বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

গৃহকর্মী নির্যাতনের কারণ ও প্রতিকার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : বাংলাদেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের একটি কারণ হলো দারিদ্র্য। ৫৬,৯৭৭ বর্গমাইলের এই ছোট্র দেশে ১৬ কোটি লোকের বসবাস। এর মধ্যে বাসস্থানহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১.৫ কোটি। অনেকে পাচ্ছে না তিন বেলা দুমুঠো ভাত। রাতদিন অবস্থান করছে ফুটপাত কিংবা রেলস্টেশনে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, অভাব-অনটন ও ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়ে বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী বা অন্যের অধীনে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। আর এই দুর্বলদের উপর নির্যাতন করতে যালেম গৃহকর্তারা ভয় পায় না।
শিশুশ্রম এক প্রকার বাধ্য শ্রম। এটা এক প্রকার চাপিয়ে দেয়া দাসত্ব। আইএলওর রির্পোট অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বে বর্তমানে ৫-১৭ বছর বয়সী ১৬৮ মিলিয়ন শিশু শ্রমের সাথে সর্ম্পকযুক্ত। এর মধ্যে ৮৫ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সাথে জড়িত। আইএলওর ২০০৬ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫-১৭ বছর বয়সী ৭.৪ মিলিয়ন শিশু বিভিন্ন প্রকার দৈহিক শ্রমের সাথে জড়িত। ইউনিসেফ কর্তৃক প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গৃহকর্মে নিয়োজিত ৪৫ শতাংশে শিশুকে তাদের শ্রমের যথাযথ মূল্য পরিশোধ করা হয় না। খুব অল্প পারিশ্রমিকে এই শিশুদেরকে জোর করে কাজে খাটানো হয়। এসব অবলা অসহায় শিশুদের নির্যাতন করতে গৃহকর্তরা কোন পরোয়া করে না।
নির্যাতনের আরেকটি কারণ হলো কাজের লোক বা গৃহকর্মীদের দাস-দাসী মনে করা। প্রকৃত অর্থে দাস-দাসী মনে করা না হলেও কাজেকর্মে, আচর-আচরণে, দুর্ব্যবহারে, খানাপিনার ক্ষেত্রে দাস-দাসীর মতোই আচরণ করা হয়। এসব নির্মম ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো কর্তৃত্ব ও প্রভুত্বমূলক আচরণের হিংস্র প্রয়োগ। কর্তা-কর্ত্রীর শক্তি ও ক্ষমতার দম্ভ সক্রিয় থাকে বেশি এবং তাদের স্বভাব-চরিত্রের পাশবিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে চরমভাবে। আর গৃহকর্মীদের দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও অক্ষমতা নির্যাতনের পথকে সহজ করে দেয়। সে কারণে তাদের প্রতি সীমাহীন জুলুম অত্যাচার বা অত্যন্ত লঘু অপরাধে গুরুদন্ড দানের ঘটনা খুব সহজেই ঘটতে থাকে। সাধারণ চড় থাপ্পড় বা হঠাৎ রাগের বশবর্তী হয়ে করা কোনো আচরণের পর্যায়ে না থেকে অত্যাচারটা চলে হিংস্র কায়দায়। কাজের লোক বা গৃহকর্মীদের থেকে কাজ আদায় করে নেয়ার জন্য তাদের উপর চাপ, গালি গালাজ, মানসিক আঘাত, এমনকি চড় থাপ্পড় ও মারধর পর্যন্ত করা হয়, আর এটাকে কাজের লোকদের থেকে কর্মোদ্ধার ও কর্তৃত্ব বাজায় রাখার কৌশল মনে করা হয়, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে এমন জর্ঘন্য বর্বরতা পর্যায়ে নিয়ে যায়।
শক্তিশালী প্রতিকার ব্যবস্থার অনুপস্থিতি একটি বড় কারণ। গৃহের অভ্যন্তরে চালানো এসব খুন নির্যাতনের ঘটনার জন্য কোনো ধরণের জবাবদিহিতার যেমন প্রশ্ন ওঠে না, তেমনি তাদের মনেও কোন ধরনের অপরাধবোধ জাগ্রত হয় না। আর যেসব ঘটনা মিডিয়া ও প্রশাসনের নজরে আসে সেগুলো ও প্রভাবশালীদের প্রভাব ও ক্ষমতা বলে চাপা পড়ে যায়। বিচার ও শাস্তি উভয় থেকে নিশ্চিন্ত নিরাপদ থাকে। ফলে এমন হিংস্র ও বর্বর খুন নির্যাতন ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। আর দেশ, সমাজ ও মানবজাতির সম্মুখে নতুন জাহেলিয়াত,ধ্বংস ও বিপর্যয়ের ছাড়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সবকিছু আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। গৃহাভ্যন্তরে ঘটতে থাকে পারিবারিক, সামাজিক নানান ইস্যূকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে নৈতিক মূল্যবোধের বিকল্প নেই। নৈতিকতার যথাযথ প্রয়োগের অভাবেই সামাজিক এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পথ প্রসারিত হয়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক তমুদ্দনিক সকল পর্যায়ে শিষ্টাচারমূলক মার্জিত আচরণ সবার কাম্য। মানবজীবনের প্রতিটি বাঁকে, অজস্র বাধা-বিপত্তির মোকাবেলায় নৈতিক শক্তির বিকল্প অন্য কিছু  আজও উদ্ভাবন করা যায়নি। মানুষের প্রতিটি আচার ব্যবহার, চাল চলন তার ভেতরকার মনুষরূপের প্রতিচ্ছবিকে প্রকাশ করে। স্বল্প পরিসরে মনে হলেও নৈতিকতার ব্যাপক প্রভাব মানবজাতির পুরো জীবনসমুদ্রে তরঙ্গাকৃতিতে বহমান। গৃহকর্মী ও গৃহকর্তার মাঝে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও মানবিক সর্ম্পক বজায় না থাকার পেছনে উভয়ের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব একটি বড় কারণ। গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে আর্ন্তজাতিকভাবে বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠা ও নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নরুপ:
কর্মস্থানের খারাপ পরিভেশ, শ্রমিকদের শোষণ, অশোভন আরচরণ ও মানবাধিকার লংঘনসহ গৃহকর্মীদের নানাবিধ সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগাইজেশন আইএলও গৃহকর্মীদের অধিকার সুরক্ষা, কর্মস্থান ও জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আইএলও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গৃহকর্মীদের স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন দেশের সরকার, এ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের সামর্থ্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, শ্রমিক সংঘটনগুলোকে আর্থিক, নৈতিক ও আইনী সাহায্য প্রদান করে। তাছাড়া Domestic worker convention 2011. এ গৃহীত সনদ নং ১৮৯ এবং পরামর্শ ২০১ বাস্তবায়নে আইএলও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। নসদ নং ১৮৯ গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় একটি যুগান্তকারী আর্ন্তজাতিক পদক্ষেপ। এতে গৃহকর্মীদেরকে অন্যান্য শ্রমিকের মতোই বিবেচনায় আবহান জানানো হয়েছে। এই কনভেনশনে নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহে গৃহকর্মীদের ন্যূনতম স্বার্থ রক্ষার অংগীকার করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে: মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন, কাজ করার মৌলিক অধিকার, নিয়োগ দেয়ার পদ্ধতি ও শর্ত, কর্মঘন্টা, পারিশ্রমিক, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, বেসরকারী নিয়োগ এজেন্সি, বিরোধ নিষ্পত্তি, অভিযোগ ও জরবদস্তি। সনদ নং ১৮৯ অনুযায়ী গৃহকর্মীদের সাথেও এখন থেকে লিখিত চুক্তি করতে হবে। এছাড়া তাদের অন্তত একদিন সাপ্তাহিক ছুটির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এবং বার্ষিক ছুটি ও অন্যান্য ছুটির দিনগুলোতে কোনভাবেই গৃহকর্মীদের কাজে বাধ্য করা যাবে না। নতুন সনদ নং ১৮৯ ও পরামর্শ নং ২০১, পূর্ববর্তী আইএলও সনদ নং ১৩৮ এবং ১৮২ এর আলোকে গৃহীত হলে ও এটি পূর্ববর্তী সনদ ২টির (১৩৮ ও ১৮২০ জন্য সম্পূরক। আইএলও সনদ নং ১৩৮ (ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত)- এর মাধ্যমে মূলত শিশুশ্রমকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে ও সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কোনো শিশু যেন ন্যূনতম যেন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করার