বাংলা ভাষার চর্চা ও পরিভাষা প্রসঙ্গ
অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান : আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষার প্রতি রয়েছে আমাদের আবেগমিশ্রিত ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা। মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে কোনো মানুষ বা জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে বৌদ্ধ পাল শাসনামলে। ব্রাহ্মণ সেন আমলে এ ভাষা চর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষার পুনর্জন্ম ঘটে এবং রাজ-পৃষ্ঠপোষকতায় এ ভাষার বিকাশ ঘটে। এ সময় আরবি-ফারসি-উর্দু-তুর্কি বিভিন্ন ভাষার অসংখ্য শব্দরাজিও বাংলাভাষায় অনুপ্রবিষ্ট হয়ে একে উন্নত ও সমৃদ্ধ করে। অতএব, বাংলা ভাষা মূলত মুসলমানদের হাতেই লালিত ও উৎকর্ষম-িত। বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ বাংলা ভাষা। তাছাড়া, ‘বাংলা ভাষা সংস্কৃতের দুহিতা’ এটা এক অযৌক্তিক প্রচারণা। এর গোড়ার ইতিহাসটি কমবেশি সকলেরই জানা।
বৃটিশ আমলে ইংরাজ রাজকর্মচারীদের শাসন-শোষণ চালানোর সুবিধার্থে তাদেরকে বাংলা শেখানোর উদ্দেশ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয় (১৮০০ খৃ.)। শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কলেজের শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ ইংরাজ পাদ্রী ও সংস্কৃত ব্রাহ্মণ প-িতগণ গ্রন্থাদি রচনা করেন। প্রচলিত বাংলা ভাষায় তখন আরবি-ফারসি-তুর্কি-উর্দু প্রভৃতি ভাষার অসংখ্য শব্দ থাকায় সংস্কৃত প-িতগণ সেটাকে ‘যবন ভাষা’ হিসাবে অভিহিত করেন। যবন ভাষা ছিল তাদের নিকট ‘অচ্ছূত’ বা ‘ঘৃণ্য’। এজন্য তারা আরবি-ফারসি-তুর্কি-উর্দু প্রভৃতি শব্দরাজি বর্জন করে দুর্বোধ্য ও অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ দিয়ে এক কৃত্রিম বাংলা ভাষা তৈরি করে তার নাম দেন ‘সাধু বাংলা’। এভাবে সংস্কৃত শব্দরাজিতে আকীর্ণ সাধু বাংলাকে তারা ‘সংস্কৃতের দুহিতা’ বলে আখ্যায়িত করেন। এটা এক ধরনের কৃত্রিম প্রক্রিয়া। সংস্কৃত কোনোকালেই বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎপন্ন নয়।
বাংলার আদিবাসী ছিলেন দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত অনার্য। আর্যরা বাংলার আদিবাসী নয়। তাদের মূল বসতি মধ্যপ্রাচ্যে। পরবর্তীতে তারা দাক্ষিণাত্য ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসতি গড়ে তোলে এবং সেখান থেকে কালক্রমে বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করে এবং বাংলায় শাসনকার্য পরিচালনা করলেও তখন রাজ-দরবারের ভাষা ছিল সংস্কৃত। রাজসভার সভাসদবৃন্দ সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতেন। দেশীয় বাংলা ভাষাকে তারা ‘ইতর’ বা ‘পক্ষী’ ভাষা বলে অভিহিত করেন এবং এ ভাষার চর্চাকে ‘রৌরব’ নামক নরকবাসের উপযোগী অপরাধ বলে গণ্য করেন। এককথায়, দেশীয় ভাষাকে তারা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। এ ভাষার সাথে সংস্কৃতের সংযোগ-সম্পর্ক স্থাপনের কোন অবকাশ তখন ছিল না। অতএব, বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন হওয়াও সম্পূর্ণ অসম্ভব। তবে অন্য সকল ভাষা থেকে যেমন অসংখ্য শব্দ কালক্রমে বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত হয়েছে, সংস্কৃত ভাষারও বহু শব্দ সেভাবে বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত হয়েছে। বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত সংস্কৃত ভাষার এসব শব্দাবলী ‘তদ্ভব’ ও ‘তৎসম’ নামে পরিচিত। অন্যভাষা থেকে আত্তীকৃত শব্দাবলী ‘বিদেশী শব্দ’ নামে পরিচিত।