শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ওমরাহ’য় যেতে সঠিক এজেন্ট বাছাই

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : আমার পরিবারের চার সদস্য গত দুই বছর ধরে ওমরাহ পালনের জন্য চেষ্টা করে আসছিলাম। কিন্তু ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, মেয়ের অফিসের ছুটি, আমার নিজের অফিসের ব্যবস্থাপনা- এইসব মেলাতে সময় লেগে গেছে। গত ৫ মে এসে সব এক কাতারে মিললো। ৬ মে থেকে ১৬ মে ১০ দিনের একটি হজ প্যাকেজ অনুসন্ধান করতে শুরু করলাম। যারা আমাকে সব সময় হজব্রত পালনের জন্য তাগিদ দিতেন, সে রকম একজন শুভানুধ্যায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি একটি এজেন্ট আল নাফি ট্রাভেলসের ঠিকানা দিয়ে মালিকের সঙ্গে নিজেও কথা বললেন। আমিও কথা বললাম। জনপ্রতি এক লক্ষ পাঁচ হাজার টাকা। কথা হলো, ঢাকা থেকে জেদ্দা, জেদ্দা থেকে বাসে মক্কা, মক্কায় পাঁচ দিন কাবা শরীফের কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থা। ১১ মে বাসে করে মদিনা নিয়ে যাওয়া, মসজিদে নববীর কাছাকাছি কোনো এক হোটেলে থাকা আর ১৬ তারিখে মদিনার বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়াÑএটা হবে এজেন্টের দায়িত্ব। আমাকে জানানো হলো, জেদ্দা থেকে আমাদের মক্কায় নিয়ে আসার জন্য আমীর নামে তার একজন লোক প্রস্তুত থাকবে। মদিনায়ও থাকবে তার লোক। এজেন্সির মালিক নাজিম উদ্দিন তার লোক পাঠিয়ে দ্রুতই এক লক্ষ টাকা অগ্রিম নিয়ে গেলেন।
কিন্তু পাসপোর্ট আর নেন না। নাজিম উদ্দিনকে ফোন করি, ভাই পাসপোর্ট যে নিচ্ছেন না। ঠিক সময়ে ভিসা হবে তো? পরিস্থিতিটা এমন যে, নির্ধারিত সময়ে যদি যাওয়া না হয়, তা হলে হয়তো এবার আর ওমরাহ’য় যাওয়াই হবে না। ভেতরে ভেতরে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। শেষ পর্যন্ত যাওয়ার দিন দশেক আগে এজেন্সির লোক এসে পাসপোর্টগুলো নিয়ে গেলেন। তারপর আর খবর নেই। ফোন করে জানতে চাই, ভাই, ভিসার খবর কী? তিনি বলেন, হয়ে যাবে। এদিকে দিন ফুরিয়ে আসছে। প্রস্তুতির কেনাকাটা আছে। তাও করতে পারছি না। যদি ভিসা না হয়। শেষে ২ মে অনেকটা হাল ছেড়ে দিলাম। আল্লাহ তায়ালা যদি ভাগ্যে না রাখেন, তাহলে কী করা যাবে। নাজিম উদ্দিনকে বললাম, ভাই, যদি ভিসা না হয়, তাহলে পাসপোর্ট আর টাকাটা ফিরিয়ে দিন। তিনি বললেন, ৩ তারিখ বিকাল ৪টায় ভিসা পাবেন। বিকাল ৪টায় তার ফকিরাপুলের অফিসে লোক পাঠালাম। তিনি বা তার পরিচালকরা কেউ অফিসে নেই। আমার প্রতিনিধি তাকে যতবার ফোন করেন। তিনি ততোবার বলেন, কাছাকাছিই আছি। আসছি। আমি আল্লাহ ভরসা করে এহরামাদিসহ কেনাকাটা করে ফেললাম। সাড়ে ৬টার দিকে আমার লোক ফোন করে জানালেন, ভিসা হয়েছে। পাসপোর্টও হাতে পাওয়া গেছে। আমি মহান আল্লাহর কাছে হাজার শোকর আদায় করলাম।
