শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ভয়াবহ দুর্যোগের কবলে দেশ

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : দুর্যোগ শব্দটার সাথে পৃথিবীর সব দেশই কমবেশী পরিচিত। তবে আমাদের জনগণ যেন এটার সাথে অনেকের থেকে বেশীই পরিচিত। নানা ধরনের দুর্যোগের মধ্যেই যেন আমাদের বসবাস। কখনো রাজনৈতিক দুর্যোগ, কখনো পারিবারিক দুর্যোগ, কখনো প্রতিপক্ষ কর্তৃক দুর্যোগ ইত্যাদি। বছরের প্রায় পুরো সময়টা এদেশের মানুষকে দুর্যোগ মোকাবেলা করেই বাঁচতে হচ্ছে। এককথায় ভয়াবহ দুর্যোগ পাড়ি দিচ্ছে দেশবাসীকে। রাজনীতির দুর্যোগের কথা ছেড়ে দিলেও বলতে হয়, স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্যোগের কবলে দেশ। কিছুদিন আগে একদিনে শতাধিক মানুষ বজ্রপাতে মারা গেছে। মাত্র এক-দুই ঘণ্টায় এমনটি হয়েছে। অতীতে এ রকম রেকর্ড আর নেই। এরপর হয়েছে পাহাড় ধস। এতে অসংখ্য মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটে। এখন চলছে দেশবাসী বন্যা। এগুলো যে কেবল প্রাকৃতিকগতভাবেই হচ্ছে তা কিন্তু নয়। এসবের জন্য মানুষ ও ক্ষমতাসীনরাই দায়ী। পবিত্র কোরআন ঐতিহাসিক সত্যের নিরিখে আ’দ, সা’মুদ জাতির অপরাধ ও শাস্তির কথা উল্লেখ করেছে এবং বলেছে, বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীলদের জন্য এসবের মধ্যে সতর্ক হওয়ার আর উপদেশ নেওয়ার শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। কিন্তু মানুষ শিখে কম-ই। একেবারে শেষ সময়ে যখন শিখতে চায়, তখন আর সুযোগ থাকে না। যা থাকে অবশিষ্ট, তার নাম ‘আফসোস’। বাংলাদেশেও এখন অনেকেই পরিবর্তনের কথা বলছে, ভবিষ্যতের কথা বলছে। অনেক ঘোষনাই আসছেই। তবে এগুলোও যে রাজনৈতিক ও মিথ্যাচার তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
দেশে এখন মানুষের অধিকারের জায়গাটিও এর ফলে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। ঈমানের অধিকার, ভোটের অধিকার, ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার কমছে। চারদিকে যা হচ্ছে, তার নাম স্বাভাবিকতা নয়; অস্বাভাবিকতা। এসব নিয়ে চিন্তাশীলদের অবশ্যই ভাবতে হবে। দেশের কল্যাণের চিন্তা-ভাবনা একক কারো নয়, সকলেই। সবাইকে এসব ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া দরকার। বিশ্বের দেশে দেশে অন্যায়ের মচ্ছব চালাচ্ছে। দুর্যোগ এনে দিচ্ছে। এসবের আশু অবসান হওয়া দরকার। তা-না হলে দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।
অবশ্যই এজন্য কুশাসন, স্বৈরশাসনের অবসান হওয়া দরকার। কিন্তু সেই অবসানটি কেবল ক্ষমতায় একজনের বদলে আরেকজনের আগমন হলেই হবে না। আদর্শিক পরিবর্তন হতে হবে। আদর্শ হিসাবে এখন ইসলামকেই মানবতার ত্রাতা রূপে দায়িত্ব নিতে হবে। ইসলামের কল্যাণময় সুশাসনের রূপায়নেই দুর্যোগ-দুর্ভোগের অবসান সম্ভব। এ কথা বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত হচ্ছে। বিপদ মুক্তির জন্য, দুর্যোগ থেকে উত্তরণের জন্য এ সত্যের বাস্তবায়নই এখন পরিস্থিতির দাবি। দুর্যোগের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাওয়ার আগেই প্রতিকারের জন্য নিয়োজিত হওয়াই কর্তব্য।
ফিরে আসি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে চলমান কথিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রসঙ্গে।  পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা যেন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে ১৫৮ জনের প্রাণহানির শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই কয়েকদিন আগে সীতাকু-ের সলিমপুরে গভীর রাতে পাহাড় ধসে ৫ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে চলতি বর্ষা মওসুমে মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে ১৬৫ জনকে প্রাণ দিতে হল মনুষ্যসৃষ্ট এ সংকটের কারণে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের সর্বগ্রাসী থাবার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে দিনের পর দিন লাশের সারি দীর্ঘ করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। পাহাড় ধসের পেছনে একশ্রেণীর মানুষের অবৈধভাবে পাহাড় ও এর গাছপালা কাটা, দখল ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারই দায়ী। সচেতনতার অভাবে পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন করে দরিদ্র মানুষরা এর খেসারত দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। প্রশ্ন হল, স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় পাহাড় কাটা, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা এবং মানুষের প্রাণহানি রোধে সচেতনতা তৈরিতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে কি? জানা যায়, পাহাড় কাটা বন্ধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ও পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। বাস্তবায়নের মুখ দেখা তো দূরের কথা, এ সংক্রান্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান নয়। কেবল বড় ধরনের দুর্ঘটনার পর মাইকিং, ঢাকঢোল পিটিয়ে কিছু বৈঠক ও সিদ্ধান্ত-সুপারিশ গঠনের মধ্যে সীমাবব্ধ থাকে।  বলার অপেক্ষা রাখে না, এভাবে চলতে থাকলে পাহাড় ধসে প্রাণহানি, পরিবেশ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি স্থায়ীভাবে রোধ করা সম্ভব হবে না।