শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

গৃহকর্মী নির্যাতনের কারণ ও প্রতিকার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : [তিন]
পারিশ্রমিক প্রদানের ক্ষেত্রে কোন প্রকার অসাধুতার বিষয়ে ইসলাম সতর্ক করে দিয়েছে। বিচারের দিনে মহানবী স. তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন, যে ব্যক্তি একজন শ্রমিক নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পরিপূর্ণ কাজ আদায় করে কিন্তু তাকে তার মজুরি পরিশোধ করে না। হাদিসে কুদসীতে নবী স. মহান আল্লাহ তাআলা থেকে বর্ণনা করে বলেছেন: তিনজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি নিজেই বাদি হবো। (তাদের  একজন হলো) যে কাউকে মজুর নিয়োগ করে তার থেকে সম্পূর্ণ কাজ আদায় করে নিলো: কিন্তু তাকে মজুরি আদায় করলো না। এ হাদিস থেকে বুঝা গেল, শ্রমিক কিংবা গৃহকর্মীদের উপর যে কেউ কোন প্রকার জুলুম করলে নির্যাতিতের পক্ষ হয়ে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার প্রাপ্য আদায় করে নেবেন। ইবনে তাইমিয়াহ রা. অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, নিয়োগদাতা তার কর্মচারীদের ন্যায্য পারিশ্রমিক প্রদান করতে বাধ্য। যদি মজুরির হার খুব অল্প হয়, তাহলে একজন ব্যক্তি পর্যাপ্ত কাজ করতে উৎসাহী নাও হতে পারে। পক্ষান্তরে, মজুরির হার যদি খুব বেশি হয়, তাহলে নিয়োগকারী মুনাফা অর্জনে সক্ষম নাও হতে পারে  এবং  সে ক্ষেত্রে তার ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী পরিচালিত কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মজুরির পরিমান বা হার কর্মচারী ও নিয়োগদাতা উভয়ের জন্যই ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া আবশ্যক।
রাসূলুল্লাহ স. গৃহে গৃহশ্রমিকরা যেমন ছিলেন : মানবজীবনকে সমস্যামুক্ত করার জন্য এবং শান্তিময় কল্যাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই দয়ামত আল্লাহ বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ স. কে পাঠিয়েছিলেন। রাসূল স. ছিলেন এতিমের বন্ধু, গরিবের বন্ধু ও নির্যাতিত মানুষের সবচেয়ে বড় সহায়। তিনি সকলের সাথে ভালো আচরণ করতেন, কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন না। অধীনস্ত ও গৃহকমীদের অধিকারের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। নবী করিম স. মৃত্যুমুহূর্তে শেষ বাক্য হিসেবে বলে গেছেন: নামাজ নামাজ। অর্থ্যাৎ তোমাদের দাস দাসীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। মহানবী স. বার বার এ কথা বলতে থাকেন। তিনি বাস্তব জীবনে ও এ নীতির অনুসরণ করে গেছেন। আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ স. কখনো কোন বস্তু, নারী এবং কোন গৃহকর্মীকে হাত দিয়ে আঘাত করেননি। হযরত আনাস বিন মালিক রা. রাসূলুল্লাহ স. এর খাদেম ছিলেন। গৃহকর্মীদের সাথে রাসূলুল্লাহ স. এর আচরণ সম্পর্কে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ স. ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের মানুষ। একদিন তিনি আমাকে এক প্রয়োজনে পাঠালেন। তখন আমি বলে ফেললাম, আমি যেতে পারব না। অথচ আমার মনে মনে ছিল নবী স. যে ব্যাপারে আদেশ করেছিলেন আমি তা করবো। (আনাস রা.) আরো বলেন, এরপর আমি বের হয়ে বাজারে খেলাধুলারত কিছু বাচ্চাদের অতিক্রম করছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ স. পেছন দিক থেকে আমার দু’কাঁধ ধরলেন। আমি তার দিকে ফিরে দেখলাম, তিনি হাসছেন। এরপর আমাকে বললেন, হে উনাইস! (স্নেহের সম্বোধন) আমি তোমাকে যেখানে যেতে বলেছি সেখানে গিয়েছিলে? আমি বললাম, হ্যাঁ হে আল্লাহর রাসূল! আমি যাবো, অত:পর আমি