মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বিভাগভিত্তিক ডিপ্লোমা শিক্ষাবোর্ড চাই

খনরঞ্জন রায় : গত ৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে এসএসসির ফলাফল ঘোষণা করা হয়। সকাল ১০টায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে রেওয়াজ অনুযায়ী গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ২০১৭ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলের অনুলিপি তুলে দেন।
এবার পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৯৬২ জন। এর মধ্যে পাস করেছে ১৪ লাখ ৩১ হাজার ৭২২ জন। এবারের গড় পাসের হার ৮০.৩৫ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৮৮.২৯ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার কমেছে ৭.৯৪ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জন, গত বছর যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জন। গত বছরের তুলনায় জিপিএ-৫ কমেছে ৫ হাজার। এবার শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ২৬৬, গত বছর যা ছিল ৪ হাজার ৭৩৪। গত বছরের তুলনায় কমেছে ২ হাজার ৪৬৮। একজনও পাস করেনি এমন প্রতিষ্ঠানও গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ৪০টি। গত বছর ছিল ৫৩টি, এবার হয়েছে ৯৩টি।
গত ১৬ বছরেই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার হু হু করে বাড়ছিল। ২০০১ সালে এসএসসিতে পাসের হার ছিল ৩৫.২২ শতাংশ আর গত বছর সেই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮৮.২৯ শতাংশ। এমনকি ২০১৪ সালে পাসের হার উঠেছিল ৯১.৩৪ শতাংশে। এবার ভর্তিযুদ্ধের পালা। কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ৮৯ শতাংশ আসন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। অবশিষ্ট ১১ শতাংশ আসনের মধ্যে ৩ শতাংশ সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সদরের বাইরের এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য, ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং ২ শতাংশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পদের সদস্যদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এ ছাড়া এবার থেকে প্রবাসীদের সন্তান এবং বিকেএসপির শিক্ষার্থীদের জন্য শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বিজ্ঞান শাখা থেকে উত্তীর্ণরা যে কোনো বিভাগে ভর্তি হতে পারবে। মানবিক শাখা থেকে উত্তীর্ণরা মানবিকের পাশাপাশি ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভর্তি হতে পারবে। ব্যবসায় শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগে ভর্তি হতে পারবে। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সর্বমোট প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতে মেধাক্রম নির্ধারণ করা হবে। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে সমান জিপিএ প্রাপ্তদের মেধাক্রম সাধারণ গণিত, উচ্চতর গণিত অথবা জীববিজ্ঞানে প্রাপ্ত জিপিএ বিবেচনায় আনা হবে। মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে সমান জিপিএ প্রাপ্তদের ভর্তির ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে ইংরেজি, গণিত ও বাংলায় অর্জিত গ্রেড পয়েন্ট বিবেচনা করা হয়েছে।
ভালোমানের কলেজের সংখ্যা কম হওয়ায় মেধাবীরা কাক্সিক্ষত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (ব্যানবেইস) সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর আশ্বস্ত করেছিল, কলেজে ভর্তিতে আসন স্বল্পতা নেই। বরং মাধ্যমিক পাস করা সবার উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হওয়ার পরও প্রায় আট লাখ আসন ফাঁকা পড়ে থাকবে। ঘটনা তাই হলো।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য আর্থ-সামাজিক খাতে দ্রুত পরিবর্তন করে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের ও ২০৪০ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করা।
দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে তুলতে সরকার ডিপ্লোমা শিক্ষায় তরুণদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে চায়। একটি ক্ষুদা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে তুলতে সবার জন্য ডিপ্লোমা শিক্ষা নিশ্চিত করাটা জরুরি। আধুনিক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ডিপ্লোমা শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া কোনো দেশই এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে পারবে না। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও ঘোষণা করেছেন ২০২১ সালের মধ্যে দেশে ডিপ্লোমা শিক্ষায় ভর্তির হার ২০ ভাগ এবং ২০৪১ সালে এ হার ৬৫ ভাগে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে ডিপ্লোমা শিক্ষার হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০৪১ সাল আসতে আর মাত্র ২৪ বছর বাকি। এর মধ্যে আমাদের ডিপ্লোমা শিক্ষা হার ৬৫ শতাংশে উন্নতি করে জনগণের মাথাপিছু আয় ১৫০০ ডলার থেকে ১২ হাজার ডলারে উন্নীত করতে হবে, যদি আমরা একটি উন্নত দেশে পরিণত হতে চাই।