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ের টানা বৃষ্টিতে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। জলাবদ্ধতা কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় কয়েকদিনের সংবাদপত্রগুলোয় প্রকাশিত বিভিন্ন রাস্তার ছবি দেখলে। এগুলো যে প্রকৃতপক্ষে রাস্তা তা বোঝার কোনো উপায় নেই। কারণ বুক সমান পানিতে নিমজ্জিত রাস্তার ওপর রীতিমতো সাম্পান বা নৌকায় চলাচল করতে হয়েছে নাগরিকদের। জলাবদ্ধতা নগরবাসীর জীবনে কতখানি দুর্ভোগ বয়ে আনে তা কারও অজানা নয়। বর্ষা মওসুমে এ পরিস্থিতি যেন অধিকাংশ নগরীতে নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি পুরোপুরি অসহনীয় হয়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকার অবস্থাও ভালো কিছু নয়। টানা বর্ষণে রাজধানীর বহু এলাকায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এ পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিটি সড়কে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অন্যদিকে প্রকট হয়ে ওঠে যানবাহনের অভাব। সব মিলিয়ে টানা বৃষ্টিতে নগরবাসীর দুর্ভোগের সীমা থাকে না। বর্ষায় দেশের দুই প্রধান নগরীর এ অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আজ সমস্বরে বলার সময় এসেছে- এ অবস্থা আর চলতে পারে না। জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতেই হবে। বর্তমানে টানা বৃষ্টির পাশাপাশি উজান থেকে ধেয়ে আসার পানির কারণে দেশের অধিকাংশ জেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যার কারণে পানির নিচে অনেক ঘরবাড়ি পুরো অথবা আংশিকভাবে ডুবে গিয়ে সেগুলো বাস অযোগ্য হয়ে পড়েছে। খাদ্য, খাওয়ার পানির অভাবে অনাহার-অর্ধাহারে মানুষ দিনাতিপাত করছে। এসব এলঅকায় দেখা দিয়েছে মারাত্বক রোগব্যাধি। 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধের ভয়াবহ অভাব শাসনকাজ পরিচালনার অন্যতম প্রধান নেতিবাচক দিক। এমনিতেই স্বাধীন বাংলাদেশে একেবারে প্রথম থেকেই সাধারণ মানুষের জীবন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটের কারণে শোচনীয় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর প্রত্যেক বছরই কোনো না কোনো ধরণের দুর্যোগ এই সাধারণ শোচনীয় অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে। এসব দুর্যোগের মধ্যে বন্যা, পাহাড় ধস, ঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসই প্রধান। এখনও পর্যন্ত এখানে কোনো বড় আকারের ভূমিকম্প না হলেও ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েই গেছে।
দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে যেটুকু দেখা যায় তার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, এসব  মোকাবেলার বিন্দুমাত্র কোনো ব্যবস্থাই এদেশে নেই। কোনো মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হলে তাতে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা এক রীতিমতো আতঙ্কের ব্যাপার। কারণ তার থেকে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই।
একটি বিল্ডিংয়ে আগুন লাগলে, অথবা একটি বিল্ডিং কোনো কারণে ধসে পড়লে যেখানে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব হয় না, কখনও কখনও শত শত লোক আটকা পড়ে মৃত্যুবরণ করে, সেখানে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত শত শত বিল্ডিংয়ে কোনো কার্যকর সাহায্য যে সরকারের দ্বারা অসম্ভব এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। রাজধানী ঢাকা শহরেই হাজার হাজার বিল্ডিং বিধ্বস্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষ নিহত হবে। যে লাখ লাখ মানুষ আহত হবে তাদের কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে না। স্বাস্থ্য, খাওয়ার পানির সংকট ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে আরও অনেক লোককে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে।
দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সরকারের একটি মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু এটা আছে এজন্য যে, বাংলাদেশের মতো নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটতে থাকা একটি দেশে এ রকম একটা মন্ত্রণালয় নামমাত্র হলেও থাকা দরকার। এর জন্য মন্ত্রীও আছেন। কিন্তু এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কী ধরনের দায়িত্বশীল লোকের ওপর দেয়া দরকার সে বিষয়ে খেয়াল রাখার কোনো ব্যাপার নেই। যেহেতু এ মন্ত্রণালয়ের কোনো গুরুত্ব সরকারের কাছে নেই, সে কারণে এর দায়িত্ব কার ওপর অর্পণ করা যায় এ চিন্তাভাবনার কোনো প্রয়োজনও তাদের নেই। দুর্যোগ দেখা দিলে এ মন্ত্রণালয় কীভাবে তার দায়িত্ব পালন করছে তার তদারকির কোনো প্রয়োজনবোধও কারও নেই। বাংলাদেশে অনেক ধরনের দুর্যোগ নিয়মিতভাবে হলেও তার মধ্যে বন্যা ও ঝড় হচ্ছে সর্বপ্রধান। এই দুর্যোগের সময় দুর্গত গরিব মানুষকে দুর্দশা থেকে রক্ষার জন্য জাতীয় পরিকল্পনার প্রয়োজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ ধরনের পরিকল্পনা ও তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা একটি জনদরদী সরকার ছাড়া যথাযথভাবে সম্ভব নয়।
ই- মেইল: [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