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে বৌদ্ধপাল যুগে (৭৫০-১১৬২)। তখন এ অঞ্চলে যে ভাষা প্রচলিত ছিল, তার নাম অপভ্রংশ। অপভ্রংশ ভাষার তিনটি শাখাÑ গৌরি, মাগধি ও শৌরসেনি। মাগধি থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি বলে প-িতদের ধারণা। তখন এ ভাষার শব্দ সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমিত। পাল আমলের অবসানে সেন রাজবংশের রাজত্ব শুরু হয়। তখন এ ভাষার চর্চায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় এর কোন বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধিত হয়নি। তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের (১১৯৯-১২০৪) পর বাংলা ভাষার নবজন্ম ঘটে। বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা করার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। মুসলিম রাজা-বাদশা-নবাবগণের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালি বাংলা ভাষা-সাহিত্যের চর্চায় মনোনিবেশ করেন। কিন্তু এসময় বাংলা ভাষা দীর্ঘকাল চর্চার অভাবে অত্যন্ত দীন-হীন অবস্থায় ছিল। ফলে শাসকশ্রেণির ভাষা আরবি-ফারসি-তুর্কি ইত্যাদি ভাষা থেকে অসংখ্য শব্দরাজি বাংলা ভাষায় অনুপ্রবিষ্ট ও আত্তীকৃত হয়। এভাবে বাংলা ভাষা রাতারাতি অতিশয় সমৃদ্ধ ও বিচিত্র ভাব প্রকাশের উপযোগী হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার এ সমৃদ্ধ ও উৎকর্ষম-িত নবরূপ মুসলমানদের হাতেই গড়ে ওঠে। অতএব, বাংলা ভাষার নবজন্ম ও বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধিসাধনে বাঙালি মুসলিমের অবদান অনন্যসাধারণ।
ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে আরবি-ফারসি-তুর্কি ইত্যাদি যদিও বিদেশী শব্দ কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ওগুলো সাধারণ মানুষের একান্ত পরিচিত, বোধগম্য ও অনেক ক্ষেত্রে অপরিহার্য রূপে বিবেচিত হয়। উদাহরণত বলা যায়, বাঙালি মুসলিম সমাজে ইসলামী পরিভাষা হিসেবে প্রায় আড়াই হাজার আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ শব্দগুলো বাঙালি মুসলিম সহজে ব্যবহার করে, এর অর্থও তাদের নিকট অতি সহজবোধ্য। এসব শব্দ এত তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ বহন করে যে, এসব ব্যতিরেকে যথার্থ ভাব প্রকাশ সম্ভব নয়। তাই প্রায় হাজার বছর ধরে এসব শব্দ আমাদের কথ্য ও লেখ্য ভাষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষত ধর্মীয় পরিভাষা হিসেবে গণ্য অসংখ্য আরবি-ফারসি শব্দ বাঙালি মুসলিম সমাজে দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে সহজেই তা বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত হয়ে গেছে। এসব শব্দ বাঙালি মুসলমানের নিকট একান্ত সুপরিচিত, বোধগম্য ও নিত্য ব্যবহার্য। তাই এগুলোকে কোনভাবেই বিদেশী শব্দ রূপে গণ্য বা বর্জন করা সম্ভব নয়। উপরন্তু এসব শব্দ ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির পরিচিতিমূলক অপরিহার্য শব্দরাজিতে পরিণত হয়েছে। এসব শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথে একটি বিশেষ সংস্কৃতির প্রতিবিম্ব চোখের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার মুসলমানী ঢং, ইসলামী বিশ্বাস ও জীবনবোধের একান্ত অনুষঙ্গ হিসেবে এসব শব্দের ব্যবহার দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। মূলত বাঙালি মুসলমানের বিশ্বাসের উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে চলেছে এ আরবি-ফারসি শব্দ মিশ্রিত মুসলমানী ঢং-এর ভাষা। তাই এ ভাষা বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে চলেছে।
