শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

কবি তমসুর হোসেনের ‘ভাঙ্গা বুকে রাঙা হাসি’ সমাজের নিটোল ছবি

আবদুল হালীম খাঁ  : বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প এখন আর পিছিয়ে নেই। কবিতা, ছড়া, উপন্যাসের সাথে পাল্লা দিয়ে সাহিত্যের এ শাখাটি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সমাজের সকল স্তরের মানুষের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা বিরহ শোক নিখুঁতভাবে গল্পকাররা ছেঁকে তুলেছেন তাদের গল্পের নানা চরিত্রের মাধ্যমে। তমসুর হোসেনের গল্পগ্রন্থ ‘ভাঙা বুকে রাঙা হাসি’ পড়ে তাই মনে হচ্ছে। তমসুর হোসেন একদিকে খ্যাতিমান কবি। নেশা সাহিত্যে। পেশায় চিকিৎসক। তিনি রোগীদের শরীরের যেমন খবর রাখেন, তেমনি সমাজশরীরের ত্রুটিবিচ্যুতি ও অসংগতিগুলোরও খবর রাখেন। সদ্য প্রকাশিত তার গল্পগ্রন্থের দশটি গল্পে তিনি সমাজজীবনের দশটি দিক সার্চলাইটের আলো ফেলে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তার শিল্পীত হাতে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। এ এক অপরুপ ছবি। ধনী গরীব, কৃষক কৃষাণী, ফকির ফকিন্নি, দুর্ভিক্ষে ক্ষুধার্ত, খরায় পোড়া, নদীভাঙা ভাসমান গৃহহীন বেকার দিনমজুরের কষ্টের জীবন তমসুর হোসেন হৃদয়ের অসীম দরদ ঢেলে তুলে ধরেছেন তার গল্পে। ধর্মের নামে অধর্ম, ভন্ডামী, চালাকী, অন্ধবিশ^াসের সঙ্গে মানবিক প্রেম ভালবাসা, দুঃখ কষ্টে ভাঙ্গাবুকে হাসি আশা স্বপ্নও রয়েছে গল্পগুলোতে। তমসুর হোসেন কবিতা, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ, কিশোরগল্প, আলোচনা সমালোচনা নানাবিধ বিষয়ে লিখলেও, তিনি মূলতঃ কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। তার কাব্যগ্রন্থ ‘অনাবাদী মাঠে প্রেম’, ‘চন্দ্রালোকের গন্ধে ভেজা’,‘মনের শূন্যমাঠে দাঁড়ায় সে এলোচুলে’,‘অগোচরে অনুভবে’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘দুঃখনদীর শতবাঁক’, ‘পড়ন্ত বিকেলের রোদ’, হৃদয়ে নক্ষত্র জ¦লে’ পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে। ‘বিশ^নবীর প্রতিচ্ছবি’ তার গবেষণামূলক অতি মূল্যবান একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। আর কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘রক্তাক্ত পালক’, ‘হারিয়ে যাওয়ার আনন্দ’ এবং ‘পরির দেশে রাজকুমার’ ছোটদের আনন্দের সামগ্রী বলে আদৃত হয়েছে।

সাহিত্য রচিত হয় সমাজের মানুষের প্রতি লক্ষ্য করে। তাদের কল্যাণ সাধনই তার মূল উদ্দেশ্য। লেখক যে পরিবেশে এবং যেসব মানুষের মধ্যে বসবাস করেন সে পরিবেশ তার ওপর খানিকটা প্রভাব ফেলে। তারা লেখকদের গল্পকবিতা, উপন্যাসে সরাসরি ওঠে আসে। কবি তমসুর হোসেন জন্মগ্রহন করেন কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার রেলবাজার গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার পিতার নাম মো. ছকিরউদ্দীন ও মাতার নাম মোছা. তমিরন নেছা। ছাত্রজীবন থেকে তার লেখালেখি শুরু। তমসুর হোসেন সেইসব কবিদের অন্তর্ভুক্ত, যারা সুন্দর সমাজ গড়ার উদ্দেশ্যে কলমকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহন করেছেন। কবিতায় তিনি যেমন সুচিন্তিত শব্দকুশলী তেমনি ছোট গল্পেও এক সংবেদনশীল দুঃখ ভারাক্রান্ত মানব প্রেমিক। তার শিশুতোষ গল্প শিশুর স্বপ্নীল ভুবনের বাস্তব রঙটিকে জীবন্ত করে তোলে। একজন সত্যিকার বিশ^াসী কবি হিসেবে তমসুর হোসেন নিজ ধর্ম এবং আদর্শের প্রতি সমভাবে কৃতজ্ঞতার পরিচয় তুলে ধরেছেন তার রচনায়। তার রচিত গ্রন্থগুলো সহজপাঠ্য, রুচিকর এবং হৃদয়গ্রাহী।

