শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

লালমনিরহাটে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে বাড়ি নির্মাণ

লালমনিরহাট : প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করছেন রাসেদুল

মোঃ লাভলু শেখ, লালমনিরহাট : ঢাকা শহরের ৪ তালা বাড়িটি বিক্রি করেছেন। গ্রামে ফিরে বানিয়েছেন প্লাস্টিকের বোতলের বাড়ি। জেলার বিভিন্ন স্থানের ছোট ছোট দোকান থেকে কিনেছেন নানা ধরণের প্লাস্টিকের বোতল। আর সেই বোতলের বাড়ি তৈরী করে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন রাসেদুল-আছমা বেগম নামে ১ দম্পতি।
ঢাকার শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করেছেন তারা ২’জনে। তাদের স্বপ্ন ছিলো পরিবেশ বান্ধব ১টি বাড়ি তৈরি করার। কিন্তু কেন সেই দম্পতি শহর ছেড়ে গ্রামে বাড়ি করলেন? এমন প্রশ্নে স্ত্রী আসমা বেগম বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামের চারদিকে সবুজ বনানী আর ফসলের মাঠ। এমন দৃশ্য শহরে কোথাও পাওয়া যায় না। আর আমার জন্ম, শৈশব, কৈশোর-বড় হওয়া সব কিছুই শহরে। গ্রামের কোলাহল মুক্ত চারদিকের পরিবেশ, সবুজ মাঠ আমাকে শিশুকাল থেকেই কাছে টানে। তাই আমাদের ইচ্ছা গ্রামে ১টি প্লাস্টিকের বাড়ি নির্মাণ করা।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুরের নওদাবাস গ্রামের আব্দুল বারী মোক্তারের ছেলে রাসেদুল আলম গ্রামের ১টি স্থানীয় স্কুল থেকে এসএসসি অতপর এইচএসসি পাশের পর ঢাকার শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করেন। পড়াশুনা চলাকালেই একই কলেজের ছাত্রী ও ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীর আফসার উদ্দিনের মেয়ে আসমা বেগমকে বিয়ে করেন। এর পর প্রায় ৮ বছর ২’জনেই ওই কলেজে পার্ট টাইম অধ্যাপনা করেন। তাদের দাম্পদ্য জীবনে একটাই স্বপ্ন ছিল পরিবেশ বান্ধব ১টি বাড়ি তৈরী করা।
রাসেদুল ও আছমা দম্পতির পরিকল্পনা পুরো গ্রামে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে বাড়ি বানানো। অবশেষে প্লাস্টিকের বোতলে বালি ভরে দেয়াল তৈরিতে তাঁরা সফলও হন। সরেজমিনে দেখা যায়, শ্রমিকরা বোতলে বালি ভরে কাজ করেছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়ির ফাউন্ডেশন, ভিত্তি স্থাপন, নিলটন পুরো কাজেই সহযোগিতা করছেন স্থানীয় শ্রমজীবী ও রাজমিস্ত্রিরা। রাজমিস্ত্রিরা বালি ভর্তি বোতল দিয়ে দেয়াল তৈরি করছেন।
 বোতলের বাড়ি দেখার জন্য প্রতিদিন সেখানে অসংখ্য মানুষের ভিড় জমছে। স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরাও আসছে দলে দলে। দিন যতই যাচ্ছে ,উৎসুক মানুয়ের ভীড় ততই বাড়ছে। রাসেদুল ও আছমা দম্পতির ওই বাড়িটি খুজে বের করতে এখন আর বেগ পেতে হয়না। রিক্সা ও ভ্যান ওয়ালাকে ‘বোতলের বাড়ি যাব’ বললেই নিয়ে যায়।
প্রথম দিকে সবাই এটাকে পাগলামী বলতেন। ভাই- বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই এর বিরোধীতা করছিলেন। কিন্তু রাসেদুলের ইচ্ছাশক্তিকে কেউ দমাতে পারেনি। তিনি একাই জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বোতল সংগ্রহ করেন। লোহা-ভাংড়ীর দোকানে খুঁজে খুঁজে সে সংগ্রহ করে তার প্রয়োজন মত ৪০/৪৫ মন প্লাস্টিকের বোতল।
১ ফেব্রুয়ারি ছিল তাদের বিবাহ বার্ষিকী। ওই দিনটিকেই তারা বেছে নেন শুভ দিন হিসেবে। ওইদিনই শুরু করেন স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণের কাজ । ‘ইকো হাউস’ বোতলের বাড়ি সম্পর্কে আসমা বেগম জানান, ফেলে দেয়া প্লাস্টিকের বোতল খুব সহজে সংগ্রহ করা যায়। ১টি মাঝারি বোতল সাধারনতঃ ১০ ইঞ্চি এবং এর ব্যাস হয় সাড়ে ৩ ইঞ্চি। অর্থাৎ প্রায় ১টি ইটের সমান। ১টি ইটের দাম পড়ে সাধারণত ৯-১০ টাকা। আর ১টি বোতল ক্রয়, বালু ভরা সবমিলে ৩ টাকার উর্ধে খরচ হয় না। ইটে আর বোতলে সিমেন্ট ব্যবহার প্রায় সমান। ইটের থেকে প্লাস্টিকের বোতলে ব্যয় সাশ্রয় হয় প্রায় অর্ধেকের বেশী। তিনি আরও বলেন, বোতলের বাড়ি ৮মাত্রা ভূমিকম্প সহনীয়। বালু সাধারণতঃ গরম বা ঠান্ডা দ্রুত চুষে নেয়। যে কারণে গরমের সময় ঠান্ডা এবং ঠান্ডার সময় গরম রাখতে পারে। বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষ কাঁচা ঘর বাড়িতে বসবাস করে। বাঁশ, কাঠ, টিনের বেড়া দিতে যে টাকার দরকার, তা’দিয়ে নিজেরাই ইচ্ছা করলে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে পাকা দেয়াল নির্মাণ করতে পারবে। ১টি কাচা বাড়িতে প্রতি বছর খুটি বদলাতে হয়। তাছাড়া ঝড় বাদলের ভয়তো আছেই। এছাড়াও নির্মাণের প্রচলিত উপাদানের তুলনায় প্লাস্টিকের বোতলের দাম অনেক কম। তাই একটি বাড়ির ৬টি রুম তৈরী করতে খরচ হচ্ছে মাত্র ৪ লক্ষ টাকা।
রাসেদুল বলেন, তার প্লাস্টিকের বোতলের বাড়ির নির্মাণকাজ ৩ মাস আগে শুরু করেছেন। ওই সময় এলাকার অনেকেই অনেক কিছু বলেছেন, কিন্তু এখন সবাই তার বাড়ি দেখতে আসেন। তার বাড়ি তৈরী দেখে এখন অনেকেই প্লাস্টিকের বাড়ি তৈরী করতে আগ্রহী হচ্ছে বলে এলাকাবাসী জানান।
কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ নেওয়াজ খান বলেন, প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তৈরী বাড়ি পরিবেশ বান্ধব হলেও এটি ব্যবহারের আগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন হওয়া উচিত। তিনি আশাবাদ জানিয়ে বলেন, দরিদ্র মানুষদের কাছে এ ধরনের বাড়ি মডেল হিসেবে কাজ করবে। রাসেদুল দম্পতির বোতল হাউজের সাথে প্রকৌশলগত দিক সমন্বয় করলে এটি আরো নিরাপদ ও টেকসই হবে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