মুসলিম শাসনামলের পূর্বে এদেশে রাজকার্য-প্রশাসনিক ও ভূমি-ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত পারিভাষিক শব্দ ছিল না বললেই চলে। মুসলিম শাসকগণ শাসনব্যবস্থাকে সুসংহত ও সুশৃঙ্খল করার উদ্দেশ্যে এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার ও প্রচলন করেন। বাংলা ভাষায় এসব শব্দ না থাকায় স্বভাবতই তারা তাদের মাতৃভাষা আরবি-ফারসি-তুর্কি-উর্দু ভাষার শব্দসমূহ ব্যবহার করেন। কালক্রমে এবং সঙ্গত কারণেই এসব পারিভাষিক শব্দ বাংলা ভাষায় অনুপ্রবিষ্ট ও আত্তীকৃত হয় এবং সাধারণভাবে বাংলা ভাষার অপরিহার্য সম্পদে পরিণত হয় এবং বহুদিনের ব্যবহারে এগুলো বাঙালি মুসলমানের নিজস্ব শব্দ-সম্ভারে পরিণত হয়। অতএব, শাসনকার্য, ভূমি-ব্যবস্থাপনা, আইন-আদালত ও বিচারিক ক্ষেত্রে প্রচলিত শব্দসমূহ প্রায় সবই আরবি-ফারসি ভাষা থেকে গৃহীত। অদ্যাবধি তা প্রচলিত রয়েছে। এর কোন বিকল্প বা পরিভাষা তৈরির প্রয়োজনীয়তা পূর্বেও কখনো উপলব্ধি হয়নি, এখনও তার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে কেউ চিন্তা করে না। এসব শব্দ সর্বসাধারণ বাঙালি হরহামেশা এন্তার ব্যবহার করে বলে তা বাংলা ভাষার সাধারণ শব্দ-সম্পদে পরিণত হয়েছে।
ইংরাজ আমলেও কিছু কিছু ইংরাজি, পর্তুগীজ ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। এভাবে পরিগ্রহণ ও আত্তীকরণের দ্বারা বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত হয়েছে। পৃথিবীর তাবৎ উন্নত ভাষাসমূহের উন্নতির মূলেই এধরনের প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল। বাংলা ভাষার দেশীয় ঐতিহ্যের সাথে আরবি-ফারসি-তুর্কি-উর্দু ভাষার এবং পরবর্তীতে ইংরাজ ঐতিহ্যের অনেকটা মেলবন্ধন ঘটেছে। এ যোগসূত্র একদিনে বা আকর্ষিকভাবে ঘটেনি, যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায়, নানাভাবে এটা সংঘটিত হয়েছে। এ প্রক্রিয়া সর্বত্র সবসময়ই কমবেশি অব্যাহত রয়েছে। এটাকে প্রতিরোধ করার অপচেষ্টা হাস্যকর। তবে নতুন পরিভাষা সৃষ্টির প্রয়োজন যে একেবারে নেই, তা বলা যায় না এবং সে প্রয়োজন আছে বলেই বাংলা একাডেমি তার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পরিভাষা তৈরির কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষত, পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয় বাংলায় পড়ানোর জন্য পরিভাষা তৈরি করা হয়েছে। এ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে এবং দিন দিন এর কর্মপরিধি আরো বিস্তৃত হবে বলে আশা করা যায়।
