বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ সৌন্দর্য হারাবে

# ৮ হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করে ৬০০ জনের কর্মসংস্থান?
আবু সাইদ বিশ্বাস, সুন্দরবন থেকে ফিরে : বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, জলবায়ু পরিবর্তন, ফারাক্কা বাঁধ, জলযান ও কিছু অসাধু মানুষের নানারকম অপকর্মের কারণে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন হারাতে বসেছে তার অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য। দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ সৌন্দর্য। বসবাসের অনুপোযোগী হবে গোটা দক্ষিণাঞ্চল।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে সুন্দরবন মানবিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হবে। ১৮৩০ একর ফসলী জমি অধিগ্রহণ করা হবে। ফলে ৮ হাজার পরিবার উচ্ছেদ হবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মসংস্থান হতে পারে সর্বোচ্চ ৬০০ জনের, ফলে উদ্বাস্তু এবং কর্মহীন হয়ে যাবে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ পরিবার। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর হারাবে কয়েক কোটি টাকার কৃষিজ উৎপাদন।
 ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ্বজুড়ে ধারাবাহিকভাবে চলছে দাবানল, ছাই-মেঘ, বন্যা, তুষারঝড়, ঝড়-জলোচ্ছ্ববাস ও শৈত্যপ্রবাহ। কয়েক বছর ধরেই পৃথিবীর বুকে আঘাত হানছে বৈরি আবহাওয়া। জলবায়ু বিষয়ক ফোর্থ অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট অন ইন্টার-গবর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট (আইপিসিসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা ২৭ থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার বেড়ে যাবে। যদি এ উচ্চতা ৬০ সেন্টিমিটার বাড়ে তবে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ ভূমি সাগরের পানিতে তলিয়ে যাবে।
সুন্দরবনের ৪ শতাধিক নদী, হাজার হাজার খালের অসহনীয় লবণাক্ততা, সিডর-আইলাসহ মনুষ্য সৃষ্টি নানা রকম দুর্যোগে গত ৪০ বছর ধরে নীরবে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবন। এদিকে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ। বর্তমানে সুন্দরবনে ঢুকলেই চোখে পড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব। ২০০৭ সালের সিডর ও ২০০৯ সালের আইলার ক্ষত এখনো মোছেনি সুন্দরবনের বুক থেকে। বনের অনেক জায়গায় পড়ে আছে শুকনো ও আধমরা সুন্দরী, গেওয়া, বাইনসহ নানা রকম গাছ। যে গাছগুলো দক্ষিণাঞ্চলের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সবসময় দাঁড়িয়ে থাকত মাথা উঁচু করে, কিন্তু সিডর ও আইলা কেড়ে নিয়েছে ওদের ডালপাতা, কিছু গাছ উপড়ে পড়েছে, আর কিছু শুকিয়ে গেছে। এই আধমরা গাছগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে হলেও প্রতিকূল জলবায়ু, সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি, অনেক খাল ও নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, কিছু নদীতে আবার লবণ পানির প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়া, বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে তা সফল হয়নি। তাই গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে আর সুন্দরবন হারাচ্ছে তার স্বাভাবিকতা। ধ্বংস হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সব প্রাণীকূলের সম্ভার।