৬ তারিখ ভোর পৌনে তিনটায় কাতার এয়ারলাইন্সে ফ্লাইট। ঢাকা থেকে দোহা ৫ ঘণ্টার ফ্লাইট। সেখানে সাড়ে তিন ঘণ্টা যাত্রাবিরতি। এহরাম বাঁধলাম জেদ্দা বিমানবন্দরেই। সেখান থেকে জেদ্দা আড়াই ঘণ্টা। দুপুর নাগাদ জেদ্দা পৌঁছলাম। সেখানে হজযাত্রীদের আলাদা একটা টার্মিনালে নামানো হয়। আমরা জনা চল্লিশেক যাত্রী সেখানে নামলাম। তার মধ্যে আল নাফি ট্রাভেলসের আমরা ১৮ জন। কিন্তু বাকি ১৪ জনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। টার্মিনালে নেমে দেখলাম, আমাদের কারও লাগেজ সেখানে পৌঁছেনি। আমার শুভ্যানুধ্যায়ীরা টার্মিনালের ভেতরে এক বাংলাদেশী ভদ্রলোককে ঠিক করে রেখেছিলেন আমাকে সহায়তা করার জন্য। টার্মিনালে নেমেই তার দেখা পেলাম। বেশ প্রভাবশালী, লাইন টাইন ভেঙে আমাদের ইমিগ্রেশন পার করিয়ে নিলেন। কিন্তু কারও লাগেজ সেখানে নেই। জেদ্দায় আমাদের রিসিভ করার জন্য উপস্থিত থাকার কথা ছিল আমীরের। তাকে বার বার ফোন দেয়া হলো কিন্তু তিনি রিসিভ করলেন না। হজযাত্রীরা মেঝের ওপর বসে রইলেন। লাগেজ কীভাবে পাওয়া যাবে। সেখানে কর্মরত যারা সৌদি তারা ইংরেজি বাংলা বুঝেন না। ফলে হজযাত্রীরা বিপাকে পড়লেন। ইতিমধ্যে আমাকে সহযোগিতা করতে যিনি এসেছিলেন তিনি জানালেন আমাদের লাগেজ চলে গেছে ভিন্ন টার্মিনালে। সেখানে একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাকে ফোন করে লাগেজের সন্ধান মিলল। টার্মিনালের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন অন্য শুভানুধ্যায়ীরা। আমাদের সৌভাগ্য, তাদের একজন ওইদিনই ওমরাহ করার মনস্থ করেছেন। এজেন্সির লোক যেহেতু পাওয়া গেল না, ফলে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থাও অনিশ্চিত হয়েছিল। এ শুধু আমাদের নয়, নাফি ট্রাভেলসের বাকিদের ব্যাপারেও সম্ভবত এটাই সত্য ছিল। যিনি ওমরাহ করবেন বলে মনস্থ করেছেন উনি আমাদেরকে মক্কায় নিয়ে যাবেন, ঠিক হলো। কিন্তু উঠব কোথায়? আমীরই আমাদের হোটেল ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু তারই তো সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন আমার শুভানুধ্যায়ীরা মক্কার বাঙালি মহলে টেলিফোন করে তোলপাড় সৃষ্টি করলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই আমীরকে পাওয়া গেল কিনা, আমি তা বুঝতে পারিনি। জেদ্দা থেকে মক্কার দিকে রওনা হয়ে গেলাম। আমাদের ওমরাহর সঙ্গী তপন নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তিনি আশ্বস্ত করলেন যে, হোটেল খুঁজে পাওয়া যাবেই। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। তারপর সারা পথ একে ওকে ফোন করলেন শেষ পর্যন্ত সোয়া ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা কাবার কাছাকাছি একটি পার্কিং লটে গাড়ি দাঁড় করালাম। আবার খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। শেষ পর্যন্ত বিএনপির এক তরুণ কর্মী দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই আমীরের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের একটি হোটেলে নিয়ে গেলেন। যে হোটেলে থাকবার ব্যবস্থা করার কথা ছিল, এটি সে হোটেল নয়। তবু একটা আশ্রয় তো মিলল। ওই আমীরকে বার বার আমি ফোন দিলাম কিন্তু একবারও তিনি ফোন রিসিভ করলেন