বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

গুজরাটের মতো রামপালেও প্রকৃতি-মানুষের ওপর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে

 

* ২০ এপ্রিল মহাসমাবেশ --- আনু মুহাম্মদ *

* এটা ‘মানবতা-বিরোধী অপরাধ’ --- ডা. জাফরুল্লাহ*

স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে গুজরাটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে সৃষ্ট ‘ভয়াবহতা’ বর্ণনা করে বাংলাদেশের রামপাল একই ধরনের কেন্দ্র প্রকৃতি ও মানুষের ওপর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে মত দিয়েছেন ভারতীয় জ্বালানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সৌম্য দত্ত। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কার্বন নির্গমনের হার যথেষ্ট কম। কিন্তু রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র উচ্চহারে অ্যাসিডিক অক্্রাইড নির্গত করবে। একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলিয়ন টন পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত করে। যা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের মাটির অ্যাসিড মারাত্মকভাবে বাড়াবে।

গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের গুজরাটের মুন্দ্রা এলাকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সৃষ্ট প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে যাওয়া ইন্ডিয়া পিপলস সায়েন্স ফোরামের ন্যাশনাল জেনারেল সেক্রেটারি সৌম্য দত্ত এমন মন্তব্য করেন। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী সংগঠন ‘সুন্দরবনের জন্যে’ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। “সুন্দরবনস : গ্লোরী, দ্য প্রোটেক্টর অ্যান্ড রিস্কস টু ইটস সভরেন্টি” শীর্ষক এ আলোচনা অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন খন তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক বিদ্যুৎ সচিব আ ন আকতার হোসেন, জ্বালনি বিশেষজ্ঞ বি ডি রহমাতুল্লাহ, ড. সুজিত চৌধুরী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি আব্দুল হাই শিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তমিজ উদ্দিন খান, আরেক শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা, সেভ দ্যা সুন্দরবনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম, আয়োজক সংগঠনের সমন্বয়ক রিটা রহমান প্রমুখ।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করছে তেল-গ্যাস খনিজ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। এই দাবিতে তারা হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছে। বাম দলগুলোর পাশাপাশি পরিবেশবাদীদের একটি অংশের আশঙ্কা, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।

তবে সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বিভিন্ন বক্তব্যে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বরাবরই বলে আসছেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। তিনি রামপালবিরোধীদের ওই এলাকা ঘুরে দেখারও কথা বলেছেন। 

রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা আন্দোলনের সমর্থন জানিয়ে সৌম দত্ত বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনে মহা বিপর্যয় ডেকে আনবে। এর পাশাপাশি তার পক্ষ থেকে ভারতীয় সুন্দরবন অংশের কাছে এ ধরনের কোনো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের বেলাতেও ঠিক একই কারণে একই রকম জোরালো প্রতিবাদ জানানো হবে। তিনি বলেন, কেবল একটি রামপাল প্রকল্পই নয়, ওই এলাকায় যে দ্রুত হারে জমিদখল ও শিল্পায়ন ঘটছে। যার কারণে এই বিপর্যয়কে আরো ত্বরান্বিত করবে। 

অনুষ্ঠানে সৌম দত্ত সকলকে সর্তক করে দিয়ে বলেন, একবার ক্ষতিগ্রস্থ হলে সুন্দরবনের মতো এই জটিল প্রাকৃতিক বনকে আবার আগের অবস্থ্য়া ফিরিয়ে আনা দুরূহ। দরিদ্র ও প্রকৃতিনির্ভর লাখ লাখ মানুষের জীবিকা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং যে দেশ এখন পর্যন্ত নাগরিকের মৌলিক সুবিধাগুলোর ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছে,তার জন্য এ ধরনের প্রকল্প পাপের সমান।

সুন্দরবনের তুলনায় ছোট একটি ম্যানগ্রোভ বন মুন্দ্রায় রয়েছে জানিয়ে সৌম্য দত্ত বলেন, ২০০৯ সালে এই এলাকাতে টাটা পাওয়ার ও আদানি গ্রুপ দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে, এর দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে মুন্দ্রার ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের ৬০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যায়।