পরিবেশবিদ ও জীববিদদের মতে, সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের একটি বড় অংশ ম্যানগ্রোভ বন। সারা পৃথিবীর ৩টি ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে সুন্দরবনের অবস্থান সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন যার আছে অপরিসীম নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যাকে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ১০ হাজার ২৮০ বর্গকিলোমিটারের এই বনে রয়েছে বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী হরিণ, ভয়ঙ্কর ও সুন্দর অজগর, কুমির, বানরসহ প্রায় ১ হাজার প্রজাতির পশু, সাড়ে তিনশত প্রজাতির পাখি, আছে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওরা, ধুন্দল, গোলপাতাসহ মনজুড়ানো ৩৫০ প্রজাতির গাছ।
বন বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এর মধ্যেই সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের সবচেয়ে গহিনে অবস্থিত মান্দারবাড়িয়া ক্যাম্প সমুদ্রবক্ষে হারিয়ে গেছে। যার অবস্থান ছিল বঙ্গোপসাগর থেকে মাইল কয়েক দূরে। মান্দারবাড়িয়ায় ছিল একটি মিষ্টি পানির পুকুর, যার পানি খেয়ে হাজার হাজার জেলে, বনরক্ষী, বাওয়ালী, মৌয়ালসহ ওই এলাকার বাসিন্দারা মিষ্টি পানির অভাব পূরণ করত। সুন্দরবনে মাছ ধরতে আসা জেলেদের মতে মান্দারবাড়িয়ার মিষ্টি পুকুরসহ সেখানকার ১৫-২০ কি.মি. এলাকা সমুদ্রগর্ভে ডুবে গেছে। এ ছাড়াও নদী ভাঙনের ফলে পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের হাজার হাজার খাল ও চার শতাধিক নদী। ফলে ভরা আমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভেসে গেলেও পথ না থাকায় ভাটার সময় সে পানি আর নামতে পারে না, যার ফলে সৃষ্টি হয় ভয়ঙ্কর লোনা পানির জলাবদ্ধতা। এর কারণে স্বভাবতই ম্যানগ্রোভ গাছ শ্বাস ছাড়তে না পেরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের অতন্দ্র প্রহরী সুন্দরী গাছ। দুবলারচর, আলোরকোল, মেহের আলীর চর, হিরোণপয়েন্টসহ কয়েকটি চরে শত শত গাছ মারা গেছে পরিবেশ বির্পয়ের কারণে। বনবিভাগের কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
বন রাণীর আদরের ধন গাজী, কালু, চম্পাবতী, মৌয়াল, বাওয়ালী, সুন্দরী, কুমির, বানর, হরিণ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বনমোরগসহ হাজার প্রজাতির প্রাণী আজ হুমকির মুখে। বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, “প্রায় ৪০বছর ধরে সুন্দরবনের এ ধ্বংসাত্মক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তবে তখন এ প্রবণতা ছিল ক্ষীণ। সুন্দরী গাছের প্রায় সবই কালো হয়ে মারা যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বনের প্রায় ৭৩ শতাংশ গাছই সুন্দরী গাছ। আর সুন্দরী ছাড়াও সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছ আছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ভূমিই গাছশূন্য মরুভূমিতে পরিণত হবে।”  সুন্দরী গাছের এ অকাল মৃত্যুর জন্য বিশেষজ্ঞরা এখানকার নদী ও বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা বাড়া এবং গঙ্গা নদীর উপর দেয়া ভারতের ফারাক্কা বাঁধকে দায়ী করেন। নদী বিশারদ ড. আইনুন নিশাতের মতে, ফারাক্কা বাঁধের পরই প্রথম খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। যেহেতু উজানের পানির সাথে এখন আর সুন্দবনের নদীগুলোর কোন সম্পর্ক নাই তবে বর্ষা মওসুমে মাথাভাঙ্গা ও জলাঙ্গী নদী থেকে সামান্য মিষ্টি পানি আসে। তাই ১৯৭৫ সালের পর থেকেই নিয়মিত বেড়ে চলেছে সুন্দরবনের লবণাক্ততা এবং নদীর পানিতে উচ্চমাত্রার এলকোহল পাওয়া গেছে। এছাড়াও মংলা বন্দর ও বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযোগ রক্ষাকারী বনের মধ্যে থেকে প্রবাহিত একমাত্র নদী পশুরের বুকে জেগেছে বিশাল চর যা সুন্দরবনের জন্য হুমকিস্বরুপ। দুবলার চর সংলগ্ন নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়াতে শত শত নৌকা নদীর মাঝখানে আটকে যেতে দেখা যায়। এমনকি এর প্রতিবেদক ও পায়ে হেঁটে নদীটি পার হন। সাগরের বুকে ছোট নদীগুলোর একই অবস্থা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