না। তবে একটি রুমের ব্যবস্থা হলো। সিঙ্গেল বেডের রুম কিন্তু তার ভেতরে ৬ ফুট বাই তিন ফুট ৫টি চৌকি ফেলা আছে ৫ জন থাকবার ব্যবস্থা। টেবিল চেয়ার কিছু নেই, সাবান নেই, তোয়ালে নেই, টয়লেটে টিস্যু নেই। কিন্তু বিছানাগুলো পরিষ্কার চাদরে মোড়ানো। আমরা লাগেজ রেখে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ করতে কাবা শরীফের দিকে রওনা হলাম। তবে থাকবার আয়োজন যাই হোক না কেন, সেখান থেকে কাবার দূরত্ব হাঁটা পথে ১৫ মিনিটের বেশি নয়। নাফি ট্রাভেলসের মালিক নাজিমউদ্দিন এই একটি কথা অন্তত রেখেছেন।
আমরা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলাম। হোটেলের ভেতরেই বাঙালি খাবারের একটি রেস্টুরেন্ট আছে। মাছ-মুরগি-গরু-সবজি প্রতিদিনের মেন্যু। ওমরাহ আর ইবাদত বন্দেগিতেই দিনগুলো পার হয়ে গেল। এর মধ্যে মাঝে মধ্যেই আমাদের  দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত আমীরকে ফোন করি। কিন্তু কখনই তিনি ফোন ধরেননি। ১০ মে অবশেষে তিনি ফোন ধরলেন। ১১ মে সকালে আমাদের বাসে মক্কা থেকে মদিনায় যাবার কথা। ফোন ধরেই উনি বেশ রাগত স্বরে আমাকে বললেন, আপনার জন্য এতো লোক কেন আমাকে ফোন করেছেন? আপনি বিএনপির কোন পদে আছেন? তাকে বললাম, আমি বিএনপির কোন পদে নাই। সাংবাদিক মাত্র। তাতে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না, বরং বললেন, এভাবে বিরক্ত করার কোনো মানে হয় না। আমি তো আপনার জন্য রুম রেখেছি। রুমে তো উঠেছেনও। তাহলে আবার কথা কি? আমি তাকে বললাম, ঠিক আছে ভাই সেটা না হয় ভুল হয়েছে। কিন্তু আপনি তো একবার দেখা করবেন। তিনি জানালেন মাগরিবের আগে তিনি আসছেন। আমি যেন অপেক্ষা করি। আমি লবিতে অপেক্ষা করছিলাম তখন তিনি এলেন এবং নিজেই আমাকে চিনে নিলেন। পরদিন সাড়ে ৭টায় মদিনায় যাবার বাসের কথা বললেন এবং এটাও জানালেন যে, তার ভাগ্নে এসে আমাদেরকে বাসে তুলে দেবে। আমরা যেন পৌনে ৭টায় নিচে নেমে আসি। তার সঙ্গে আর কথা বাড়াইনি। ১১ তারিখ সকালে তার ভাগ্নে যথাসময়ে এসেছিলেন। হাসিমুখ তরুণ আমাদের বাসে তুলে দিলেন। সাড়ে পাঁচ ঘন্টার জার্নি মক্কা থেকে মদিনা। বড় আকারের বাস কিন্তু প্রত্যেককে যার যার হোটেলের সামনে নামিয়ে দেয়। সেখানেও যে হোটেলে থাকবার কথা সে হোটেলে আমাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেখানকার প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন বয়সে তরুণ, তাকে ফোন দেয়া মাত্র তিনি ধরলেন। বললেন, ড্রাইভারকে যেন বলি- হোটেল করম সিলভার-এ আমাদেরকে নামিয়ে দেয়। কাউন্টারে বলা আছে আপনাদের রুমের ব্যবস্থাও পাকাপাকি করা আছে। কোনো সমস্যা হবে না। সত্যিই কোনো সমস্যা হলো না। ড্রাইভার করম সিলভার হোটেলের সামনে আমাদের নামিয়ে দিলেন। কাউন্টারে যিনি ছিলেন তিনিও ৩৫ বছরের তরুণ। আমাকে দেখেই চিনলেন। চাবি বের করে দিলেন। বললেন, স্যার যে কোনো অসুবিধা হলে আমাদের জানাবেন। সকলকে বলা আছে। এখানেও ছোট রুম, তার মধ্যেই ৪টি বেড পাতা। মাথাপিছু একটি করে  তোয়ালে, সাবান শ্যাম্পু। টয়লেট