সময়ের সাথ পাল্লা দিয়ে প্রতিদিন জনসংখ্যা বৃদ্দি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে স্কুলগ্রামী শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০৪১ সাল পর্যন্ত যদি বাংলাদেশে প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্ট বড় ধরনের দুর্যোগ না ঘটে, কিংবা জনসংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তবে জনসংখ্যা ৩০ কোটিতে উপনীত হবে। এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণাকারীর সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ লক্ষে উপনীত হবে। শিক্ষামন্ত্রীর আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে ডিপ্লোমা শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ উন্নীত করতে হলে শতকরা হিসাবে ১৯ লক্ষ ৫০ হাজার আসন বিশিষ্ট ডিপ্লোমা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অন্যদিকে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের ২২ লক্ষ আসনকে ১০ লক্ষ ৫০ হাজার আসনে অবসন করতে হবে।
বর্তমান ডিপ্লোমা শিক্ষা ব্যবস্থা ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে একথা নির্দি¦ধায় বলা যায় ৮টি আঞ্চলিক মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের তৎপরতার লাগামে হাত না ছিল কর্মকেন্দ্রিক ডিপ্লোমাকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। এ নিয়ে থমাস ম্যালথাস একটি গবেষণামূলক বই লেখেন। বইটির নাম Essay on the Principles of Populaion. এই লেখার সূত্র ধরে হলেও এইচএসসিতে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ৪৪ লক্ষ আসন বিশিষ্ট উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নানাভাবে বিভিন্ন জীবগোষ্ঠীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে অথবা বিনষ্ট করে। ডারউইন একে বলেছেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন। তিনি যক্তি-প্রমাণ দিয়ে দেখান যে, শক্তিমানরাই কেবল টিকে থাকে, বাকীরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শক্তির ডিপ্লোমা শিক্ষা ব্যবস্থা আরো দুর্বল হবে। শীর্ণকায় হবে আসন সংখ্যা, দিন দিন গাণিতিক হিসাবে কমতে থাকবে।
উচ্চ বিলাসী স্বপ্ন ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশ এবং শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের ২০২১ সালে ডিপ্লোমা শিক্ষার হার ২০ ভাগ এবং ২০৪১ সালে ৬৫ শতাংশ উন্নতির কল্পনা বাস্তবে রূপ দিতে প্রাকৃতিকভাবে মানুষ ও বৃক্ষলতা যেভাবে বাড়ে, সেভাবে ডিপ্লোমা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পট পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রশাসনিক বিভাগ প্রতিষ্ঠার হিড়িক লাগে। স্বাধীন বাংলাদেশ ৪টি বিভাগ থেকে ৮টি বিভাগে উন্নতি ঘটছে। নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং ঢাকা বিভাগকে ঢেলে নতুন আঞ্চলিক বিভাগ প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দেয়া হয়েছে। ৯০ এর দশকে থানার নাম পরিবর্তন করে উপজেলা করা হয়েছে। পৃথিবীর সবদেশে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা অবকাঠামো নির্মাণে, প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণে, জনশাসন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে নিরলস শ্রব দিয়ে যায়। জনগণ ও ডিপ্লোমা পেশাজীবীদের কাছাকাছি থেকে তাদের কাক্সিক্ষত সর্বপ্রকার সহযোগিতার অধিকারী হয়। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই ডিপ্লোমা শিক্ষার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক আমলে গড়া ডিপ্লোমা নিয়ন্ত্রণকারি ৭টি প্রতিষ্ঠান যথা কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, আয়ুর্বেদীয় বোর্ড, হোমিওপ্যাথিক বোর্ড, নার্সিং কাউন্সিল, ফার্মেসি কাউন্সিল, রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ, প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে পরগাছা নীতি চলমান রেখেছে। আমাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা ডিপ্লোমা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সকল বিভাগীয় সদরে ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা আর তা হলেই বোর্ড যেখানে হাই স্কুল আছে তারই পার্শ্বে ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট নির্মাণে প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
ডিপ্লোমা শিক্ষার সমস্যা মহাসমস্যা। পাহাড়সমান এইসব মহাসমস্যা এক দুই বছরে সম্পূর্ণরূপে সমাধান করা সম্ভব- এমন অবৈজ্ঞানিক কথা বলতে চাই না তবে আন্তরিকতার সঙ্গে পূর্ণকালীন কাজ করে গেলে নিশ্চয়ই উঁচু পাহাড় থেকে সমস্যা নামতে নামতে আমাদের গলাসমান হতে পারে। শিক্ষামন্ত্রী গেল কয়েক বছর আন্তরিকভাবে কাজ করতে চেয়েছেন- এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু গোড়ায় গলদ রেখে তো আর সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ডিপ্লোমাকে শিক্ষামন্ত্রীর কল্পনায় আনতে হলে দেশের অন্যান্য প্রশাসনিক অবকাঠামোর মতো ডিপ্লোমা শিক্ষা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ডিপ্লোমার ক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড নীতি অনুসরণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিভাগভিত্তিক স্বাধীন স্বতন্ত্র ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