগিন্টারফেরন তৈরী ও বাজারজাত করছে। ফলে খরচ কমে দুই থেকে আড়াই লক্ষতে নেমে এসেছে। তারপরও এই চিকিৎসা ব্যয় বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে অনুকূল নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’-এর চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ওষুধও আবিষ্কার হয়েছে। এখন পর্যন্ত পাঁচটি ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় এবং এর সবগুলোই  দেশের ভেতরেই প্রস্তুত হচ্ছে। আবিষ্কারের ক্রম অনুসারে ওষুধগুলো হলো-ল্যামিভূডিন, ইনফোভির, এন্টাকাভির, টেলভিভুডিন এবং টেনোফোভির। এগুলো হচ্ছে পলিমারেজ ইনহিবিটর যা হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের ডিএনএ তৈরিতে বাধা দিয়ে বংশবৃদ্ধি রোধ করে। এগুলোর মূল্য ২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে এবং প্রতিদিন একটি করে  সেবন করতে হয়।
কোন রোগী ক্রনিক হেপাটাইটিস বা সিরোসিস অবস্থায় আছে কিনা, তা যাচাই করার জন্য হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের অন্যান্য মার্কারগুলো এবং এএলটি, এএসটি, পিটি ও এইচবিভি ডিএনএ পরিমাপ করে থাকেন। এরপর রোগের মাত্রার উপর নির্ভর করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন। বাংলাদেশের মেডিকেলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-এ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের চিকিৎসায় ‘ইমিউন থেরাপি’ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ঘঅঝঠঅঈ  নামক থেরাপিউটিক ভ্যাক্সিন ব্যবহার করে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের চিকিৎসা গবেষণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ গবেষণায় সাফল্য পাওয়া গেছে। ‘ইমিউন থেরাপী’ শুরু করা গেলে হেপাটাইটিস ‘বি’ চিকিৎসায় আরও সফলতা আসবে এবং খরচও কমে আসবে।
কোন রোগী যদি লিভার বিশেষজ্ঞের কাছে এমন পর্যায়ে আসে যে, তার লিভার হেপাটাইটিস ‘বি’ জনিত সিরোসিসের শেষ পর্যায়ে তথা ডিকমপেনসেটেড সিরোসিস পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সেক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করতে হয়। ডিকমপেনসেটেড সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সার হলে মূল চিকিৎসা হলো লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন তথা লিভার প্রতিস্থাপন করা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত লিভার প্রতিস্থাপন সফলভাবে করা যায়নি। তবে এটিকে সফল ও সহজ্বলভ্য করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের চিকিৎসা : হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের মত হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের কোন সুপ্ত দশা নেই। এটি লিভারে থাকার অর্থই হলো লিভারে দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ তথা ক্রনিক হেপাটাইটিস হচ্ছে। ফলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ রক্তে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের মার্কার অহঃর ঐঈঠ অন  পেলে ‘সি’ ভাইরাসের আরএনএ পরীক্ষা করে দেখেন এবং চিকিৎসা শুরু করেন। শুরুতে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের চিকিৎসায় হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের ন্যায় ইন্টারফেরন এবং রিবাভিরিন নামক এন্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধ ব্যবহারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি এবং খরচও বেশি পড়ে।
২০১৫ সাল থেকে অনেকগুলো নতুন এন্টিভাইরাল ওষুধ বাজারজাত হওয়ার অনুমতি পেয়েছে। যেগুলো মুখে সেবন করা যায় এবং যার সাফল্যের হার প্রায় ৯০ শতাংশ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। এই ওষুধগুলোকে বলা হয় ডাইরেক্ট এক্টিং এন্টিভাইরাল বা ডিএএ। ইতোমধ্যে অনেকগুলো ডাইরেক্ট এক্টিং এন্টিভাইরাল বাজারজাত হয়েছে। যার মধ্যে সফসবুভির, ডাক্লাটাসভির, ভ্যালপাটাসভির এবং লেডিপাসভির ওষুধ চারটি বাংলাদেশেই তৈরী হচ্ছে। ‘সি’ ভাইরাসের চিকিৎসায় ইন্টারফেরন প্রয়োগ করলেও প্রায় ৪৮ সপ্তাহ চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন পড়ত। কিন্তু নতুন সেবনযোগ্য ওষুধগুলো ২৪ সপ্তাহ ব্যবহারেই যথেষ্ট সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের হেপাটাইটিস চিকিৎসাকে এগিয়ে নিতে যাওয়ার লক্ষ্যে বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএসএমএমইউ) ও তৎকালীন আইপিজিএমআর-এ ১৯৮৩ সালে প্রথম হেপাটোলজি বিভাগ খোলা হয়। উক্ত বিভাগ প্রতিবছর লিভার রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরীর পাশাপাশি বাংলাদেশে লিভার রোগের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে।
হেপাটাইটিস প্রতিরোধ : হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর মধ্যে শুধু ‘বি’ ভাইরাসের টিকা পাওয়া যায়। যথাযথ নিয়মে টিকা গ্রহণ করলে ‘বি’ ভাইরাস থেকে পূর্ণ প্রতিরক্ষা পাওয়া সম্ভব। হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো সারা বিশ্বে ৮৪% শিশু হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের ভ্যাক্সিন পাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়াতে এ সংখ্যা ৮৭%। বাংলাদেশে ইপিআই-তে ২০০৩ সাল থেকে হেপাটাইটিস ‘বি’-এর টিকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৯৪ শতাংশ শিশু টিকার সম্পূর্ণ ডোজ পাচ্ছে।
উপসংহার : বিশ্বব্যাপী মানব শরীরের উপর ভাইরাল হেপাটাইটিস-এর ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে ২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সাল নাগাদ ভাইরাল হেপাটাইটিসকে মানব স্বাস্থ্য ঝুঁকি হিসেবে নির্মূলের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রতি বছর ১৩ লক্ষ মানুষ হেপাটাইটিস জনিত কারণে মৃত্যু বরণ করে। যার ০.৮% হেপাটাইটিস ‘এ’ জনিত, ৩.৩% হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস জনিত, ৩০% হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস জনিত এবং ৬৬% হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাজ জনিত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ হেপাটাইটিস জনিত মৃতের সংখ্যা প্রতি বছর ১৩ লক্ষ থেকে কমিয়ে ৫ লক্ষে নিয়ে আসা। অন্যদিকে বিশ্বে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস এবং ‘সি’ ভাইরাস-এ আক্রান্ত রোগীদের যথাক্রমে ৯ শতাংশ এবং ৭ শতাংশ বর্তমানে চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ৮০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
-অধ্যাপক মবিন খান
মির্জা গোলাম হাফিজ রোড, বাড়ি নং-৬৪, রোড নং-৮/এ, ধানমন্ডি, ঢাকা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