গেলাম। আল্লাহর শপথ! আমি দীর্ঘ ছয় বছর কিংবা (কোন বর্ণনা অনুযায়ী) নয় বছর তার খেদমত করেছি। কিন্তু আমার জানা নেই, আমার কোন কাজের ব্যাপারে তিনি বলেছেন কেন কাজটি এভাবে করেছো? অথবা আমি কোন কাজ না করলে তিনি বলেছেন, কেন এই কাজ করোনি? অন্য বর্ণনাতে এসেছে, আমি দশ বছর নবী স. এর সেবা করেছি। তিনি আমাকে (বিরক্ত হয়ে) উহ্ পর্যন্ত বলেনি এবং এটাও বলেননি: কেন এটা করেছ? এবং এটাও বলেননি কেন এটা করোনি? রাসূলুল্লাহ স. গৃহকর্মীদের ব্যাপারে এতটা যত্নশীল ছিলেন যে, তিনি তাদের বিবাহ শাদীর খোঁজ খবর রাখতেন। যেমন, রবীয়া বিন কাব আল-আসলাম রা. থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ স. এর সেবক ছিলাম। একদিন নবী রা. আমাকে বললেন, তুমি বিবাহ করবে না? আমি বললাম, না, হে আল্লাহর রাসূল! আমি বিবাহ করতে চাই না। কারণ একজন নারীর ভরণপোষণের সামর্থ্য আমার নেই এবং এ বিষয়ে আপনাকে ও ব্যস্ত করতে চাই না। অত:পর তিনি আমার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আবার বললেন : তুমি বিবাহ করবে না? আমি বললাম, না, হে আল্লাহর রাসূল! আমি বিবাহ করতে চাই না। কারণ একজন নারীর ভরণপোষণের সামর্থ্য আমর নেই এবং এ বিষয়ে আপনাকেও ব্যস্ত করতে চাই না। অতঃপর তিনি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।এরপর আমি মনে মনে চিন্তা করে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল দুনিয়া আখিরাতে আমার কল্যাণ বিষয়ে আপনি বেশ অবগত। তাই আপনি যা চান কিংবা পছন্দ করেন সে বিষয়ে আমাকে আদেশ করুন। তখন রাসূলুল্লাহ স. বললেন, আনসারদের অমুক এলাকার অমুকের নিকট যাও। রসূলুল্লাহ স. এর এই মমত্ববোধ অমুসলিম গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে ও লক্ষ্য করা যায়। একবার রাসূলুল্লাহ স. এর খাদেম এক ইহুদি বালক ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো। রাসূলুল্লাহ স. তাকে দেখতে গেলেন এবং দেখাশুনা করলেন। বালকটির মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি তার সেবা শুশ্রুষা করলেন এবং তার মাথার পাশে বসে থাকে ইসলাম গ্রহণ করতে আহবান করলেন। বালকটি জিজ্ঞাসার ভংগিতে তার পিতার দিকে তাকালো। তার পিতা তাকে বললো, আবুল কাসিমের (রাসূলুল্লাহ স.) আনুগত্য করো। এরপর সে ঈমান আনলো এবং তার রুহ চলে গেল। অতঃপর রাসূলূল্লাহ স. বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচালেন।
উপরোক্ত কুরআন, হাদীসের বর্ণনা ও সাহাবীগণের বাণী বিশ্লেষণ করলে গৃহশ্রমিকের বিষয়ে ইসলামী নির্দেশনার যে সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় তা হলো: গৃহকর্মী পরিবারে সমতুল্য গণ্য হবে। তাদের সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক থাকবে, মালিক ও ভৃত্যের সম্পর্ক নয়; পরিবারের সদস্যরা যা খাবে, তারা ও তাই খাবে। পরিবারের সদস্যরা যা পরবে তাদেরও সে ধরণের পোশাক দিতে হবে। মাঝে মধ্যেই তাদের নিজেদের সাথে খাবার খেতে ডাকতে হবে; সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ তাদের উপর চাপানো যাবে না। যদি দেয়া হয়, তবে তাকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে ও সক্রিয় সহযোগিতা করতে হবে; সকল মানুষেরই ভুল হতে পারে। গৃহকর্মীদের ভুল হতে পারে। এক্ষেত্রে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাদের প্রতি ইনসাফ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ স. একজন প্রশ্নকারীর জবাবে বলেছেন, প্রয়োজন হলে প্রতিদিন তাদেরকে ক্ষমা করবে; গৃহকর্মীগণ গৃহকর্তার কাছ থেকে উত্তম ও মানবিক আচরণ পাওয়ার অধিকারী; পারিশ্রমিক প্রদানে গড়িমসি করা যাবে না, যথাসম্ভব দ্রুত তা পরিশোধ করতে হবে; ইসলাম শুধুমাত্র গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধ নির্দেশ জারি করেই ক্ষান্ত হয়নি; তাদের প্রতি সদাচারের জন্য উৎসাহ প্রদান করেছে, যা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে অত্যন্ত কার্যকরী; সর্বোপরি আখিরাতের ভয়াবত দিনের কথা হ্রদয়ে স্মরণ রেখে অধীনস্তদের প্রতি ইনসাফ বা সুবিচার করতে হবে।