গল্প এক মহৎ শিল্পকর্ম। বাস্তবজীবনকে ভাষায় রূপ দিয়ে মূর্ত করে তোলা জীবন শিল্পীর কাজ। চলমান জীবনের শিল্পীত রুপই হয়ে ওঠে স্বার্থক ছোট গল্প। তমসুর হোসেন কাব্যচর্চার সাথে গল্প রচনার কৌশলও আয়ত্ত করেছেন এবং ইতোপূর্বে প্রকাশিত গল্পগুলোতে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘ভাঙ্গা বুকে রাঙা হাসি’ তার চতুর্থ গল্পগ্রন্থ। এর গল্পগুলোতে সমাজের নানা চরিত্রের মানুষের ত্রুটি অসংগতিগুলো নিটোল ছবির মতো ফুটিয়ে তুলেছেন। অশিক্ষিত মানুষের মানুষের মুখের ভাষা তুলে দিয়ে তাদের প্রতি মর্যাদা ও ভালবাসা প্রদর্শন করেছেন। ‘ভাঙ্গা বুকে রাঙা হাসি’ গল্পে নদী ভাঙ্গা ঘরবাড়ি জমিজিরাত হারা ভাসমান মানুষের দুঃখ-দুর্দশার করুণ চিত্র ফুটে ওঠেছে এমনকি মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন উপায়? তারা যে কত বিপদগ্রস্ত ও উপায়হীন তা লেখকের কয়েকটি বাক্যে ব্যক্ত হয়েছে এভাবে: ছেলেকে ডেকে নিয়ে বার বার মা বলেন, ‘মোর পাচত ট্যাকা খরচ করি কোন নাভ হবার নয়। মুই তো বেশি দিন বাইচপার নঙ। মোক তুই কোনটে আনলু বাবা। মইল্লে মোক কোনটে মাটি দিবু? তার বদল মোর বাড়ি নিয়া যা। জিউকোনা গেইলে নাওয়ান করি নদীত ভাসে দেইস।’ (পৃ-২৮)

‘অন্তিম শয়নে অনাথিনী’ গল্পে দিনমজুর করিম ও শরবানুর কষ্টের সংসারের চালচিত্র তমসুর হোসেন এঁকেছেন এভাবে ঃ ‘দু’কেজি খসখসে আটা নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে করিম। শীতে তার দেহ কাঁপছে। খড়ে আগুন দিয়ে শরীর গরম করে সে। স্ত্রীকে ডাক দিয়ে বলে: ‘ও শরবানু খিদায় প্যাট জ¦লে। পোলারে কোলে দাও দেহি।’ করিমের গলা শুনে উঠে বসার চেষ্টা করে শরবানু। কিন্তু তার বুক ধুকধুক করে কেঁপে ওঠে। চোখে অন্ধকার নেমে আসে। করিম তার অসুবিধা বুঝতে পারেনা, কথায় সে খেঁচে ঃ ‘আরাম হয়নি হারামজাদীর। বাপের বাইত্তে জমিদারী। মনডায় কয় লাথি মারি পাছার মদ্দি।’ ---করিম কোনকিছু না ভেবে লাথি মারে শরবানুর পেটে। (পৃ-১৪,১৫)

 

‘হাড়কিপটের জামাই খাতির’ একটি মজার গল্প। জামাইর অবস্থা করুণ। সমাজে কত রকম স্বভাবের মানুষ আছে। তমসুর হোসেন সে সবের খবর রাখেন। জামাইকে সকল শ^শুরই আদর করে খাওয়ায় এবং খাইয়ে আনন্দ পায়। কিন্তু হাড়কিপটে শ^শুড় সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। জামাই অনেক আশা করে একটা বড় চিতল মাছ নিয়ে শ^শুর বাড়ি এসেছে। অথচ গভীর রাতে জামাইকে তাড়িয়ে দিয়ে বলে কিনা ঃ আহা বেচারা! শাক দিয়ে চিতল মাছ খাওয়ার কী আশাটাই না করেছিলো। আমার বাড়িতে বসে পা নাচিয়ে পেট তাজা করে খাবি। আমি বেঁচে থাকতে তা করতে দেবোনা। আমি হলাম আকাল মামুদের বেটা নাকাল মামুদ। বুড়োর কথা শুনে বউয়েরা খুশিতে আটখানা হয়ে কোচাভরে নাটাশাক তুলে আনলো জঙ্গল থেকে--। (পৃ-৭১)

কী অপরুপ আমাদের সমাজের কিছু মানুষের স্বভাব চরিত্র!