তবে সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের জুজুর ভয় থাকে। বর্তমানে আমাদের রহঃবষষবপঃঁধষ বা বুদ্ধিজীবী মহলে পরিভাষা সৃষ্টির নামে এক ধরনের অদ্ভূত প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিভাষার নামে এমন কিছু ইসলামী পরিভাষার বাংলাকরণের অপপ্রয়াস চলছে, যা অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্ছিত এবং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনষ্ট করার শামিল। প্রাত্যহিক জীবনে আমরা অনেক ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করি, যার বিশেষ অর্থ ও তাৎপর্য রয়েছে। এর অনুবাদ বা ভাষান্তর সম্ভব নয়, সঙ্গতও নয়। অনেক ক্ষেত্রে ভাষান্তর করলে এর আসল অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করা কঠিন বা ভিন্নতর হয়ে পড়ে। তাই আবহমান কাল থেকে এসব শব্দ অবিকৃতভাবে বাঙালি মুসলিমের নিজস্ব শব্দ-সম্পদে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া, এসব শব্দ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যেমন এক স্বতন্ত্র ইসলামী ঐতিহ্যের রূপায়ন ঘটিয়েছে, তেমনি আমাদের সামাজিক জীবনেও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুস্পষ্ট নিদর্শন হয়ে আছে।
কিন্তু সম্প্রতি একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী এসব শব্দের তাৎপর্য উপলব্ধি না করে এর বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহারের অপচেষ্টা শুরু করেছেন। এসব শব্দ বর্জন বা এগুলোর প্রতিশব্দ ব্যবহারের অপচেষ্টা আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিনষ্টের দুরভিসন্ধিমূলক অপপ্রয়াস। যেমন ‘আল্লাহ্’ শব্দটি আরবি এবং ইসলামের একটি বিশেষ পরিভাষা। এর প্রতিশব্দ হিসাবে ইংরাজিতে ‘গড’, বাংলাতে ‘ঈশ্বর’, ‘ভগবান’, ‘বিধাতা’ ইত্যাদি শব্দ রয়েছে। কিন্তু ‘আল্লাহ’ শব্দের যে অর্থ ও তাৎপর্য তা এর কোন একটি শব্দের দ্বারাও সম্যক উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ‘আল্লাহ’ শব্দের লিঙ্গ ভেদ বা বচনভেদ নেই, এটা একটি মৌলিক শব্দÑ কোনভাবেই যা ভাষান্তরিত করা সম্ভব নয়। উল্লিখিত শব্দসমূহের লিঙ্গভেদ ও বচনভেদ আছে। কিন্তু ‘আল্লাহ্’ শব্দের কোন প্রতিশব্দ, অনুবাদ, বা বিকল্প নেই। ‘আল্লাহ্’ শব্দের সাথে ‘তৌহিদ’ শব্দের যে অর্থ ও তাৎপর্যগত সম্পর্কÑ তাও ‘আল্লাহ্’ শব্দের বিপরীতে যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয় সেগুলোর দ্বারা সম্যক অর্থ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বরং অন্য সব শব্দ তৌহিদের বিপরীতÑ শির্কের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কারণ সে সব শব্দের বহুবচন করা যায়। কিন্তু আল্লাহ্ শব্দটি সর্বদা একবচন এবং বহুবচন এর অর্থ ও তাৎপর্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। অতএব, তৌহিদে বিশ্বাসী কোনো মানুষেরই ‘আল্লাহ’ শব্দের কোনো বিকল্প খোঁজা অনুচিত। ঈশ্বর, ভগবান, গড ইত্যাদি যেকোন শব্দের মধ্যেই শিরক্-এর উপাদান রয়েছে। তাই এসব শব্দ বর্জন এবং আল্লাহ্ শব্দ উচ্চারণ করা ঈমানের দাবী। কোনো মুসলিমের পক্ষে আল্লাহ্ শব্দের বিকল্প খোঁজা অনুচিত।
ইসলামের পরিভাষামূলক এরূপ অনেক শব্দ রয়েছে যার সাথে ইসলামী ধারণা-বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ আরো কয়েকটি শব্দের উল্লেখ করা যায়। যেমন, ইবাদত, ইন্তিকাল, ওজু, ওহী, কুরবানী, জিহাদ, তওবা, তৌহিদ, দ্বীন, মরহুম, মাগফিরাত, মে’রাজ, মেহরাব, মুসলিম, রব, রাসূল, সওম, সালাত, শহীদ, দাফন-কাফন ইত্যাদি। এসব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ বা অর্থবোধক শব্দ আজকাল ব্যবহার করার অপপ্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু উপরোক্ত শব্দসমূহে যে ধর্মীয় তাৎপর্য ও বিশেষ ইসলামী ধারণা-বিশ্বাস বিদ্যমান তা এর