শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

মুক্তিযুদ্ধ না করেই টাকার বিনিময়ে তালিকায়

উলিপুর (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা : কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের সাক্ষাৎকার গত ৪ এপ্রিল শেষ করলেও নানা লুকো-চুরির পর গত মঙ্গলবার তালিকা নোটিশ বোর্ডে টাঙ্গানো হয়। টাঙ্গানো তালিকা মাত্র ২ ঘন্টার মধ্যে বোর্ড থেকে সড়িয়ে ফেলার ঘটনায় যাচাই-বাছাই কমিটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যাচাই-বাছাই শেষ হওয়ার সাথে সাথে তালিকা নোটিশ বোর্ডে টাঙ্গানোর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও রহস্যজনক কারণে তা না টাঙ্গীয়ে বাচাই কমিটি নীরবতা পালন করে। ফলে খসড়া তালিকা প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে বাদপড়া ব্যক্তিরা আপীল ও সংক্ষুব্ধ ব্যাক্তিদের অভিযোগ করার সময় সীমা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

উপজেলার সর্বত্র গুঞ্জন রয়েছে, তালিকায় মোটা অংকের টাকা নিয়ে যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের নাম আগে যাতে প্রকাশ না হয়, কারণ কেউ যেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে না পারেন সেজন্য এ তালিকা টাঙ্গানো হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, লাখ লাখ টাকা নিয়ে অমুক্তিযোদ্ধার নাম এবারের তালিকায় অন্তভুক্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের মতো উলিপুরেও গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হয়। এ উপজেলায় অনলাইনে আবেদনকারি ২’শ ৫১, গেজেট ভূক্ত ৫৯ এবং যাচাই বাচাই চলাকালে আসা ৩২ জন সহ মোট ৩’শ ৪২ জনের উপর যাচাই-বাচাই কার্যক্রম চলে। 

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, যাচাই-বাচাই কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যরা যাচাইয়ের আওতায় আসা গেজেট ভূক্ত এবং সার্টিফিকেটধারি মুক্তিযোদ্ধা ও নতুন আবেদন কারিদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। বিশেষ করে ভুয়া ও নতুন আবেদনকারিদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ও সর্ব নি¤œ ৩ লাখ টাকা করে নেয়া হয় বলে ব্যাপক গুঞ্জন শোনা যায়। এছাড়া, কমিটির সদস্যদের খাঁসী জবাই করে দাওয়াত খাওয়ানো হয়, যানবাহনসহ বিভিন্ন ধরনের উপঢৌকন দেয়ার বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দুদের বাড়ি-ঘর লুটপাট ও সম্পত্তি দখল করে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রেখেছেন এমন একজন জনপ্রতিনিধির নামও প্রকাশিত তালিকায় থাকায় অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা বিস্মিত হয়েছেন। আবার যাদের বয়স মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৩ বছরের নিচে ছিলো তারা ভুয়া এসএসসির সার্টিফিকেট দিয়ে মুজিবনগর কর্মচারি হিসাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এমনকি ঐ সময় যাদের বয়স ১০ বছর ছিল তাদের নামও তালিকায় রয়েছে। যাচাই-বাচাই চলাকালে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য সাবেক পোস্টমাস্টার দেলওয়ার হোসেন ও মৃত ডাঃ কেবারত উল্ল্যাহর পরিবার সহ আবেদনকারিদের ৪/৫ জনের বাড়ি থেকে যাচাই বাচাই কমিটির সদস্যদের সকালের নাস্তা ও দুপুরের ভাত সরবরাহ করা হয়।

এদিকে সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গোলাম মোস্তাফা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা মর্মে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেন, একটি পৌরসভাসহ ১৩ ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার এবং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যকরি কমিটির ১১ সদস্য। এরমধ্যে যাচাই বাচাই কমিটির সদস্যও রয়েছেন, এরা হলেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম.ডি ফয়জার রহমান, ডেপুটি কমান্ডর গোলাম হোসেন মন্টু ও পান্ডুল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল আজিজ। এছাড়া সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ মোকছেদ আলীর চাকরি শেষ হলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ২ বছর চাকরি শুরু করলে তার বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার একাধিক খবর বিভিন্ন পত্রিকায় ফলাও ভাবে প্রকাশ পায়। তিনিও এখন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।

অভিযোগ রয়েছে গত ৪ এপ্রিল যাচাই-বাচাই শেষ করা হলেও রহস্যজনক কারণে গত ১৩ মে যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শেষ দেখানো হয় এবং ঐ তালিকায় অনেক ঘষা-মাজা ও কাটাকাটি রয়েছে বলে জানা যায়। 

যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিনিধি ওসমান গনি জানান, এই তালিকা টাঙ্গাবেন ইউএনও। সরকারি নির্দেশনার ব্যাপারে কথা বললে তিনি বলেন, অবশ্যই এটা টাঙ্গাতে হবে। ইউএনও স্থানীয় ঝামেলা ও গন্ডগোল এড়াতে তালিকা প্রকাশে দ্বিধান্বিত রয়েছেন।

উৎকোচ নিয়ে তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভক্তির বিষয়ে কমিটির সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এমডি ফয়জার রহমানের সাথে কথা হলে তিনি টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। কমিটির সদস্য সচিব উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ শফিকুল ইসলামের দাবি, ‘তালিকা টাঙ্গাতে হবে এমন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নাই’। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের মোঃ মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত ও জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে ‘যাচাই বাছাই নির্দেশিকা ২০১৬ অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে প্রতিবেদন প্রেরণ করবে এবং সংশ্লিষ্ট উপজেলা নোটিশ বোর্ডে একটি কপি টাঙ্গিয়ে দেবে। কিন্তু এ উপজেলায় তা মানা হয়নি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