‘শুক্কুর আলীর হালচাল’ গল্পে শুক্কুর আলী একজন দরজী তার স্ত্রী স্বপ্না, শাশুড়ি ও শ^শুর আমাদের অতি কাছের মানুষ। কিন্তু তাদের ভেতরের সমস্যার খবর আমরা অনেকেই জানিনা। গল্পকার তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে সবই দেখেছেন এবং আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছেন। স্বপ্নার মা নিজমুখে তার মেয়ের স্বভাব চরিত্রের কথা বলছেন ঃ‘ এই খান্নাসি মেয়েটাকে বড় করে তুলতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। সে কারনে তারও খুশির দিকটা অবহেলা করার মত নয়। স্বামীর কাছে তা প্রকাশ না করলেও বিচিকলা দাঁত বের করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসে সে। আর জর্দার কৌটা থেকে সুগন্ধি জর্দা নিয়ে যশোরের পরিপুষ্ট পানের সাথে মুখে পুরে দেয়।’ (পৃ-৬৬)

‘নালায়েক’ তমসুর হোসেনের একটি অসাধারণ গল্প। যে পেশার ও নেশার মানুষের স্বভাব যেমন হয়ে থাকে লেখক সেটির বাস্তব রুপ দিয়েছেন। গল্পের নায়ক দু’জন। বজলু ও হুজুর। পূর্বে চেইন স্মোকার ছিল বজলু। সে খারাপ অভ্যেস বাদ দিয়ে ধর্মকর্মের দিকে মন দিচ্ছে। সে খাজাবাবার বাৎসরিক ওরসে পার্বতীপুর হয়ে কুষ্টিয়া যাচ্ছে ট্রেনে। এক ষ্টেশনে জবরদস্ত আলেম প্রকৃতির হুজুরের আবির্ভাব। মাথায় ধবধবে সাদা পাগড়ী। লম্বা আলখেল্লার ওপর এলাহাবাদী কোর্তা। সঙ্গে ব্রিফকেস। তমসুর হোসেন হুজুরের আচরণ নিখুঁতভাবে অঙ্কন করেছেন এভাবে ঃ ‘পান মুখে দেয়ার পর তিনি কোনদিকে খেয়াল না করে ট্রেনের জানালা দিয়ে প্রথম যে পিক ফেললেন তার ছিটা পরে বজলুর জামাকাপড়ের কি দশা হলো তা মোটেই লক্ষ্য করলেন না। এরপর হাতের তালুতে রাখা বাড়তি জর্দা একটু একটু করে মুখগহ্বরে ছিটাতে লাগলেন এবং দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিশেষ কায়দায় পিকের ছিটা বাতাসে উড়াতে লাগলেন। বজলুর আরামের ছিটখানা হুজুরের দেহের চাপে প্রায় বেদখল তার ওপর জামাকাপড়ের এ অবস্থায় সে মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। ব্রেক ফেল করা গাড়ির মতো মানসিক অবস্থা তার।’ এ অসহনীয় অবস্থায় বজলুর জাগ্রত বিবেক বলছে ঃ অমন উসখুস করছো কেন? কোন অসামান্য রুপবতী নারীকে যদি তোমার পাশে বসিয়ে দেয়া হতো আর সে যদি নিদ্রার প্রাবল্যে তার যৌবনমদির দেহবল্লরী তোমার দিকে এলিয়ে দিতো তখন কি অমন বিরক্তবোধ করতে? 

তখন অবশ্যই অমন মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে না। মনে কর, ও যদি তোমার শ্রদ্ধেয় শ^শুর অথবা খালুজান হতো তখন কি করতে? অভদ্রের মতো ঝটকা মেরে কি পারতে পা দু’খানা সরিয়ে দিতে? নিশ্চয়ই পারতে না। গল্পের চরিত্র চিত্রণে রয়েছে লেখকের অসাধারণ অর্ন্তদৃষ্টি আর তা ভাষায় রুপ দেখার রয়েছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষতা। এর ফলে গল্পটি হয়ে ওঠেছে নিখুঁত ও নিটোল। পাঠকের চোখের সামনে বজলু ও হুজুর জীবন্ত দু’টি মূর্তি। একটি নিটোল ছবি।

নিঝুম, ফকিরের ধনের নেশা ও নিভৃত নিকুঞ্জে গল্পগুলো আমাদের অতি পরিচিত সমাজ ও মানুষের প্রতিচ্ছবি। গল্পে যেমন অনাবিল প্রেমপ্রীতি ভালোবাসা দরদ ও মমত্তবোধ রয়েছে তেমনি রয়েছে কিছু অবিশ^াস, হিংসা এবং কিছুটা অলৌকিকতা যা আমাদের স্বভাব ও বিশ^াসের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আছে। প্রেমের নামে কোথাও সমাজশৃংখলা বহির্ভূত কোন বাড়াবাড়ি কিংবা অসংগতি নেই। সর্বত্রই মার্জিত রুচি ও সংযমের মধ্য থেকে গল্পের চরিত্রগুলো হয়ে ওঠেছে মহত ও বিশ^স্ত। একজন মহৎ গল্পকারের যে জীবনদর্শন থাকা উচিত, যে দর্শনে রচিত সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজকে মহৎ ও সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়, সেই মহৎ জীবনদর্শন তমসুর হোসেনের মধ্যে রয়েছে তার স্বাক্ষর রয়েছে এই ‘ভাঙ্গা বুকে রাঙা হাসি’ গ্রন্থের গল্পগুলোতে। প্রচ্ছদ ও বাঁধাই যাই হোক- গল্পের সাহিত্যমানই পাঠকের কাছে আদৃত হবে তাতে সন্দেহ নেই। আমরা গ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রসার কামনা করি। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