গৃহশ্রমিকদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ আই এল ও সনদ নং ১৮৯ বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত স্বাক্ষর করেনি। দ্রুত সনদটিতে স্বাক্ষর করা উচিৎ। এতে গৃহকর্মীর অধিকার সংরক্ষণ জাতীয়ভাবে প্রাধান্য পাবে। গৃহকর্র্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা ২০১৫ নামে একটি নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে সরকারের মন্ত্রিসভা। কিন্তু এটি এখনো আইনে পরিণত হয়নি। আইনে পরিণত না হলে সুনির্দিষ্ট আইনী ব্যবস্থা ও নেওয়া যায় না। তাই যত দ্রুত সম্ভব অনুমোদিত নীতিমালাটি আরো পরিমার্জন করে আইনে পরিণত করতে হবে। সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণের মাধমে জনগণের মাঝে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এটি সরকারী বেসরকারী উভয়দিকে থেকেই হতে পারে। বিশেষ করে মসজিদের খতীবগণের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। সরকারী পর্যায়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে কাজে লাগানো যেতে পারে। সচেতনতামূলক কর্মসূচীর অংশ হিসেবে সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা উচিৎ। আইনী আশ্রয় গ্রহণের প্রক্রিয়াকে গৃহকর্মীদের জন্য সহজলভ্য করতে হবে। তাদের জন্য ফ্রি কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গৃহনির্যাতন বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সধ্যে কার্যক্রম নৈতিক ভিত্তি স্থাপন একান্ত প্রয়োজন। আর ইসলামি আইনের চেতনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তা সম্ভব।
ইসলাম প্রতিটি ব্যক্তিকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে মূল্যায়ন করতে শেখায়। দারিদ্র্যের কারণে মানবিক মর্যাদায় কোন পার্থক্য করা যায় না। নিয়োগকর্তারা যদি গৃহকর্মী ও নিজেদেরকে একই রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে সমমর্যাদার অধিকারী মনে করেন এবং গৃহকর্মীদের সেবাটাকে নিজেদের জন্য আশীর্বাদ মনে করেন, তাহলেই অত্যাচার নিপীড়িতদের পরিস্থিতি উদ্ভব হবে না।
তাছাড়া গৃহকর্মীদের উপর ন্যূনতম অবিচার করলে পরকালে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে এই বিশ্বাস নিয়োগদাতাদের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারলে পরকালে গৃহকর্মী নির্যাতন অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। সেই সাথে দরকার নিরবচ্ছিন্ন আইনী প্রতিকারের পরিবেশ। গৃহকর্মীর কোন অপরাধ থাকলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করা উচিত।
পরিশেষে বলতে চাই, সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই লক্ষ লক্ষ গৃহকর্মীদের জন্য বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও সরকারী সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু মানবাধিকার সংরক্ষণে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এ সমস্যার সমাধান সর্বশ্রেষ্ঠ, সন্দেহ নেই। [সমাপ্ত]
-লেখক : মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, বিএ অনার্স, এমএ (ইসলামের ইতিহাস) ও এমএ (ইংরেজী), পাঠানপাড়া (খানবাড়ি), সদর সিলেট-৩১১১। মোবাইলঃ ০১৯৬৩-৬৭১৯১৭

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