বাংলা প্রতিশব্দে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যেমন ‘ইবাদত’ শব্দের অর্থ পূজা, উপাসনা ইত্যাদি, ‘ইন্তিকাল’ শব্দের অর্থ মৃত্যু, দেহত্যাগ ইত্যাদি, ‘মরহুম’ শব্দের অর্থ প্রয়াত, ‘ওহী’ শব্দের অর্থ প্রত্যাদেশ, ‘ওজু’ শব্দের অর্থ হস্ত-পদ ধৌতকরণ বা প্রক্ষালন, ‘কুরবানী’ শব্দের অর্থ ‘পশু হত্যা’, ‘জিহাদ’ শব্দের অর্থ ধর্ম-যুদ্ধ, ‘তৌহিদ’-এর অর্থ একেশ্বরবাদ, ‘দ্বীন’-এর অর্থ ধর্ম, ‘মাগফিরাত’-এর বাংলা প্রতিশব্দ করা হয় স্মৃতি-তর্পণ। ‘রোযা’ বা ‘সওম’-এর অর্থ বা প্রতিশব্দ করা হয় উপবাস, ‘শহীদ’-এর অর্থ জীবনদান, ‘দাফন-কাফন’-এর পরিবর্তে বলা হয় মৃতের সৎকার ইত্যাদি। এসব প্রতিশব্দ বা অর্থের দ্বারা ইসলামের যে বিশেষ তাৎপর্য ও ভাব-সঙ্গতি তা রক্ষিত হয় না।
উপরোক্ত আরবি শব্দসমূহে ইসলামের ধারণা-বিশ্বাসের যেমন প্রতিফলন ঘটে, তেমনি ইসলামের ধর্মীয় তাৎপর্য ও সংস্কৃতির পরিচয়ও বিধৃত হয়। তাই সেগুলোর অনুবাদ বা প্রতিশব্দের দ্বারা ইসলামী জীবনবোধ ও সংস্কৃতির পরিচয়কে বিকৃত করা হয়। তাছাড়া, উপরোক্ত পরিভাষাসমূহের অনুবাদ বা প্রতিশব্দ খোঁজার আদৌ প্রয়োজন আছে কি? এ শব্দগুলো বাঙালি মুসলিমের নিকট সুপরিচিত এবং ব্যবহারিক জীবনে তারা এগুলো সহজ স্বাভাবিকভাবে হরহামেশাই ইস্তিমাল করে। উপরোক্ত পরিভাষাসমূহ বিশেষ অর্থবোধক ও তাৎপর্যবহ। এর সাথে ইসলামের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও কোন কোন ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জড়িত। যেমন ‘ইবাদত’ শব্দের দ্বারা পূজা-অর্চনা-উপাসনা নয়, বরং এর প্রকৃত অর্থ আল্লাহর আনুগত্য করা। এ আনুগত্য শুধু নামায, রোযা, হজ্ব-যাকাতের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের সকল ক্ষেত্রে, সকল কাজ-চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণে আল্লাহর হুকুম পালন করে মুসলমানগণ ইবাদতের হক আদায় করে থাকে।
এভাবে ‘ওহী’র অর্থ শুধু প্রত্যাদেশ নয়, স্রষ্টার পক্ষ থেকে তাঁর নবী-রাসূলের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য যে শাশ্বত নির্দেশনা বা হুকুম-আহ্কাম অবতীর্ণ হয়েছে, তার নাম ওহী বা ওয়াহী। ‘ওজু’ও তেমনি নিছক হাত-পা ধৌত বা প্রক্ষলন করা নয়, মহান প্রভুর সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়ার জন্য দৃঢ় সংকল্প ও পবিত্র ইরাদা নিয়ে নির্দিষ্ট নিয়মে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিষ্কার-পরিছন্ন করার নাম ওজু। ‘ইন্তিকাল’-এর যথার্থ অর্থ স্থানান্তর, ইহলোক থেকে পরলোক বা আখিরাতে গমন। এর সাথে আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং জীবনের শেষ পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা সংশ্লিষ্ট। ‘মাগফিরাত’-এর বাংলা প্রতিশব্দ করা হয় স্মৃতি-তর্পণ বা স্মৃতিচারণ। অথচ মাগফিরাত অর্থ মৃত ব্যক্তির রূহের শান্তি কামনায় দোয়া-খায়ের করা বুঝায়, বাংলা প্রতিশব্দে তা বুঝায় না। ‘মরহুম’ শব্দের অর্থ স্থানান্তর। এ শব্দের অর্থ ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত। কারণ ‘আখিরাত’ বা মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রতি বিশ্বাস ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। রূহের মৃত্যু নেই, মাটির তৈরি দেহকে ধারণ করে নশ্বর পৃথিবীতে রূহ কিছুদিনের জন্য পৃথিবীতে অবস্থান করে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষ আখিরাতে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু প্রয়াণ শব্দের দ্বারা উপরোক্ত অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করা কঠিন।
