শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

যুক্তির কষ্টি পাথরে মঙ্গল শোভাযাত্রার মঙ্গল-অমঙ্গল

১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরের শাহবাগ-রমনা এলাকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। মাহবুব জামাল শামীম নামক শুরুর দিকের একজন অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে জানা যায় পূর্বে এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। সেই সময়ের সংবাদপত্রের খবর থেকেও এমনটা নিশ্চিত হওয়া যায়। বিভিন্ন সংবাদপত্রের থেকে যতোটা ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে।
জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা বা ইনট্যানজিবল (Intangible) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা’য় অনুষ্ঠিত ২৮ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর সংশিষ্ট আন্তর্জাতিক পর্ষদ (INTERGOVERNMENTAL COMMITTEE FOR THE SAFEGUARDING OF THE INTANGIBLE CULTURAL HERITAGE) বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবটি অনুমোদন করে।
কিভাবে এলো এই বৈশ্বিক স্বীকৃতি সেদিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে ইতিহাস বলে যে, ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি তালিকা প্রণয়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং এশিয়াটিক সোসাইটিকে এর দায়িত্ব দেয়া হয়। ১২ খ-ে প্রকাশিত এই তালিকা তথা সমীক্ষা প্রতিবেদনের ১১শ খ-ে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সর্বপ্রথম ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর প্যারিসে অবস্থিত সদর দপ্তরে আবেদন করেছিল যে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলা একাডেমী এই প্রস্তাবনাটি প্রণয়ন করে। পরবর্তীকালে ইউনেস্কোর চাহিদা অনুযায়ী এই প্রস্তাবনাকে গ্রহণযোগ্যরূপে পুনঃপ্রণয়ন করা হয়। ২০১৫ এর ১লা জুন প্যারিসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. শহিদুল ইসলাম এই পুনঃপ্রণীত প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পুনরায় ইউনেস্কোর নিকট দাখিল করেন। যার ফলশ্রুতিতে উপর্যুক্ত স্বীকৃতিটি অর্জিত হয়।
এখন আসুন যুক্তির কষ্টি পাথরে বৈশ্বিক সংস্কৃতির অঙ্গ "মঙ্গল শোভাযাত্রা"র মঙ্গল-অমঙ্গল নির্ণয় করি। তবে আগেই বলে নিচ্ছি যে, কোনো ধর্ম বা মতকে কটাক্ষ করার উদ্দেশ্যে আমি লিখছিনা। শুধু পক্ষে বিপক্ষের কথাগুলো বিশ্লেষণ করব মাত্র।
মঙ্গল একটি বাঙলা শব্দ যার অর্থ হল: শুভ, ভালো, উপকার, কল্যাণ। সৌর জগতের একটি গ্রহের নাম; Mars; কুজ নামক গ্রহ। মঙ্গলের সাথে যদি গীত যুক্ত হয় তবে সেটি(মঙ্গলগীত) দ্বারা হিন্দু দেবদেবীর মাহাত্ম্যজ্ঞাপক গানকে বুঝায়। মঙ্গলের সাথে যদি ঘট যুক্ত হয় তবে এর (মঙ্গলঘট) অর্থ দাঁড়ায় হিন্দু সমাজে ব্যবহৃত কল্যাণসূচক পূর্ণঘট। মঙ্গল শব্দের অন্তে যদি "া" কার যুক্ত হয় তবে সেটি (মঙ্গলা) দ্বারা হিন্দু ধর্মের দূর্গাদেবীকে বুঝানো হয়। উপর্যুক্ত শব্দ বিশ্লেষণটি "বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান" থেকে গৃহিত।
