শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ভাষা শহীদ দিবসে জনস্রোতে ভাসলো একুশে গ্রন্থমেলা

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার : “একুশ মানে স্মৃতি রক্ত ফাগুন দিন; একুশ মানে বুকের মাঝে বাংলা রাখার ঋণ, তাই একুশের আবেদন বাঙালির কাছে চির অমলিন।” প্রতি বছর একুশ আসে বাঙালির চেতনা ও শিল্প সত্তাকে নতুন করে আরেকবার শাণিত করতে। সঙ্গে যোগ হয় প্রাণের গ্রন্থমেলা। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। গৌরবময় মহান একুশের সূর্য উঠতেই বই মেলায় শুরু হয় দর্শনার্থীর আনাগোনা। একুশের চেতনার প্রতি সম্মান জানাতে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টায় বইমেলার দ্বার খুলে দেয়া হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে জনস্রোতে ভাসে বইপ্রেমী দর্শনার্থী পাঠক সমাগমের বইমেলা।
সকালে রাজধানীবাসীর সকলের গন্তব্যস্থল ছিল শহীদ মিনার। এরপর হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদন শেষে তারা ছুটে আসেন বইমেলায়। সারাদিনই লেখক-পাঠক-প্রকাশকের পদচারণায় মুখর ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলার দু’প্রাঙ্গণ। ভাষা শহীদদের স্মরণে আয়োজিত বইমেলার ভিড় শুধু মেলা প্রাঙ্গণেই নয়। আছড়ে পড়ে আশেপাশের সব এলাকায়। শাহবাগ থেকে শুরু হয় মেলামুখী মানুষের ঢল। অপর প্রান্ত দোয়েল চত্বরেও ছিল একই চিত্র।
দীর্ঘসময় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সবাই প্রবেশ করতে থাকেন বইয়ের জগতে। তাদের এই আগমন-প্রস্থানে মাঝখানের সময়টুকুই চিরচেনা জোয়ারে রুপ নেয় ভাষার চেতনায় উজ্জীবিত প্রাণের মেলা। ক্ষণে ক্ষণে মেলাজুড়ে ভেসে আসতে থাকে কালজয়ী গানের সুর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। এ সুর যেনো বইমেলায় একুশের চেতনাকে আরও জাগ্রত করে। আরও বাড়িয়ে দেয় ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও আবেগ।
শুধু একুশের এ গানে-সুরে নয়, এদিন মেলায় আগতদের পোশাক ও শরীরেও ছিল একুশের আবহ। একুশের সাজে সজ্জিত প্রায় সবাই। বর্ণমালা লেখা বাহারি কাপড়, কালোশাড়ি, পাঞ্জাবি ও ফতুয়া পরে মেলায় আসেন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ। চেতনার উচ্ছ্বাসে ছোট-বড় অনেকেই হাত ও মুখকে বানিয়ে তুলেছিলেন রঙিন এক ক্যানভাস। সে ক্যানভাসে ছিল সাদা, লাল আর হলুদ রঙের ‘অ’,‘আ’, ‘ক’ ‘খ’ সহ নানা বর্ণমালা। কেউবা শরীরে আঁকেন শুধুই ২১, কারও টি-শার্টের বুক বরাবর ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরের প্রতিকৃতি। বাদ যাননি ছোট শিশুরাও। তাদের গালে-কপালে আঁকা জাতীয় পতাকা ও শহীদ মিনারের প্রতীক। অনেকের বুকে সাঁটা ছিলো কালো ব্যাজ।
মেলায় বাড়লো বেচাকেনা: এদিকে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে মেলায় বাড়তি মানুষের সমাগমে বেচাকেনা বেশি হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রায় সকল স্টলগুলোতেই দেখা গেছে বইপ্রেমীদের ভিড়। ছোট-বড় বেশিরভাগ মানুষের হাতেই ছিল একটা দুইটা বইয়ের প্যাকেট। একুশের চেতনায় প্রিয়জনকে একটি সুন্দর বই উপহার দিতেও এসেছেন অনেকে। তবে অনেক প্রকাশকরাই জানান, এ রকম ভিড়ে বিক্রির চেয়ে ঘোরাঘুরিই বেশি হয়। তারপরও বেচা-কেনাও নেহাত কম হয়নি।
 কেমন হলো একুশের দিনের বেচাকেনা? উত্তরে উৎস প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মোস্তফা সেলিম বলেন, ভিড় যতই বেড়েছে বিক্রিও ততই বেড়েছে। তবে এ দিন শুধু বই কেনাবেচার না। একুশের চেতনায় নিজেকে শাণিত করতে মেলায় আসেন অনেকে। এও বা কম কিসের?
একই সুরে সুর মেলালেন অনন্যার মনিরুল হক। তিনি বলেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনির কড়াকড়ির কারণে সকালে দিকে মানুষ মেলায় ঢুকতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে দুপুরের পর থেকেই মূলত মেলা তার স্বরূপ ফিরে পেয়েছে। ভিড়ের সঙ্গে সঙ্গে বিক্রিও বেড়েছে।
সপরিবারে মেলায় এসে অনেকগুলো বই কিনেছেন সরকারি চাকরিজীবী মাযহারুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে। সবার পরনেই ছিলে একুশের ছাপ লাগানো পোশাকের বাহার। তারা কিনেছেন কিশোর উপন্যাস ও সাইন্স ফিকশনের ৬টি বই। জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক ভিড় হবে এটাতো জানা কথা। দীর্ঘ লাইন ধরে ঢুকতে হল। তার পরও এলাম। কারণ ছেলেমেয়েদের মাঝেও একুশের চেতনা জাগ্রত হোক এবং সেই সঙ্গে ওদের মাঝে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হোক।
মেলাজুড়ে বাড়তি নিরাপত্তা: এদিকে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি মেলার জনসমাগমকে মাথায় রেখে প্রবেশপথ ও মেলা প্রাঙ্গণজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি নিরাপত্তা দেখা যায়। টিএসসি ও দোয়েল চত্বর এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা আটকে দেওয়া হয়। পায়ে হেঁটে প্রবেশের জন্য রাস্তার খানিকটা খুলে রাখা হলেও সার্বক্ষণিক নজরদারিতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা প্রবেশপথ রাখা হয়েছে। সবাইকে আর্চওয়ের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। এছাড়া মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি করে পুলিশ। দর্শনার্থীদের প্রতিটি ব্যাগ তল্লাশি শেষে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়।
পুলিশ ও র‌্যাবের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, এবারের মেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মেলার নিরাপত্তায় পুলিশের ৫টি ওয়াচ টাওয়ার থেকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হয়। মেলা প্রাঙ্গণ ও এর আশেপাশে মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। মেলার নিরাপত্তায় দোয়েল চত্বর থেকে শুরু করে শামসুন্নাহার হল পর্যন্ত রাস্তায় ২৫০টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো হয়। বাংলা একাডেমি, শাহবাগ থানা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত তিনটি কন্ট্রোল রুম থেকে এসব ক্যামেরা মনিটরিং করা হয়।
এছাড়া জানা গেছে, মেলার প্রবেশপথে ২২টি আর্চওয়ে রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনা কালীমন্দির লাগোয়া অংশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বাড়তি নজরদারি করা হয়।
২১তম দিনে নতুন বই ২৬১টি : অমর একুশে বই মেলার ২১তম দিনে নতুন বই এসেছে ২৬১টি। এর মধ্যে ৪৩টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। এদিন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী মেলায় নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের পাশাপাশি গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে ১২০ জন নবীন-প্রবীণ কবি কবিতা আবৃত্তি করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন কবি মোহাম্মদ সাদিক।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