গবেষণায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভয়াবহ প্রভাব তুলে ধরে তিনি বলেন, ওই এলাকায় মাছ নেই, জলজ উদ্ভিদ পাওয়াই যায় না এমন, কোনো প্রাণ নেই সেখানে। শুধু তাই নয় আশপাশের ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার এলাকায় মাছের পরিমাণ ৬০ শতাংশ কমে গেছে।

সৌম্য বলেন, মুন্দ্রা এলাকা এর আগে সফেদা ফলের জন্য বিখ্যাত ছিল, কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব পড়েছে ফল উৎপাদনেও। ফলে কৃষকরা সরে আসছে সফেদা চাষ থেকে। এছাড়াও খেজুর চাষ ৫০-৬০ শতাংশ কমে গেছে। ভারতের সবচেয়ে বড় উপকূলীয় এলাকা গুজরাটের মুন্দ্রার শিশু ও বৃদ্ধরা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত দূষিত গ্যাসের কারণে শ্বাসকষ্টে ভুগছে বলেও জানান এই বিশেষজ্ঞ। তিনি আরো বলেন, গুজরাটের চেয়ে বাংলাদেশের সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের জীববৈচিত্র্য অনেক বেশি, এরকম একটি ‘সেনসিটিভ’ অঞ্চলে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। 

সৌম্য জানান, ভারতীয় অংশের সুন্দরবন, যা এরই মধ্যে উচ্চ পিএইচ মানের কারণে নৃতাত্ত্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এরই মধ্যে কয়লা ভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে তা আরও বেশি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে। এর ফলে সমুদ্রের নিকটবর্তী নদীর পানির অম্লতাও বৃদ্ধি পাবে, যা পটেনশিয়াল অব হাইড্রোজেন বা পিএইচ ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং বন ধ্বংসের মাত্রা বাড়িয়ে তুলবে।

ভারতীয় এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, বর্তমানে ভারতের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমতা ৪৪ হাজার মেগাওয়াট। ২০৩০ সালের মধ্যে এই ক্ষমতাকে ১ লাখ ৭৫ হাজার মেগাওয়াটে পরিণত করার টার্গেট নেয়া হয়েছে। ভারত ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সৌর জোটও গঠন করেছে। সৌরবিদ্যুতের খরচও দিনকে দিন কমে আসছে। যদি ভারত তার লক্ষ্য ৭০ শতাংশও অর্জন করতে পারে, তবে আগামী অন্তত ১৫ বছরের জন্য কোনো কয়লা, পারমাণবিক বা বৃহৎ বাঁধনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন হবে না। ২০২২ সাল পর্যন্ত ভারতের কোনো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রয়োজন নেই।

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতকেও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে মন্তব্য করে জনসমর্থন না থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের সরকার ‘কর্পোরেট কন্ট্রোলে’ এই ‘সুন্দরবন-বিনাশী প্রকল্প’ হাতে নিয়েছে বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, অনেকগুলো ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এখানে জড়িত আছে। শকুন যেভাবে অপেক্ষা করে গরু মরার জন্য তেমনি তারা অপেক্ষা করে আছে কখন সুন্দরবন মারা যাবে আর তারা জমি দখল করবে। খুলনাসহ উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে আগামী ২০ এপ্রিল মহাসমাবেশের ডাক দেন তিনি। 

আনু মুহাম্মদ বলেন, জনগণের দাবি মুখে সরকার ঠিকই বাধ্য হবে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে আসতে। তবে তখন হয়ত অনেক দেরি হয়ে যাবে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে ‘মানবতা-বিরোধী অপরাধ’ অভিহিত করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সরকার একদিকে আলো-বাতাস-পানি বন্ধ করে করছে, অন্যদিকে আমাদের কণ্ঠস্বর বন্ধের চেষ্টা করছে, এত সহজে আমাদের কণ্ঠস্বর বন্ধ করতে পারবে না। তিনি বলেন, নিজের কন্যাকে হত্যা করে কোন উন্নয়ন জনগণ মানবে না। যারা সুন্দবনের মত একটি প্রাকৃতিক সম্পদকে ধবংস করছেন তারা মানবতাবিরোধী কাজ করছেন। এদেরও বিচার হওয়া উচিত। 

আ ন আকতার হোসেন বলেন, ছোট বড় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এধরণের প্রকল্প জাতির জন্য কী ক্ষতিকর তা তুলে ধরতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে জাতির ক্ষতি করে কোনো প্রকল্প নেয়া যায় কি-না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