বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

অবশেষে থামছে মিসবাহ্- ইউনুসের পথচলা

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : অবশেষে ক্রিকেটকে গুডবাই জানালেন পাকিস্তানের দুই গ্রেট ইউনুস খান ও মিসবাহ-উল হক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে চলমান টেস্টই তাদের শেষ ম্যাচ। তাদের অবসরের ঘটনায় পাকিস্তানসহ ক্রিকেট বিশ্বে হতাশা নেমে এসেছে। যদিও বেশ কিছুদিন ধরে এই দুইজনের অবসর নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ইউনুস ও মিসবাহর অবসরের পর নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তান টেস্ট দলে অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা দেবে। দারুণ একটি মাইলফলক সামনে নিয়ে বিদায়ী টেস্ট সিরিজে খেলতে নামবেন ইউনুস। পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে ১০ হাজার রান পূর্ণ করতে আর মাত্র ২৩ রান দরকার তার। মিসবাহর সামনেও আছে এক মাইলফলকের হাতছানি। ৪৩ বছর পূর্ণ করতে যাওয়া এই ব্যাটসম্যান আর ৪৯ রান করলে হবে তার পাঁচ হাজার টেস্ট রান। পাকিস্তানের সাবেক গতিতারকা শোয়েব আখতার ইউনুস খানকে পাকিস্তানের সৎ ও নির্ভিক ক্রিকেটার হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। পাকিস্তানের ব্যাটিং স্তম্ভ ইউনুস খানকে ‘ইউনিক খান’ বলে ক্রিকেটবিশ্বে তুলে আনতে চাইছেন শোয়েব। তার মতে, ইউনুস ক্রিকেট বিশ্বের একজন চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার। আসন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন ইউনুস খান। শোয়েব জানান, তার নাম বদলে ‘ইউনিক খান’ রাখা উচিত। তার সাফল্য আর ক্রিকেটের প্রতি সততা থেকেই তাকে এই নামে ডাকা দরকার। তিনি বিশ্বক্রিকেটের একজন চ্যাম্পিয়ন। শোয়েব যোগ করেন, ‘ইউনুস খানের অবসর শেষের শুরু। তার অবসরকে আপনারা শেষ বলে দেখছেন। কিন্তু আমার কাছে এটাই তার শুরু। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। বোর্ড তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সুবিধা নিতে পারবে। পাকিস্তান ক্রিকেটের জন্য তিনি ব্যাট করতে পারবেন। শুধু তার জার্সি নম্বর ৭৫-ই অবসর নেবে।’ টেস্ট ক্রিকেট থেকে মিসবাহ্-উল-হকের অবসরের ঘোষণা দেয়ার দু’দিন পর একই ঘোষণা দেন ইউনুস খান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ শেষেই সাদা পোশাকে আর খেলবেন না বলে জানিয়ে দেন এই ডান-হাতি মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ (২১ এপ্রিল শুরু) শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন ৪২ বছর বয়সী মিসবাহ ও ৩৯ বছর বয়সী ইউনুস। পাকিস্তানের হয়ে ১১৫টি টেস্ট খেলেছেন ইউনুস। ৫৩.০৬ গড়ে রান ৯৯৭৭। ৩২টি অর্ধশতকের পাশাপাশি রয়েছে ৩৪টি সেঞ্চুরি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ২৬৫ ওয়ানডেতে ৩১.২৪ গড়ে ৭২৪৯ ও ২৫টি টি ২০তে ২২.১০ গড়ে তার ব্যাট থেকে আসে ৪৪২ রান। ওয়ানডেতে সাতটি শতকের পাশাপাশি হাঁকিয়েছেন ৪৮টি অর্ধশতক। টি ২০তে রয়েছে দু’টি ফিফটি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ইউনুসের নামের পাশে রয়েছে প্রায় ১৭ হাজার রান। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটেও করেছেন প্রায় ১০ হাজার রান। সম্প্রতি ইউনুস খানের নাম ওঠে উইজডেনের বর্ষসেরা পাঁচ ক্রিকেটারের তালিকায়। ১৭ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়া ইউনুস খানের। টেস্ট অভিষেক হয়েছিল ২০০০ সালে, শ্রীলংকার বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডিতে। একই বছর ওয়ানডেতে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ওয়ানডেতেও তার অভিষেক হয়। জাতীয় দলের হয়ে ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টি ২০ খেলেছিলেন। টেস্ট চালিয়ে গেলেও ২০১৫ সালের নভেম্বরের পর থেকে ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে নামেননি তিনি। কয়েকদিন আগে করাচিতে ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে ইতি টানার ঘোষণা দেন ৩৯ বছর বয়সী ইউনুস। অবসরের ঘোষণায় ইউনুস বলেন, মানুষ আমাকে অবসরের ঘোষণা না দেওয়ার জন্য বলছে, কিন্তু এটাই সময়। সব খেলোয়াড়ের জীবনে