ও ফ্রেসিয়াল টিস্যু, সব কিছুরই ব্যবস্থা আছে। সিথানের কাছে ছোট্ট একটি টুল। যেখানে টুক-টাক জিনিসপত্র রাখা যায়। এখানেও কোনো অভিযোগ নেই। সালাহউদ্দিন মাঝেমধ্যেই ফোন করে খোঁজ নিচ্ছিলেন, স্যার কোনো অসুবিধা নেই তো? কোন সমস্যা বোধ করলে আমাকে ফোন দেবেন। আমি সারাদিন আশপাশেই থাকি। এখানে আল নাফি ট্রাভেলস কথা রেখেছিল। এখান থেকে মসজিদে নববীর দূরত্ব ৫-৭ মিনিট। ফলে ওয়াক্তের নামাজ আদায়ে এখানেও কোনো অসুবিধা হয়নি।
ইবাদত-বন্দেগি, নামাজ আদায়, মহানবীর (স.) রওজা মোবারক- এসবের মধ্য দিয়ে দিন দ্রুতই চলে যাচ্ছিল। সালাহউদ্দিনই সব সময় খোঁজ-খবর রাখতো। আমার তাকে খুব একটা ফোন করতে হয় নাই। আমার এক খালাতো ভাই সোলায়মান মদিনায় থাকে ২৫ বছর। সে দেখা করতে এলো। তার বাসায় নিয়ে গেল। খেলাম একসঙ্গে। সালাহউদ্দিন দেখা করতে এলেন ১৪ মে। আমি তাকে বললাম, আমাকে বিমানবন্দরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা কি? ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে। মদিনা বিমান বন্দরে তারাই আমাদের পৌঁছে দেবেন। সালাহউদ্দিন বললেন, কিন্তু আপনার ভাউচারে তো সে কথা লেখা নেই। তবুও আমি যোগাযোগ করে দেখি। আমি আমার অফিসের একজন স্টাফকেও আল নাফির নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললাম। সালাহউদ্দিনও বললেন, নাজিমউদ্দিন নির্বিকারভাবে তাদের জবাব দিলেন- এয়ারপোর্টে উনাকে উনার মতো করেই যেতে হবে। ভাড়া খুব বেশি নয়, মিটারের খুব একটা প্রচলন নেই। ফলে ট্যাক্সি ড্রাইভাররা যার কাছ থেকে যা পারে সে ভাড়াই আদায় করে নেয়। তা হতে পারে ৬০ থেকে ১০০ রিয়াল। এর মধ্যে আমি নিজেও অনেকবার নাফি ট্রাভেলসের নাজিমউদ্দিনকে ফোন করেছি নরমাল টেলিফোনে, ইমোতে। তিনি একবারও ফোন ধরেননি। আমার সঙ্গে আরো যে ১৪ যাত্রী জেদ্দা বিমানবন্দরে লাগেজ হারিয়ে অসহায়ভাবে মেঝের ওপর বসে ছিলেন, তারা শেষ পর্যন্ত কীভাবে কি করেছিলেন জানি না। নিশ্চয়ই মহান রাব্বুল আলআামিন তাদের ওমরাহ করিয়েছেন। কিন্তু কতো ঘাটে যে সেই সব সাধারণ মানুষকে খাবি খেতে হয়েছে, তা কল্পনা করাও কঠিন। তবু আল্লাহর অসীম রহমতে শেষ পর্যন্ত ওমরাহ পালন ও মসজিদ নববীতে নামাজ আদায়ের সৌভাগ্য আল্লাহতায়ালা আমাদের দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লøাহ। তাঁর দরবারে হাজার শোকর।
কিন্তু এক্ষেত্রে একটাই পরামর্শ, যেনতেন সাব-এজেন্টের মাধ্যমে হজ কিংবা ওমরায় যেতে সতর্ক থাকুন। প্রতিষ্ঠিত এজেন্টের মাধ্যমে যাওয়ার চেষ্টা করা ভালো। কাগজে কি লেখা আছে, আপনি কি চান বা আপনার সঙ্গে কি কথা হয়েছে তা ভালভাবে মিলিয়ে বুঝে দেখে নিন। তা না হলে ঝামেলার শিকার হওয়া বিচিত্র হবে না। আর হজেই যান কিংবা ওমরাহ’য় যান সঙ্গে মাথাপিছু রাখুন একটি প্লেট। সৌদি আরবে বেশির ভাগ হোটেলে পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর ভাত-মাছ ডাল একসঙ্গে ঢেলে ৩-৪ জনে মিলে খেয়ে থাকেন। সেখানে প্লেটের সংস্কৃতি নেই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