মুসা অধ্যায় শেষ, এবার মেজর জিয়া-চকলেট’র পালা
তোফাজ্জল হোসেন কামাল : সিলেটের ‘আতিয়া মহল’ হালের আলোচিত এক বাড়ির নাম । টানা ১১১ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযান শেষে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা ওই বাড়িতে যে সফলতার রেশ টানে , তাতে জঙ্গিবাদের রাশটাও যেন টেনে অনেকটাই এগিয়ে নেয়া হলো । সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন নামের উগ্রবাদীরা দেশজুড়ে যে ভয়াবহ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের তৎপরতায় ভাটা টানতে যে অভিযান চলছে ,তার আরও একটা সফল সমাপ্তি ঘটেছে ওই আতিয়া মহলেই । অভিযান শেষে সেই মহলের ভেতর থেকে উদ্ধার করা চার জঙ্গির মধ্যে একজনের পরিচয় নিশ্চিতভাবে শনাক্ত হওয়ার পর জানা গেল তার নাম ‘মুসা’। যাকে আইনশৃংখলাবাহিনী দাবি করছে , নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে । কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে সংরক্ষিত মুসার ছবির সঙ্গে আতিয়া মহলে নিহত ওই জঙ্গির চেহারার মিল ধরেই তাকে ‘মুসা’ বলা হচ্ছে।
এই মুসা ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস । সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত মেজর জিয়ার হাত ধরে জঙ্গিবাদের দীক্ষা নেন তিনি। তাদের নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে ‘নব্য জেএমবি’ । আর এটিরই শীর্ষ নেতা মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা। অভিযানের আগে আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে তথ্য ছিল- আতিয়া মহলেই মুসা অবস্থান করছে। পুলিশের মতে, নব্য জেএমবির কয়েকজন শীর্ষ নেতা নিহত হওয়ার পর মুসা নব্য জেএমবিকে গোছানোর কাজে হাত দেয়।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলেন, মৃত এক জঙ্গির চেহারার সঙ্গে মুসার আগের ছবির মিল পাওয়া গেছে। এখন মুসার পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে তা মিলিয়ে দেখা হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সত্যিকার ভাবেই মুসা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে । এবার বাকী থাকলো সেই মেজর জিয়ার পালা।
জানা গেছে, গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর আশকোনার এক জঙ্গি আস্তানা থেকে চার মাসের শিশু সন্তানসহ গ্রেফতার করা হয় জঙ্গি মুসার স্ত্রী তিশামণিকে (২২)। ওই আস্তানায় অভিযানের আগেই মুসা পালিয়ে যায়। মিরপুরের রূপনগরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত মেজর জাহিদের হাত ধরে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে মঈনুল ইসলাম মুসা। মুসা উত্তরার লাইফ স্কুলে একসময় শিক্ষকতা করলেও পরে নব্য জেএমবিতে যোগ দিয়েছিল স্ত্রীসহ।
তবে মেধাবী ছাত্র মঈনুলের জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার খবরে হতবাক এলাকার মানুষও। গ্রামের মেধাবী ছাত্র মঈনুলকে তারা কেউ মুসা নামে চেনেন না। সেই মঈনুল যে নিউ জেএমবির নেতা মুসা সেটা তারা মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পেরেছেন। তিশার জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার খবরও একইভাবে জানতে পারেন স্থানীয়রা। গ্রামের সেই সাধারণ মেয়েটি জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিয়েছে- এটা বিশ্বাসই করতে পারছে না গ্রামের মানুষ।
বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের ইউনিয়নটির নাম গণিপুর। এ ইউনিয়নের বুজরুককোলা গ্রামের আবুল কামাল মোল্লার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বড় ছেলে মঈনুল ওরফে মুসা। মুসার মায়ের নাম সুফিয়া বেগম। কালাম মোল্লার দ্বিতীয় স্ত্রীর আরও তিন সন্তান রয়েছে। সুফিয়া বেগম জানান, পড়ালেখায় ছেলেটার (মুসা) মাথা ভালো ছিল বলে তার ওপর আমাদের অনেক আশা ছিল। এভাবে সে পথ হারাবে এটা আমরা কখনও ভাবিনি। মুসা জঙ্গি হয়ে যাবে একবারও ভাবিনি- আক্ষেপ করে বলেন মুসার মা। সুফিয়া বেগম আরও জানান, মঈনুলের স্ত্রী তিশামণি গর্ভবতী থাকাবস্থায় তিনি একবার ঢাকায় তাদের বাসায় গিয়েছিলেন। তখন তিশা মেজর জাহিদের কথা তাকে বলেছিল। জাহিদ খুব ভালো মানুষ আল্লাহওয়ালা বলেও তার কাছে বর্ণনা দেয় তিশা। কিন্তু সুফিয়ার দাবি, তিনি তখনও বুঝতে পারেননি তারা জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে।
গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাবা মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন। কিন্তু মঈনুল ইসলাম নিয়মিত নামায়ও পড়ত না একসময়। বাবা-মা ধর্মাচার পালনে তাকে তাগাদা দিতেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মেলামেশাও করত সে। আরও জানা গেছে, বাগমাবার মচমইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মঈনুল মাধ্যমিক ও তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় চলে যায় পড়াশোনা করতে। ঢাকা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে সে চাকরি নিয়েছিল শিক্ষকতার। বাড়িতে জানিয়েছিল ভালো বেতন। পরিবার থেকে সরকারি চাকরি খোঁজার কথা বলা হলেও মুসা বলেছিল এতেই বেতন ভালো। ঢাকায় প্রাইভেট পড়িয়ে ভালো আয় হবে। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি চাকরি পেয়ে বাড়িতে এসে বিয়ে করে পার্শ্ববর্তী বাসুপাড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদের মেয়ে তিশামণিকে। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে বাড়িতে এসেছিল সে। এরপর জানিয়েছিল বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে বাবার কিছু জমিও বিক্রি করে টাকা নিয়ে যায়। এরপর আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি পরিবারের সঙ্গে।
মুসার ভাই খাইরুল ইসলাম জানান, সর্বশেষ যখন বউ নিয়ে বাড়িতে আসে, তখন মঈনুলের আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন দেখেন তারা। ব্যাগভর্তি বইও সঙ্গে ছিল। কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলেনি। বাড়ির বাইরে কম যেত। একদিন সন্ধ্যার পর হঠাৎ করেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশে বের হয়ে যায়। এরপর থেকে আর ফোনও করেনি কোনোদিন। আমরা ভাবতাম বিদেশে চলে গেছে।
মঈনুল ওরফে মুসা ও তিশা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মোয়াজ্জেম হোসেন ভূঁইয়া বলেন, মুসা নামে মঈনুলকে তার গ্রামের লোকজন চেনে না। এটা হতে পারে তার সাংগঠনিক নাম। তবে আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পরপরই নাম দুটি জেলা পুলিশের কাছে আসে। আমরা বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। তবে তারা যেহেতু বেশ কয়েক মাস পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি সেহেতু বিষয়টি অনেকেই জানেন না। তবে এটা ঠিক মুসা বা তিশার পরিবারের কেউ আগে পুলিশকে তাদের নিখোঁজের তথ্য দেয়নি।
স্থানীয় গণিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মুসা সম্পর্কে বলেন, ‘ ছেলেটা তো খুব মেধাবী ছিল। লেখাপড়ায় খুব ভালো হওয়ায় অনেকেই বলতেন ম্যাজিস্ট্রেট হবে। তার পরিবারও তার ওপর ভরসা করত। কিন্তু মঈনুলের মুসা হওয়ার খবরটা জেনে খুব খারাপই লেগেছে। বিপথগামী হয়ে ছেলেটা এভাবে নিজেকে শেষ করে দেবে আবার পরিবারকেও হেয় করবে আমরাও ভাবিনি।’