একটা সময় আসে যখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমি সবসময় দেশের জন্য মাথা উঁচু করে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কোনো খেলোয়াড় সবসময় ফিট থাকে না, অনুপ্রেরণা একইরকম থাকে না। তাই ইউনুসের চলে যাওয়ার এটাই সময়, ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসছে সিরিজের পর। ওয়েস্ট ইন্ডিজে পাকিস্তানের তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ শুরু হবে ২১ এপ্রিল, জ্যামাইকায়। দ্বিতীয় টেস্ট বার্বাডোজ ও তৃতীয় টেস্ট ডমিনিকায় হবে। ইংল্যান্ড সফর দিয়ে বিদায় নিচ্ছেন? নাকি অস্ট্রেলিয়া? নইলে কবে! গত এক-দেড় বছর ধরে পাকিস্তানের প্রতিটি সিরিজের আগে এই প্রসঙ্গ ছিল অবধারিত। অবশেষে মিলল সেটির সুনিশ্চিত উত্তর। পথচলায় ইতি টানার ঘোষণা দিলেন মিসবাহ-উল-হক। আগের দিনই উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারদের একজন মনোনীত হওয়ার খবর পেয়েছেন। পর দিনই জানিয়ে দিলেন বিদায়ের খবর। লাহোরে সাংবাদিক সম্মেলনে মিসবাহ্ জানিয়েছেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসছে টেস্ট সিরিজ খেলেই বিদায় জানাবেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে। বিদায়ের ঘোষণা দিয়ে মিসবাহ জানালেন, কোনো চাপে নয়, নিজেই নিয়েছেন এই সিদ্ধান্ত। ‘এটিই আমার শেষ সিরিজ, পিসিবি প্রধানকে সেটি জানিয়েছি। চেষ্টা করব, দারুণ কিছু করে বিদায় নিতে। আরব আমিরাতে ইংল্যান্ড সিরিজ শেষেই (২০১৫ সালের অক্টোবরে) আমি বিদায় নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিছু ব্যপার ছিল, যে কারণে খেলা চালিয়ে যেতে হয়েছে। এখন সব ঠিক আছে। আমাকে কেউ চাপ দেয়নি বা কিছু নির্দেশ দেয়নি। নিজেই উপলব্ধি করেছি, পুরোপুরিই নিজের সিদ্ধান্ত।’ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ যখন শেষ হবে, মিসবাহর বয়স তখন ৪৩ পূর্ণ হতে বাকি থাকব দুই সপ্তাহ। ১৯৪৮ সালে স্যার গাবি এলেনের পর এত বেশি বয়সে টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দেননি আর কেউ।২০০১ সালে নিউ জিল্যান্ডে টেস্ট ম্যাচ দিয়েই মিসবাহর আন্তর্জাতিক অভিষেক। পরে কয়েক দফায় খেলেছেন আরও চার টেস্ট, ওয়ানডেতেও ছিল আসা-যাওয়া। দল থেকে ছিটকেও পড়েন লম্বা সময়ের জন্য। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে পুনরুজ্জীবন ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে। টি- টোয়েন্টি থেকে ওয়ানডে ও টেস্ট, সব সংস্করণেই পাকা করেন জায়গা। ২০১০ সালে ফিক্সিং বিতর্কে জর্জরিত দুঃসময়ের মিসবাহকে দেওয়া হয় অধিনায়কত্ব। তার নেতৃত্বেই টালমাটাল সময়টা কাটিয়ে ওঠে পাকিস্তান। পাকিস্তান টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথমবার শীর্ষে ওঠে মিসবাহর নেতৃত্বেই। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে হোয়াইটওয়াশ করাসহ টেস্টে দল পেয়েছে অসাধারণ কিছু সাফল্য। ব্যাট হাতে নিজেও খেলেছেন দারুণ সব ইনিংস। গড়েছিলেন টেস্টে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডও। টি-টেয়েন্টিকে বিদায় জানিয়েছিলেন ২০১২ সালে। ২০১৫ বিশ্বকাপ শেষে ওয়ানডেকে।
এবার টেস্টের পালা। গত কিছুদিনে সাদা পোশাকে মলিন তার ও দলের পারফরম্যান্স। টানা ছয় টেস্ট হেরেছে পাকিস্তান। মিসবাহর ব্যাটেও নেই রানের সেই জোয়ার। তাই গুঞ্জন ছিল, বিদায়ের ঘোষণা আসছে যে কোনো সময়ই। এখনও পর্যন্ত টেস্ট খেলেছেন ৭২টি, রান ৪ হজার ৯৫১। ব্যাটিং গড় এক সময় ছিল পঞ্চাশের ওপর। গত কিছু দিনের রান খরায় সেটি নেমে হয়েছে ৪৫.৮৪। সেঞ্চুরি ১০টি, পঞ্চাশ ৩৬টি। পাকিস্তানকে সবচেয়ে বেশি ৫৩ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন মিসবাহ। সবচেয়ে বেশি জয়ও তার নেতৃত্বেই, ২৪টি। পাকিস্তানকে ১৫ টেস্ট জয়ে নেতৃত্বও দিতে পারেননি আর কেউ। শেষ সিরিজেও পাকিস্তানের একটি অপূর্ণতা ঘোচানোর মিশন নিয়ে যাচ্ছেন মিসবাহ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে পাকিস্তান টেস্ট সিরিজ জিততে পারেনি কখনোই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের যে দশা, তাতে এবার মিসবাহদের সুবর্ণ সুযোগ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