এভাবে প্রতিটি ইসলামী পরিভাষার একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ, তাৎপর্য ও সাংস্কৃতিক দিক রয়েছে, যা বাংলা প্রতিশব্দে ঠিকমতো প্রকাশ পায় না। তাই এসব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার বা অনুসন্ধান করা অযৌক্তিক। এর মধ্যে বাঙালিত্বের প্রতিষ্ঠা নয়, বরং ইসলামী সংস্কৃতির পরিচয় মুছে ফেলার হীন প্রচেষ্টা বিদ্যমান। যে শব্দ বিদেশী এবং যার অর্থ বোধগম্য নয়, শুধু সে শব্দেরই অনুবাদ বা প্রতিশব্দ তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু উপরোক্ত শব্দসমূহ আরবি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুপ্রবিষ্ট হলেও দীর্ঘকাল ধরে বহু ব্যবহারের ফলে তার অর্থ ও তাৎপর্য বাঙালি মুসলমানের নিকট একান্ত সহজ স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। অতএব, এসব শব্দকে বিদেশী শব্দ বলা যেমন সঙ্গত নয়, তেমনি এর প্রতিশব্দ অনুসন্ধান করাও অসঙ্গত।
ভাষার ব্যবহার সর্বব্যাপক। ভাষা আমরা কেবল দৈনন্দিন জীবনে অন্য মানুষের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করি তাই নয়; আমাদের সৃষ্টিশীল সকল কাজের মাধ্যম ভাষা। রাজনৈতিক-সামাজিক জনমত গঠনে, অর্থনৈতিক-কারিগরি অভিজ্ঞান অর্জনে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিবিধ প্রয়োগ ও আবিষ্কারে, ধর্মীয় বা অন্যান্য সব মতবাদ ও আদর্শ প্রচারে ভাষা অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম। জীবনের সকল স্তরে, সমাজ ও জগতের সকল ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার ও উপযোগিতা অবশ্যম্ভাবী। মানব-সভ্যতার উন্মেষ, বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে ভাষার অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে। ফলে যেদেশ বা জাতি তার ভাষার চর্চায় পশ্চাৎপদ, সেদেশ বা জাতি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে অক্ষম। তাই ভাষার যথাযথ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ চর্চা ও উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমেই কোনো দেশ বা জাতির উন্নতি বহুলাংশে নির্ভরশীল।
বর্তমান বিশ্বে ভাষার বিচিত্র ব্যবহার ও কার্যকারিতা দেখে আমরা বিস্ময়বোধ করি। আটপৌঢ়ে জীবনে সাধারণ ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি বিভিন্ন পরিবেশে, বিভিন্ন রুচি ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে মুখের ভাষাই সর্বত্রগামী হতে পারে। ভাষা পৃথিবীর বিচিত্র বিষয় ও জ্ঞানকে ধারণ করে মহাসমুদ্রের ন্যায় বিশালত্ব অর্জন করতে পারে। এ মহাজ্ঞান-সমুদ্রের সান্নিধ্যে জীবন উৎকর্ষম-িত হয়, নানাভাবে হয় ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ। এ জ্ঞান চর্চার সহজতর ও কার্যকর মাধ্যম ভাষা। তাই ভাষার মূল্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা ব্যতীত জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-শিল্পকলার চর্চা অসম্ভব। ভাষা ব্যতীত সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশও কল্পনা করা যায় না। সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের মূলে ভাষা। মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো মাখলুকের ভাষা নেই। ফলে মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো মাখলুকের সভ্যতাও নেই।
