শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসিত : টিআইবি

স্টাফ রিপোর্টার: টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দুর্যোগ  মোকাবিলায় বাংলাদেশের অর্জন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছে। গতকাল বুধবার সংস্থাটির ধানমন্ডির কার্যালয়ে ‘ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু: দুর্যোগ  মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। ‘ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু : দুর্যোগ  মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে টিআইবি এ সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজন করে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই অর্জনকে এগিয়ে নিয়ে উচ্চতর পর্যায়ে বহুমুখী উৎকর্ষ নিশ্চিত করা ও সুশাসনের মৌলিক উপাদানগুলোকে বাংলাদেশের দুর্যোগ  মোকাবিলার মূলধারায় টেকসই করার উদ্দেশ্যে এ গবেষণায় ঘূর্ণিঝড়-পূর্ব এবং পরবর্তী কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, টিআইবি আশা করে এই প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্য, বিশ্লেষণ ও সুপারিশ বাংলাদেশে দুর্যোগ মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপে অধিকতর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নাগরিক অংশগ্রহণ এবং শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। ড. জামান আরও বলেন, দুর্যোগ  মোকাবিলায় সক্ষমতাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব যে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে একজন ব্যক্তিরও মৃত্যু ঘটবে না। তবে এ জন্য সঠিক ঝুঁকি নিরূপণ ও ঝুঁকি  মোকাবিলার জন্য গৃহীত সকল পর্যায়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তিনি বলেন, দুর্যোগ  মোকাবিলায় সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করে ত্রাণ বরাদ্দ ও বিতরণে স্বচ্ছতা, ন্যায্য বণ্টন এবং কার্যকর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
গবেষণার তথ্য অনুয়ায়ী, সুশাসনের ঘাটতির কারণ হিসেবে সতর্ক সংকেত প্রচারে সমন্বয়হীনতার ফলে সাংবাদিক সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এ সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরেন টিআইবি’র সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার এম জাকির হোসেন খান, সিএফজি এবং রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নীহাররঞ্জন রায়। গবেষণায় আরও সংযুক্ত ছিলেন রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাহিদ শারমীন ও নেওয়াজুল মওলা, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার রিসার্চ, সিএফজি।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। সংবাদ সম্মেলন সভাপতিত্ব করেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।
গোবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু  মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও তার কারণ, ফলাফল ও প্রভাব চিহ্নিত করা এবং গবেষণায় প্রাপ্ত চ্যালেঞ্জসমূহ  মোকাবিলায় সুপারিশ প্রদান করার উদ্দেশ্যে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়। সরকারিভাবে ঘূর্ণিঝড় পূর্ব প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং ঘূর্ণিঝড় পরবর্তীতে জরুরি সাড়া প্রদান, ত্রাণ কার্যক্রম এবং জরুরি পুনর্বাসন কার্যক্রম এবং বেসরকারিভাবে উপকারভোগী নির্বাচন এবং ত্রাণ কার্যক্রম এই গবেষণার অন্তর্ভুক্ত। ২০১৬ সালের মে মাস থেকে শুরু করে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত গবেষণার তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং প্রতিবেদন প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়। এই গবেষণায় সরকার কর্তৃক উপরোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সুশাসনের প্রধান চারটি নির্দেশক -স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনঅংশগ্রহণ ও শুদ্ধাচারের আলোকে তথ্য সংগৃহীত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। গবেষণায় তথ্য সংগ্রহের জন্য ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ১৫টি জেলার মধ্যে জেলাভিত্তিক সবচেয়ে বেশি মৃতের সংখ্যা, বেশি ক্ষতির শিকার খানা ও বাড়ির সংখ্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বিবেচনায় নির্বাচিত পাঁচটি জেলার (চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, ভোলা ও বরগুনা) নির্বাচিত প্রত্যেক জেলা হতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১টি এবং তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত ১টি উপজেলা বাছাই করে প্রত্যেকটি উপজেলা হতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১টি করে মোট ১০টি ইউনিয়ন তথ্য সংগ্রহের জন্য বাছাই করা হয়েছে। তবে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়, জেলা এবং উপজেলা থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষিত করা হয়েছে। এটি একটি গুণগত গবেষণা হলেও এতে অংশগ্রহণমূলক পরিসংখ্যান ব্যবহৃত