শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

পাখি ডাকা আর ফুল ফোটার উন্মাদনায় এসেছে ঋতুরাজ

সাদেকুর রহমান: অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। সেইসাথে রংপুর, রাজশাহী এবং খুলনা বিভাগের দু-এক জায়গায় হালকা বৃষ্টি অথবা গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর গতকাল রোববার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এ তথ্য জানায়। মাঘের শেষদিন সকাল ন’টায় দেশের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যথাক্রমে টেকনাফে ৩২ দশমিক ৪ ডিগ্রি ও তেঁতুলিয়ায় ৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একই সময়ে ঢাকার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ২৯ ও ১৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সে.। গেল দুই সপ্তাহ ধরেই শীতের তীব্রতা ক্রমহ্রাসমান। সূর্যের আলোর তীব্রতা যেন বাড়তির দিকে। আবহাওয়া দফতরের আরেকটি শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাসকে ‘মিথ্যে’ করে দিয়েই এসেছে ঋতুরাজ। আজ সোমবার পহেলা ফাল্গুন। পাখি ডাকা আর ফুল ফোটার অন্যরকম উন্মাদনা প্রকৃতিজুড়ে।

গতকাল আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আরো বলা হয়েছে, শেষরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের নদী অববাহিকার কোথাও কোথাও হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এদিকে সিনপটিক অবস্থা সম্পর্কে পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ বিহার ও তৎসংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। মওসুমী লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এর বর্ধিতাংশ উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।

শীত নগরে নেই, গ্রামে আছে। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় রাজধানীতে লেপ-কম্বলের ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়েছে। এরই মাঝে ঝরাপাতার গান বাংলা প্রকৃতির পালাবদলকে সম্মুখ করেছে বৈকি। ইতোমধ্যেই কোকিলের ‘কু..উ..উ..কু..উ..উ’ ডাক শুনেছেন নাগরিকরা। ঋতুর আবর্তনে গতকাল রোববার বিদায় নিয়েছে মাঘ তথা শীত। এদিকে, উৎসব-উন্মাদনার ঢেউ লেগেছে কংক্রিটের এই নগরে। রাজধানীতে বসন্ত বরণ করতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। 

ফাল্গুন পেরিয়ে বসন্ত তার যৌবনের চৌকাঠ মাড়িয়ে চৈত্রে পদার্পণ করবে। ফাল্গুন মাসের নাম ‘ফাল্গুনী’ তারা আর চৈত্র মাস ‘চিত্রা’ তারার নামের সঙ্গে মিল রেখে রাখা হয়েছে। এ সময় মহান প্রভুর অপার সৃষ্টি মহিমায় দক্ষিণ গোলার্ধ পরিভ্রমণ শেষে সূর্য তার কক্ষপথে উত্তর অভিমুখে ধাবিত হতে থাকে। আপনা হতেই প্রকৃতিতে লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। উত্তরী বায়ুর যাত্রাপথ রুদ্ধ হয়ে দখিনা মৃদুমন্দ সমীরণ লহর তোলে। তরুলতা পুরানো পাতা ঝেড়ে ফেলে নববধূরূপে মুকুলিত হয়। পত্রপল্লবে সুশোভিত হয় সবুজ উদ্যান। জানি না এবার বসন্তের আমোদনে ফাল্গুনের ঝিরিঝিরি হাওয়া, নির্মেঘ রোদ্দুর কতটা নতুন মাত্রা যোগ করবে নিসর্গে।

ফাল্গুন আসার আগেই অবশ্য আমমঞ্জরী কোষগুলো পরিণত হতে থাকে। কাঁঠাল গাছের শাখায় শাখায় ধরে মুছি (মুকুল)। লিচু গাছগুলোও ফলবতী হয়ে উঠেছে। এর চেয়েও বেশি বসন্তকে উপলব্ধি করা যায় রক্তিম পলাশ, শিমুল, কাঞ্চন, পারিজাত, মাধবী, গামারী আর মৃদুগন্ধের ছোট ছোট বরুণ ফুলে। এছাড়া গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়াসহ হাজারো নামের বর্ণালী ফুলতো বসন্তের সাজ আভরণ হিসেবেই বিবেচ্য। পৌষ-মাঘের জরা-ব্যাধির আসর এসে পড়ে পরের মাসেও। গরম অনুভূত তথা ঋতু বদলের বাতাস বইতে না বইতে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, পানিবসন্ত ইত্যাদি রোগ দেখা দেয়। চিকিৎসকরা এ সময়ে শিশু ও বৃদ্ধসহ সর্বসাধারণকে সচেতন হয়ে চলার পরামর্শ দেন।

খুব বেশি না হলেও কৃষির সাথে ফাল্গুনের যোগসূত্র রয়েছে। ‘যদি বর্ষে ফাল্গুনে/ চীনা কাউন দ্বিগুণে’, ‘ফাল্গুনে গুড় আদা, বেল, পিঠা/ খেতে বড় মিঠা’ এমনি আরো অনেক কৃষিবিষয়ক খনার বচন রচিত হয়েছে বাংলা বর্ষের একাদশ মাসকে ঘিরে। কৃষক ফাল্গুনের দেয়ালে পিঠ রেখে তাকিয়ে থাকে চৈতালী ফসলের দিকে। এই ফাল্গুনেই দিগন্তজোড়া মাঠের বোরো ধান সোনালি রূপ পেতে থাকে। ফাল্গুনের স্বরূপ কবি-সাহিত্যিক, চিত্রকর, সঙ্গীতশিল্পী, সাংবাদিক সকলকেই মুগ্ধ করে। ফাল্গুন তথা বসন্তকাল এলে গ্রাম থেকে নগর-আবহমান বাংলার সর্বত্রই মেলার মওসুমও শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)-এর ১৩৯০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের মেলা’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, গোটা বসন্তে মোট ৩২২টি গ্রামীণ মেলা বসে। এর মধ্যে ফাল্গুনে ৭৩টি ও চৈত্রে ২৪৯টি মেলা। লোক-কারুশিল্প পণ্য ছাড়াও এসব মেলায় বাহারি পসরা বসে। আধুনিক ব্যবহার্য ভোগ্যপণ্যও বাদ যায় না। রাজধানীতে ভাষা আন্দোলনের চেতনাঋদ্ধ প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির আয়োজনে এবারও চলছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

এর বাইরে ফাল্গুনের আরেক পরিচয় ভাষা শহীদদের তপ্তশোণিতাক্ত মাস। ঊনিশশ’ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, মোতাবেক আটই ফাল্গুন মাতৃভাষা ‘বাংলা’ প্রতিষ্ঠার জন্য রফিক, সালাম, জব্বার প্রমুখ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। বারবার ফিরে আসে ফাল্গুন, আসে বসন্ত-শোক নয়, সা¤্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী মোকাবিলায় দুর্বিনীতি সাহস আর অপরিমেয় শক্তি নিয়ে। বীর সন্তানদের অমর গাথা নিয়ে। যে কোনো বিচারে এ এক অনন্য মাস, ঋতু নৈসর্গিক ক্যানভাসে রক্তাক্ত বর্ণমালা যেন এঁকে দেয় অনির্বচনীয় সুন্দর এক আল্পনা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