পূর্বে শ্রমে নিযুক্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে এবং এ সনদে কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স ১৫ বছর নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যদিও প্রয়োজনে ও ব্যতিক্রম হিসেবে এ বয়স ১২ বছর ও হতে পারে। অন্যদিকে আইএলও সনদ নং ১৮২-তে নিকৃষ্ট ধরনের শিশুশ্রম নিরসন সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে। এই সনদ অনুসারে, পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ, পর্ণোগ্রফির মতো কাজে শিশুকে ব্যবহার দাসত্বসদৃশ শ্রম যেমন শিশু পাচার ও বিক্রয়, ঋণদাসত্ব ইত্যাদি কাজ নিকৃষ্ট ধরনের কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ সনদের উদ্দেশ্যে শিশু শব্দটি ১৮ বছরের কম সকল ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হবে। স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রসমূহ এসব সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করবে  ও তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা কীভাবে তৈরি করবে সে সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা পরার্মশ ২০১-তে দেয়া হয়েছে। গৃহ শ্রমিকদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ আইএলও সনদ নং ১৩৮ ও সনদ নং ১৮৯ এ বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত  স্বাক্ষর  করেনি।  যদি  ও  বাংলাদেশ  জাতিসংঘ  গৃহীত  United  Nations Convention on the Rights of the child (UNCRC) এবং আইএলও গৃহীত কনভেনশন নং ১৮২ (নিকৃষ্ট ধরনের শিশুশ্রম সম্পর্কিত) সহ  শ্রমবিষয়ক  প্রায় ৩৩ টি   আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে।
জাতিসংঘ গৃহীত Universal Declaration of Human Rights বা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার অনুচ্ছেদ ১ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিক জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে ধর্ম, গোত্র, গাত্রবর্ণ, জেন্ডার, ভাষা, রাজনৈতিক বা ভিন্নমত, জাতীয় অথবা সামাজিক উৎস (Origin), সম্পদ, জন্ম বা অন্যান স্ট্যাটাস নিরপেক্ষভাবে সমান। অনুচ্ছেদ ১২ অনুযায়ী কোন ব্যক্তির পরিবার, গৃহ ও পত্র যোগযোগ এ সকল ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতামূলক হস্তক্ষেপ বা বিঘ্ন সৃষ্টি করা  এবং তার সম্মান ও মর্যাদায় আঘাত করা যাবে না। অনুচ্ছেদ ২৩, ২৪ ও ২৫ এ সকল শ্রমিকের সমান কাজে জন্য সমান মজুরি নীতির ভিত্তিতে ন্যায়সঙ্গত মজুরির বিনিময়ে স্বাধীনভাবে কর্ম নির্বাচন, নির্ধারিত কর্মঘন্টা, সাময়িক ছুটিসহ বিশ্রাম ও বিনোদন, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাস, পরিবারসহ মানবিক মর্যাদার সাথে জীবনযাপন এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কর্মক্ষম প্রতিটি নাগরিকের জন্য কর্মের অধিকার হচ্ছে তার অধিকার, কর্তব্য এবং মর্যাদার বিষয় এবং শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধের মূলনীতি হল শ্রমিকের সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মসম্পাদন এবং সম্পাদিত কাজ অনুযায়ী শ্রমের মুল্য পরিশোধ। অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয়লাভে সমঅধিকারী। অনুচ্ছেদ ৩৪ এ সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম (Forced Labour) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে এসব মূলনীতির আলোকে গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে একটি নীতিমালা ছাড়া সুনির্দিষ্ট ও পরিপূর্ণ কোন আইনী কাঠামো পরিলক্ষিত হয়নি। অবশ্য কোন কোন আইনের বিচ্ছিন্ন কিছু ধারা রয়েছে। এ পর্যায়ে গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশে প্রচলিত আইন ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুটা ইংঙ্গিত দেওয়া হলো: গৃহকর্মী নির্যাতনের প্রায় প্রতিটি ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪ (খ) ধারায় মামলা হয়। কিন্তু এ আইনটিতে আসামিদের সাজা দেয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। এ আইনে কেবল দাহ্য পদার্থ দ্বারা পুড়ে গেলে সাজার সুযোগ আছে। কিন্তু বেত্রাঘাত, গরম খুন্তি, লোহা, ইস্ত্রির ছ্যাঁকা গরম পানি ঢেলে দেয়া এ আইনে অন্তর্ভুক্ত হয় না। তাই গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় দন্ড বিধির (২৩, ২৪, ২৫, ২৬) ধারায় মামলা করলে কিছুটা সুফল পাওয়া যায়।
গৃহভৃত্য নিবন্ধন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ তে বলা হয়েছে, ভৃত্য বা গৃহকর্মী নিয়োগের ১৫ দিনের মধ্যে নিকটস্থ থানায় এর নিবন্ধন করাতে হবে। এতে নারী ও শিশু পাচার রোধে মজবুত বিধান রাখান হয়েছিল। কিন্তু এ আইনটি বাস্তবে কার্যকর করা হয়না। তবে এ বিষয়ে The Prevention and Suppression of Human Trafficking Act. (Act. 3 of 12) নামে নতুন আইন করা হয়েছে। গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা নামে একটি নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে সরকারের মন্ত্রিসভা। এর ফলে গৃহকর্ম শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এবং সবেতনে চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছাড়া ও অন্যান্য ছুটি ভোগ করতে পারবেন গৃহকর্মীরা। এই নীতিমালা অনুমোদন পাওয়ায় শ্রম আইন অনুযায়ী গৃহকমীরা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবেন। নীতিমালায় গৃহকর্মীদের বিশ্রামের পাশাপাশি বিনোদনের সময় দেয়ার ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গৃহকর্মীদের শ্রমঘন্টা এবং বেতন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পক্ষ ঠিক করবে। শ্রমঘন্টা, বিশ্রাম ও বিনোদন সম্পর্কে নীতিমালার অনুচ্ছেদ ৭.৪ এ বলা হয়েছে: প্রত্যেক গৃহকর্মীর কর্মঘন্টা এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে, যাতে তিনি পর্যাপ্ত ঘুম, বিশ্রাম, চিত্তবিনোদন ও প্রয়োজনীয় ছুটির সুযোগ পান। গৃহকর্মীর ঘুম ও বিশ্রামের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্থান নিশ্চিত করতে হবে। গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর অনুমতি নিয়ে গৃহকর্মী সবেতনে ছুটি ভোগ করতে পারবেন।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে গৃহকর্মীর মজুরি নির্ধারিত হবে। পূর্ণকালীন গৃহকর্মীর মজুরি যাতে তার পরিবারসহ সামাজিক  মর্যাদার সঙ্গে জীবন যাপনের উপযোগী হয় নিয়োগকারীকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে গৃহকর্মীর ভরণ পোষন, পোশাক পরিচ্ছেদ, দেয়া হলে তা মজুরির অতিরিক্ত বলে গণ্য হবে। তবে ১২ বছর বয়সের কাউকে গৃহকর্মী রাখতে হলে তার আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে তৃতীয় কোনো  পক্ষের উপস্থিতিতে নিয়োগকারীকে আলোচনা করতে হবে। তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে এই আলোচনা, চুক্তি, সমঝোতা বা ঐক্যমতের সময় নিয়োগের ধরন, তারিখ, মজুরি, বিশ্রামের সময়ও ছুটি, কাজের ধরন, থাকা খাওয়া, পোশাক, পরিচ্ছেদ এবং গৃহকর্মীর বাধ্যবাধকতা এসব বিষয়ের উল্লেখ রাখতে বলা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, অসুস্থ অবস্থায় কোনো গৃহকর্মীকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। নিয়োগকারীকেই নিজের অর্থে গৃহকর্মীর চিকিৎসা করাতে হবে। এছাড়া গৃহকর্মীকে তার নিজের ধর্ম পালনের সুযোগ দিতে হবে। কর্মরত অবস্থায় কোনো গৃহকর্মী দুর্ঘটনার শিকার হলে চিকিৎসাসহ ক্ষয় ক্ষতির ধরন অনুযায়ী নিয়োগতকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