মঙ্গল শোভাযাত্রার পরের অংশ যৌগিক শব্দ "শোভাযাত্রা" তে শোভা অর্থ: কান্তি; দীপ্তি, ঔজ্জল্য; মাধুরী; সৌন্দর্য; সৌষ্ঠব; বাহার। আর যাত্রা শব্দের অর্থ: গমন; প্রস্থান; নির্গমন; বের হওয়া। যাত্রা এর আদিতে যদি আমরা রথ যুক্ত করি তাহলে সেটি (রথযাত্রা) দ্বারা বুঝায় হিন্দু ধর্মের উৎসব বিশেষকে। সূতরাং যৌগিকভাবে যদি আমরা শোভাযাত্রা অর্থ খুঁজি তাহলে বুঝি যে যে যাত্রাতে শুভ কিছু আশা করা যায়। উপর্যুক্ত শব্দ বিশ্লেষণটি ও "বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান" থেকে গৃহিত। বাস্তব দৃষ্টিতে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে হিন্দু সংস্কৃতির অংশ বলা যাবে। বিষয়টি আরো পরিষ্কার ও উপলব্ধি যোগ্য করার জন্য বলছি: হিন্দুরা যুদ্ধ দেবতা হিসেবে মঙ্গল পূজা করে থাকেন। হিন্দুদের পূজায় ব্যবহৃত প্রদীপকে মঙ্গল প্রদীপ বলা হয়। হিন্দুদের বিবাহের প্রথম উৎসবকে বলা হয় মঙ্গলাচারণ। সূতরাং মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্দেশ্যে সার্বজনীনতা পাওয়া যায়না। সে হিসেবে এটি সাম্প্রদায়ীকতাকে প্রকটভাবে ধারন করেছে। হিন্দুদের ধর্মীয় পার্বণকে অত্যন্ত কৌশলের সাথে নব্য শব্দ ব্যবহার করে ও নব্য বিষয়ের উদ্ভাবন করে মুসলিম প্রধান এদেশের উপর চাপানো হচ্ছে। যা বাম রাজনীতিবিদদের একটি ষড়যন্ত্র বৈকি। আর এই শোভাযাত্রাতে যে সকল উদ্ভট উদ্ভট প্রাণী ও পশুর প্রতিকৃতি এবং কুৎসিত কুশ্রী মুখায়ব প্রদর্শীত হয় সেগুলো কি করে মঙ্গল বা শুভাশুভের প্রতীক হতে পারে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় যেসব নির্দিষ্ট মূর্তি প্রদর্শন করা হয়, সেগুলোর অধিকাংশই হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবীর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। একইসাথে বিভিন্ন রাক্ষস-খোক্ষসের প্রতিকৃতি ও মুখোশও প্রদর্শন করা হয়। রাক্ষস-খোক্ষস নিশ্চয়ই মঙ্গলের প্রতীক হতে পারে না, বরং অশুভ ও অমঙ্গল তথা শয়তানের প্রতীক বলা যেতে পারে; তাহলে কেন এসবের প্রদর্শনী?  বস্তুতপক্ষে, রাক্ষস-খোক্ষসের প্রতিকৃতি ও মূর্তি নিয়ে এত মাতামাতির প্রচ্ছন্ন অর্থ হচ্ছে স্যাটানিজম তথা শয়তানের উপাসনা।
প্রাচীনকালে দেব-দেবতার উপাসনা করার পাশাপাশি শয়তানেরও উপাসনা করা হতো তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য, যাতে কোনো কারণে রুষ্ট হয়ে শয়তান অমঙ্গল বা অকল্যাণ না ঘটায়। মঙ্গল শোভাযাত্রা মানে নতুন বছরে মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যে শোভাযাত্রা করা, এর ফলে অমঙ্গল দূরীভূত হবে বলে আশা করা হয়; অথচ প্রতিবছর দেশব্যাপী অঘটন, দুর্ঘটনা ও অমঙ্গলজনক ঘটনাবলি একের পর এক অব্যাহতভাবে ঘটেই চলছে, কিছুতেই থামছে না। অমঙ্গলকে  তো মঙ্গল দিয়েই দূর করতে হয়। যেমন আঁধারকে আলো দিয়ে দূর করতে হয়। আর যদি আঁধারের কাছে আঁধারই নিয়ে যাওয়া হয় তবে বিদঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই মিলেনা। না মিলবে সেখানে একটু আলো, না মিলবে সেখানে পথ চলার পাথেয় হিসেবে একটু সহায়। বরংচ এই অবস্থা পথিক কে নিশ্চিত কুপথে বা ধ্বংসে পতিত করবেই। ‘হিন্দুরূপী মুসলমান’ এই 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'র ইনার টারগেট এটাও বলতে পারি। কেননা একটি ধর্মের ধর্মীয় কালচার ও উৎসবকে পূর্ণ চাতুর্য্যরে সাথে অন্যান্য সকল ধর্মাবলম্বীদের উপর চাপানো হয়েছে। এছাড়াও যদি আমরা সংবিধানের চারটি মূলনীতির দিকে লক্ষ্য করি তাহলেও এ শোভাযাত্রা সার্বজনীন হয় না। অধিকন্তু ৪১। (১) (খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।' উপধারা অনুযায়ী সংবিধানের পরিপন্থি।
য় এমফিল গবেষক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