ভাষা মানুষের জীবনে মহামহিম স্রষ্টার এক বিস্ময়কর অবদান। জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে, মানব-সভ্যতার ক্রম-বিকাশে, পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠির পারস্পরিক জানাশোনা, আদান-প্রদান ও পরিচিতির ক্ষেত্রে ভাষা এক অতি কার্যকর, সহজ, স্বাভাবিক মাধ্যম। এ বিশাল পৃথিবীতে যেমন রয়েছে অসংখ্য জনগোষ্ঠী, গোত্র, বর্ণ, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও চিন্তা-মতাদর্শগত পার্থক্য তেমনি তার সাথে রয়েছে শত-সহস্র ভাষা ও বর্ণলিপির বৈচিত্র্যময় অস্তিত্ব। মানবজাতি ও সভ্যতার অগ্রযাত্রা ও ক্রমবিকাশে ভাষার অবদান বিস্ময়কর। ভাষা ব্যতীত মানব সভ্যতার বিকাশ ও অগ্রযাত্রা কখনো সম্ভব হতো না।
ভাষার আসল সম্পদ শব্দ। যে ভাষা যত অধিক শব্দ-সম্পদে বিভূষিত, উচ্চারণে ও শ্রবণে যত অধিক ললিত-মধুর, যত অধিক বিচিত্র ভাব প্রকাশে এবং যত বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে তা প্রকাশে সক্ষম, সে ভাষা তত বেশি সমৃদ্ধ ও উন্নত। আর এতেই ভাষার প্রাণশক্তি ও সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে। ভাষার আহরণ বা স্বীকরণশক্তিও এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তাই নতুন শব্দ-সম্পদ সৃষ্টি ও অন্য ভাষা থেকে আহরিত শব্দরাজিকে নিজস্ব শব্দভা-ারে স্বী-কৃত বা আত্তীকৃত করে নেয়ার মধ্যে ভাষার প্রাণশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কোর এক জরিপে জানা যায়, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার ভাষা রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ২ হাজার ৫০০টি ভাষা বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। এ ২ হাজার ৫০০টি ভাষার মধ্যে ভারতের ১৯৬টি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯২টি এবং ইন্দোনেশিয়ার ১৪৭টি ভাষা বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। বাকিগুলো অন্যান্য দেশের ভাষা। জরিপে বলা হয়, পৃথিবীতে বর্তমানে এমন ২০০টি ভাষা রয়েছে, যে ভাষায় কথা বলার লোকসংখ্যা ১০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং আরো ১৭৮টি ভাষা রয়েছে যে ভাষায় কথা বলার লোকসংখ্যা মাত্র ১১ থেকে ৫০ জন। জরিপে বলা হয়, গত ৩ প্রজন্মে পৃথিবী থেকে প্রায় ২০০টি ভাষা হারিয়ে গেছে। এভাবে মানবজাতির বংশ-বিস্তারের সাথে সাথে পৃথিবীতে নতুন ভাষার যেমন জন্ম হয়েছে, পুরাতন অনেক ভাষাও তেমনি ক্রমান্বয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গেছে।
বর্তমান পৃথিবীতে বিদ্যমান ৬০০০ ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান পঞ্চম। প্রায় ৩০ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। এ ভাষার শব্দসংখ্যা আনুমানিক ১ লাখ ২৯ হাজার। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা, এ ভাষার জন্য আমাদের সংগ্রাম ও রক্তদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এ ভাষার চর্চা ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে এর যথাযথ পরিচয় তুলে ধরা আমাদের কর্তব্য। জাতিসংঘের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য এখন আমাদের দৃঢ় প্রতীতি নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।