গৃহকর্মীর সঙ্গে অশালীন আচরন, দৈহিক বা মানসকি নির্যাতন করা যাবে না উল্লেখ করে নীতিমালায় ৭.১০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: কোন ক্রমেই গৃহকর্মীর প্রতি কোনো প্রকার অশালীন আচরণ অথবা দৈহিক আঘাত অথবা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। গৃহকর্মীর  উপর কোনো রকম হয়রানি ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে সুবিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রচলিত আইন অনুযায়ী সরকারের উপর বর্তাবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যান মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ও সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী প্রদান করবে। নিয়োগকারী, তার পরিবারের সদস্য  বা আগত অতিথিদের দ্বারা কোন গৃহকর্মী কোনো প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন যেমন- অশ্লীল আচরণ, যৌন হয়রানি বা নির্যাতন কিংবা শারীরিক আঘাত অথবা ভীতি প্রদর্শনের শিকার হলে দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। গৃহকর্মী নির্যাতন বা হয়রানির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানা যেন দ্রুত ওকার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করে, সে জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাপ্তরিক নির্দেশনা জারি করবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় গৃহকর্মীর প্রতি নির্যাতনের প্রতিকারে প্রয়োজনে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার মাধ্যমে হয়রানি ও যৌন নির্যাতন কিংবা শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের মামলা সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত হবে। যৌন হয়রানি বা  যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্টের বিভাগের নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে। গৃহকর্মী তার কর্মরত পরিবারের সদস্য বিশেষ করে শিশু, অসুস্থ ও বৃদ্ধ বা অন্য কোন সদস্যের প্রতি কোনরুপ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বা পীড়াদায়ক আচরণ করতে পারবে না। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে নিযোগকারী তার নিয়োগ বাতিল করতে পারবে এবং তার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। নিয়োগকারী পূর্ণকালীন গৃহকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ছবিসহ সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে পারবেন। নীতিতে যাই থাকুক না কেন গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় ফৌজদারী মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে কোন বাধা কিংবা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে না। কাউকে না জানিয়ে গৃহকর্মী চলে গেলে নিয়োগকারী সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করতে পারবেন। তবে অর্থ বা মালামাল নিয়ে গৃহকর্মী পালিয়ে গেলে সেক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন নিয়োগকারী। নিয়োগকারী পূর্ণকালীন গৃহকর্মী নিয়োগ দিয়ে তার ছবিসহ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে হলে এক মাস আগে জানাতে হবে। গৃহকর্মী ও যদি চাকরি ছেড়ে চলে চান; তবে নিয়োগকারীকে তা এক মাস আগে জানাতে হবে। তবে তাৎক্ষণিকভবে কেউ গৃহকর্মীকে চাকরি থেকে বাদ দিলে এক মাসে মজুরি দিয়ে বিদায় দিতে হবে। এই নীতিমালা বাস্তবায়নে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি তদারকি সেল থাকবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