হয়েছে। গবেষণায় প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতির মধ্যে ছিল - মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার, ফোকাস দলীয় আলোচনা এবং কমিউনিটি স্কোরকার্ড। তথ্য সংগ্রহে মুখ্য তথ্যদাতা হিসেবে কর্মকর্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, প্রতিনিধি, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য, ত্রাণ বিতরণকারী এনজিও’র কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণের নিকট থেকে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। পরোক্ষ উৎস হিসেবে গবেষণা সংশ্লিষ্ট আইন, নীতিমালা, আদেশাবলী ও প্রতিবেদন এবং সংবাদমাধ্যমের তথ্য পর্যালোচিত হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু -পূর্ববর্তী কার্যক্রমে ইতিবাচক উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য হালনাগাদকরণ; রোয়ানুর আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সতর্কবার্তা প্রচারের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ই-মেইল-এর মাধ্যমে নির্দেশনা প্রদান; স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকা সত্ত্বেও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে দুর্যোগের বার্তা প্রদানে স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগ গ্রহণ; স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক শুকনো খাবার সংগ্রহ এবং স্থানীয়ভাবে মজুদ ইত্যাদি। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু -পরবর্তী কার্যক্রমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কর্তৃক জরুরি ত্রাণ সহায়তা হিসাবে ৫,৬৮২ মেট্রিক টন চাল ও এক কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন এবং দুর্যোগকালে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জরুরি উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য ১২ টি পিকআপ ভ্যান, ১২ টি উদ্ধার নৌকা ৬ টি মোবাইল অ্যাম্বুলেন্স এবং ৪ টি উত্তাল সমুদ্রে অনুসন্ধান উপযোগী উদ্ধার নৌকার বরাদ্দ দেয়া হয়।
এ গবেষণায় ঘূর্ণিঝড়-পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ে সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে সুশাসনের প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে দুর্গম এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা প্রচারে, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি সংক্রান্ত তথ্য, আশ্রয়কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য, ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী জরুরি সাড়াদানে উপকারভোগী নির্বাচন ও ত্রাণের চাহিদা নিরূপণ প্রক্রিয়া সংক্রান্ত তথ্য এবং ত্রাণ বরাদ্দ ও বিতরণ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে ঘাটতি অন্যতম। এছাড়া ত্রাণ বরাদ্দ ও বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব দেখা গেছে। জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো, ঘূর্ণিঝড়ের আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দুর্যোগের ঝুঁকি যথাযথভাবে চিহ্নিত না করা, আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্গতদের নেয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোগ ও প্রয়োজনীয় যানবহনের ঘাটতি এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবহার অনুপোযোগিতা, উপকারভোগী নির্বাচন ও ত্রাণ বিতরণে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, ত্রাণ বরাদ্দ ও বিতরণ সংক্রান্ত অভিযোগ জানানো ও নিরসন ব্যবস্থার ঘাটতি, বেসরকারিভাবে ত্রাণ বরাদ্দ এবং বিতরণ সংক্রান্ত তথ্য কোনো কোনো উপজেলায় স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত না করা অন্যতম। জনসম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র আগে সচেতনতার অংশ হিসেবে নাগরিকদের অংশগ্রহণে নিয়মিত ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি মহড়ার আয়োজন না করা, আশ্রয়কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি’র পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ না থাকা এবং উপকারভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণে জনঅংশগ্রহণের ঘাটতি অন্যতম। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু পূর্ববর্তী সময়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশ্রয়কেন্দ্র প্রভাবশালীদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, প্রভাবশালীদের প্রভাবে আশ্রয়কেন্দ্র যথাস্থানে নির্মাণ না করা, নির্মাণে অনিয়ম, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু পরবর্তী কার্যক্রমে কোন কোন ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছামাফিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকাভুক্তিতে ও ত্রাণ বিতরণে ক্ষতিগ্রস্তের প্রয়োজনের তুলনায় রাজনৈতিক সমর্থককে বেশি গুরুত্ব প্রদান এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ত্রাণ আত্মসাৎ অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিলো।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